আত্মহত্যা নয়, জীবনকে ভালোবাসুন
- জালাল উদ্দিন ওমর
- ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৫:৪২
বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে এই সমস্যা বিদ্যমান। ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী, এমনকি বৃদ্ধ মানুষও আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। কুঁড়েঘরে বসবাসকারী গরিব মানুষ যেমন আত্মহত্যা করে, তেমনই অট্টালিকাবাসী মানুষও। আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিনই বাড়ছে।
সমস্যায় পড়লে কেউ কেউ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যাকারী মানুষটি মনে করে, এর মাধ্যমে সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে।
কিন্তু আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। এটি হচ্ছে নিজেকে চিরতরে ধ্বংস করার সহজ প্রক্রিয়া। একজন মানুষ যখন আত্মহত্যা করে তখন তার জীবন যেমন চিরতরে শেষ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়। তাই কারোরই আত্মহত্যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আত্মহত্যা বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান একটি সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। ভারতে বছরে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে প্রায় ২০ হাজার, জাপানে প্রায় ২২ হাজার ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বিরাটসংখ্যক ছাত্রছাত্রীও রয়েছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ৫৩২ জন, ২০২৩ সালে ৫১৩ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। এসবের মধ্যে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবপর্যায়ের ছাত্রছাত্রী রয়েছে। পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে। অথচ পরবর্তী সময়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করার সুযোগ আছে এবং ভালো ফল করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার অনেক নজির এই সমাজে রয়েছে। আবার কিশোর বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হয়েও অনেক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। অথচ এসব ছাত্রছাত্রীর সবারই অনেক সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ ছিল। কিন্তু ঠুনকো কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে এসব ছাত্রছাত্রী শুধু নিজেকেই চিরতরে শেষ করেনি; তাদের মা-বাবা, ভাইবোন ও পরিবারকেও শেষ করেছে। সন্তানের আত্মহত্যায় অনেক মা-বাবা শোকে পাগল হয়ে গেছেন। অনেকে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। একজন মানুষ যখন সুখে-শান্তিতে থাকে তখন কিন্তু সে আত্মহত্যা করে না। একজন মানুষ যখন বিপদে পড়ে, দুঃখ-কষ্টে থাকে তখন অনেকসময় সে সাহস হারিয়ে ফেলে, জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অনেকে আত্মহত্যা করে। সে মনে করে, আত্মহত্যার মাধ্যমে সে এ দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু আত্মহত্যার মধ্যে কোনো মুক্তি নেই; বরং এর মাধ্যমে সে নিজেকে চিরতরে শেষ করে দিলো এবং তার পরিবার ও আপনজনকে দুঃখ-কষ্টের সাগরে নিমজ্জিত করল। সুতরাং বিপদাপদে, দুঃখ-কষ্টে সবসময় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো সমস্যাই চিরস্থায়ী নয় এবং মানুষের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কোনো মানুষের জীবনেই সবসময় সুখ থাকে না। এটি প্রকৃতির নিয়মবিরোধী। রাতের আঁধার কেটেই দিনের আগমন হয়। দুঃখের পরই সুখ আসে। সুতরাং দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের সময় হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরতে হবে এবং ধৈর্য ও সাহসের সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। দেখবেন, সময়ের ব্যবধানে সফলতা অনিবার্য। সুতরাং আত্মহত্যা নয় , জীবনকে ভালোবাসুন।
যেসব কারণে সাধারণত মানুষ আত্মহত্যা করে তার কিছু উদাহরণ বর্ণনা করছি। যথাযথ চাকরি না পাওয়া, চাকরিতে প্রমোশন না পাওয়া, চাকরি হারানো, ব্যবসায় উন্নতি না হওয়া, ব্যবসায় ক্ষতি হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, লাইফ পার্টনারের পরকীয়া, একাকিত্ব, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, অবজ্ঞা এবং অপমানের শিকার হওয়া... ইত্যাদি কারণে মানুষের মনে দুঃখ-কষ্ট, হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে সামাল দিতে পারে না; জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে পড়ে। এ সময় সে কী করবে- তা অনেকে বুঝে উঠতে পারে না। তখন তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবং নিজেকে চিরদিনের জন্য শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আত্মহত্যা করে। অনেকে আবার সামাজিক মাধ্যমে লাইভে এসে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখে না আত্মহত্যার মাধ্যমে সে কেবল নিজেকে নয়, তার পুরো পরিবার ও আপনজনকেও নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। এসব ভেবে দেখলে একজন মানুষ কখনোই আত্মহত্যা করতে পারে না।
আমরা কেউই আমাদের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসিনি। আমাদের জন্ম, জন্মের সময় এবং জন্মস্থান কোনোটিই আমাদের স্বনির্ধারিত নয়। আবার আমরা পুরুষ না নারী হিসেবে জন্ম নেবো সেটিও আমরা ঠিক করিনি। একইভাবে আমাদের জীবন কত দিনের এবং আমাদের মধ্যে কার মৃত্যু কখন হবে- তাও আমরা নির্ধারণ করতে পারি না। এসব একান্তই সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত। আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই এই দুনিয়ায় আমাদের আগমন এবং জীবনযাপন। যেহেতু আমাদের জীবনের মালিক আমরা নই, সেহেতু নিজের ইচ্ছানুযায়ী এই জীবনকে শেষ করে দেয়ার অধিকারও আমাদের নেই। অর্থাৎ আত্মহত্যার কোনো অধিকার মানুষের নেই, কারণ এখানে নিজেই নিজেকে হত্যা করে। তাই আপামর জনগণের কাছে বিনীত অনুরোধ, জীবনে যত দুঃখ-কষ্ট এবং বিপদাপদ আসুক না কেন, ধৈর্য ধরুন। ধৈর্য ধরলে একদিন সবধরনের দুঃখ-কষ্ট, বিপদাপদ কেটে যাবে।
কোনো কাজে ব্যর্থ হলে আবার চেষ্টা করুন, একদিন সফল হবেন। দাম্পত্য জীবনে অশান্তি দেখা দিলে ধৈর্য ধরুন এবং লাইফ পার্টনারের সাথে আলাপ-আলোচনা করুন। কিন্তু আত্মহত্যা করে সংসার এবং আপনার লাইফ পার্টনারের জীবন ধ্বংস করবেন না। আত্মহত্যা করে নিজের জন্ম দেয়া সন্তানদের এতিম করবেন না। সন্তানদেরকে আদর সোহাগ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবেন না। দুঃখ, হতাশা ও ব্যর্থতাকে কাটিয়ে জীবনকে সুখী, আনন্দময় ও সফল করার হাজারো নজির এই সমাজে রয়েছে। সুতরাং কোনো অবস্থায় এবং কিছুতেই আত্মহত্যা করে নিজেকে চিরতরে শেষ করা যাবে না। আর আত্মহত্যায় ক্ষতি ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই।
মানুষের জীবন কখনোই ফুলশয্যা নয় যে, আরাম-আয়েশেই সবসময় জীবন কেটে যাবে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সফলতা-ব্যর্থতা- এসবই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারো জীবনেই শুধু সুখ, আনন্দ ও সফলতা নেই। আবারো কারো জীবনেই শুধু দুঃখ, বেদনা ও ব্যর্থতা নেই। ধনীর জীবনে যেমন সুখ ও সফলতা আছে, তেমনি তাদের জীবনেও দুঃখ ও ব্যর্থতা আছে। একইভাবে গরিবের জীবনে দুঃখ ও ব্যর্থতার পাশাপাশি সুখ এবং সফলতাও আছে। জীবন একটি বহমান নদীর মতো। নদীতে যেমন জোয়ার-ভাটা থাকে, তেমনি মানুষের জীবনেও সুখ-দুঃখ এবং সফলতা-ব্যর্থতা থাকে। সুতরাং জীবনের প্রতি সবসময় ইতিবাচক থাকুন।
আত্মহত্যা রোধে আমার-আপনার সবাই ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে, সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকতে হবে। দাম্পত্য কলহ না বাড়িয়ে তা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেই ভাবনাচিন্তা ও চেষ্টা করতে হবে। দাম্পত্য জীবনে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিতে পারে এমন যেকোনো কাজে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুখী হতে কিন্তু বেশি টাকা লাগে না, তাই জীবনে সুখী হতে চেষ্টা করুন।
মা-বাবাদের উচিত নয় পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য কখনো সন্তানকে অতিরিক্ত চাপ দেয়া। সন্তান যদি কখনো ফল খারাপ করলে, তাকে মাতাতিরিক্ত বকাবকি ও তিরস্কার না করে বরং তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহস ও সান্ত্বÍনা দিতে হবে, ভবিষ্যতে ভালো ফলের জন্য উৎসাহিত করতে হবে, তার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানের উপায় বের করতে হবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই আপনার সন্তানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তা ছাড়া একটি পরীক্ষায় ব্যর্থতা মানে কিন্তু সারা জীবনের ব্যর্থতা নয়। জীবনের একটি পরীক্ষায় খারাপ ফল সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে পরীক্ষায় সফলতা অর্জনের অনেক উদাহরণ বহু ছাত্রছাত্রীর জীবনে রয়েছে। সুতরাং পরীক্ষায় খারাপ ফল করা সন্তানের প্রতি অবহেলা নয়; বরং তার প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে দিন।
সচ্ছল পরিবারের অভিভাবকদের উচিত নয় অঢেল টাকা আছে বলে সন্তানকে অতিমাত্রায় বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত করে তোলা। তাদেরকে পরিমিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত করতে হবে; কষ্ট করতে ও ধৈর্য ধরতে শেখাতে হবে। কারণ কষ্ট করতে ও ধৈর্য ধরতে শিখলে তারা কখনো বিপদে ভেঙে পড়বে না, আত্মহত্যাও করবে না। বরং বিপদে ধৈর্য ধরে বিপদের মোকাবেলা করবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্ব কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ইতিবাচক ও আশাবাদী হিসেবে গড়ে তোলা।
কারো সহকর্মী বা বন্ধু-বান্ধবের কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়াতে হবে, তাকে বিপদ কাটিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে বিপদগ্রস্ত মানুষটিই হতাশ হয়ে আত্মহত্যা না করে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রতি অভিমান জীবনকে করে দুঃখী আর জীবনের প্রতি ভালোবাসা জীবনকে করে সুখী। আত্মহত্যার কারণে কারো জীবন যেন অকালে শেষ হয়ে না যায় এবং কারো বুক যেন খালি না হয়, তার জন্য আমাদের সবাইকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সবার সহযোগিতায় আত্মহত্যা নামক আত্মঘাতী সামাজিক ব্যাধিটি সমাজ থেকে চিরতরে নির্মূল হোক- এটিই প্রার্থনা।
এ অবস্থায় আত্মহত্যা প্রতিরোধে আজ আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে এবং মানুষকে আত্মহত্যা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা