রাশিয়া আমেরিকার বন্ধুত্ব ও শত্রুতা
- এম বজলুর রহমান
- ০৫ জুলাই ২০২৪, ০৫:৪৫
ইতিহাসের বিচিত্র গতিধারায় কেউ কখনো বন্ধু হয়, আবার কখনো শত্রুতে পরিণত হয়, যা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের বেলাতেও ঘটে। এটি জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে প্রায়শ গ্রহণযোগ্য হয় না। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের উত্থানের বিষয়টি। তিনি তার সমরশক্তি দিয়ে অল্পসময়ের মধ্যে পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্সকে পরাজিত করেছিলেন যা কল্পনাতীত। এতে অন্য বৃহৎ রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। জার্মানি যখন রাশিয়া দখলের জন্য দেশটি আক্রমণ করে ব্যর্থ হয় এবং হিটলার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতি মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুসভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও রাশিয়ার জোসেফ স্টালিন তেহরানে এক বৈঠকে বসেন, ইতিহাসে যা তেহরান কনফারেন্স নামে বিখ্যাত। বৈঠকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছাড়াও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে স্টালিনগ্রাডে রুশ সৈন্যদের অর্জিত বিজয় স্মরণে সোনার তরবারি স্ট্যালিনের হাতে অর্পণ করেন- যার মধ্য দিয়ে রাশিয়া-ইংল্যান্ড-আমেরিকা বন্ধুত্ব অটলভাবে প্রকাশিত হয়। যুদ্ধে একে অপরকে যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। সেমতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে যুদ্ধ উপযোগী চার লাখ মোটরগাড়ি, রেলইঞ্জিন, ১৮ হাজার যুদ্ধবিমান, ১১ হাজার যুদ্ধ উপযোগী ট্যাংক সরবরাহ করে। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড বিপুল সামরিক সরঞ্জাম ও লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলে অবতরণের মাধ্যমে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের জন্য একপর্যায়ে আরডেনিজ যুদ্ধে আমেরিকার অবস্থা সঙ্কটজনক হলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল দূত মারফত জোসেফ স্টালিনকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন যাতে রাশিয়া দ্রুত জার্মানির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ শুরু করে। তাহলে জার্মানি আরডেনিজ থেকে তাদের সেনা সংখ্যা কমিয়ে রাশিয়া অঞ্চলে পাঠাতে বাধ্য হবে।
বন্ধুত্বের খাতিরে আমেরিকা ব্রিটেনকে সে সহযোগিতা করেছিল রাশিয়া। সেই সাথে রাশিয়া প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে জার্মানির বার্লিন শহর দখল করে নেয়। আর ব্রিটেন এবং আমেরিকা জার্মানির পশ্চিম অংশ দখল করে নেয় জেনারেল আইসেনহাওয়ারের (পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট) নেতৃত্বে। জার্মানি কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে জার্মান বাহিনী জেনারেল আইসেনহাওয়ারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে। অন্যদিকে, জার্মান ফিল্ড মার্শাল কাইটেল বার্লিনের কার্লহসটে রাশিয়ার ফিল্ড মার্শাল জর্জি জুকভের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এই দুই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্ত ঘটে। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের কয়েক দিন আগে ১৯৪৫ সালের ৩ এপ্রিল অ্যাডলফ হিটলার তার স্ত্রী ইভাব্রাউন ফুয়েরারের বাংকারে আত্মহত্যা করেন।
দেখা যায়, হিটলারের উত্থান থেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত আমেরিকা, ব্রিটেন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব বহাল থাকে। হিটলারের মৃত্যুর পর এই ত্রিশক্তির মধ্যে বন্ধুত্বের ফাটল ধরা শুরু হয় এবং স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধ চলাকালে ত্রিশক্তি জার্মানিকে চার ভাগে বার্লিন শহরকে চার ভাগে ব্রিটেন আমেরিকা রাশিয়া ফ্রান্সের মধ্যে বণ্টন করা হয়। বার্লিন শহরটি চার ভাগে বিভক্ত হলেও কিন্তু পুরো বার্লিন শহরে যেতে হলে রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের উপর দিয়েই যেতে হতো। আমেরিকা চাইল তাদের বিমান রাশিয়াভুক্ত যেকোনো অঞ্চল দিয়ে বার্লিনের টেমপেলহফ বিমানবন্দরে অবতরণ করবে, কোনো নির্দিষ্ট আকাশপথে নয়। রাশিয়া তাতে ঘোরতর আপত্তি জানায়, যা রাশিয়ার অবন্ধুসুলভ আচরণ। পরবর্তীতে রাশিয়া চাইল আমেরিকা ব্রিটেনের হাতে যেসব জার্মান যুদ্ধবন্দী আছে তাদের বিচার করে প্রাণদণ্ড দিতে হবে। আমেরিকা ব্রিটেন তা কার্যকর করতে অস্বীকার করে। রাশিয়ার প্রস্তাব, জার্মান স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, গেস্টাপো বাহিনী, সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবোলিস করে দিতে হবে। আমেরিকা ব্রিটেন তা অস্বীকার করে।
রাশিয়ার আদর্শ যাতে ইউরোপের কোথাও বিস্তার লাভ করতে না পারে সেজন্য আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটোর সৃষ্টি করা হয়। অন্যদিকে রাশিয়াও ওয়ারশ জোট গঠন করে। কিন্তু নানাবিধ কারণে ও আমেরিকার কূটকৌশলে ওয়ারশ জোট ভেঙে যায়। সোভিয়েট ইউনিয়ন/রাশিয়া আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করার জন্য আফগানিস্তানে সৈন্য সমাবেশ করে।
বস্তুতপক্ষে রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আমেরিকা আফগানিস্তানে রাশিয়াকে পরাজিত করতে সব শক্তি নিয়োগ করে এবং রাশিয়াকে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। অতি সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিনির পুতিন বলেছেন, জব্দকৃত রুশসম্পদ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজ দিতে সম্মত হয়েছে- যা চুরি ছাড়া কিছু না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পূর্বের বন্ধুরা এখন চোর। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বর্তমান ডেপুটি চেয়ারম্যান মেদভেদ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এভাবে আমেরিকা এবং রাশিয়া কখনো পরস্পর বন্ধু হচ্ছে আবার শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। পরিস্থিতিভেদে এই অবস্থান পাল্টানো জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়; বরং খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এটিই অনুমোদন করে। বলা হয়, আজ যে বন্ধু আগামী দিনে সে শত্রু হতে পারে। সে জন্য সবাইকে এবং সব রাষ্ট্রকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। যাতে ভবিষ্যতের বিপদ এড়ানো যায়।
লেখক : ভাষাসৈনিক, সাবেক সভাপতি, আইনজীবী সমিতি, খুলনা বার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা