০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫
`

মার্কিন বিশ্বনীতি ও বাংলাদেশ

মার্কিন বিশ্বনীতি ও বাংলাদেশ - ফাইল ছবি

১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে বিশ্বে একক নেতৃত্বে আসে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েতের পতন হলেও এর মূল অংশ রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। এ ছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্রধর আরও কিছু শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে, যার মধ্যে চীন ও ভারত অন্যতম। এই দু’টি রাষ্ট্র বিশ্বনেতা হওয়ার প্রত্যাশী। এই দু’টি রাষ্ট্র কৌশলগত কারণে রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন হলো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। সাম্রাজ্যবাদের দু’টি ধারা। রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ এবং বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদ। বিশ্বে চীন এখন বাণিজ্যিকভাবে অগ্রগামী। দেশটি বাণিজ্যিকভাবে সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে। এটিকে বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদ বলা চলে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান তিন ভাগের এক ভাগ। ২০২৩ সালে চীনের মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১৩ হাজার ৭২০ ডলার। জিডিপির পরিমাণ ১৯ লাখ ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। যা বিশ্বে দ্বিতীয়। কোনো রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলে সে রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে, সমর কৌশলে, শিক্ষা-চিকিৎসায় অগ্রসর হতে পারে। মাথাপিছু আয়ও তাদের বেড়ে যায়।

ফলে তারা বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা লাভ করে। বিশ্লেষক সমাজ মনে করেন চীনের বর্তমান অগ্রসরমানতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে চীন। চীনের উত্থান রোধে সহায়ক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে বেছে নিয়েছে। কারণ চীন-ভারত সম্পর্ক মধুর নয়। এই সম্পর্ককে ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’-এই নীতিতে দেখে মার্কিন বিশ্বনীতি। সে জন্য চীন ইস্যুতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরকে মিত্র হিসেবে দেখছে। কিন্তু মিত্রতা নিকট ভবিষ্যতে মার্কিনদের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে।

এ বিষয় কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে-
যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজনকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করেছিল। যার নাম নিশা দেশাই। তার জন্ম ১৯৬৮ সালে ভারতের গুজরাটে। নিশা দেশাই জন্মগত কারণে বৈশ্বিক ব্যাপারে ভারতের স্বার্থে কাজ করতে চাইবেন এমনটি সহজে অনুমান করা যায়। যদি নিকট ভবিষ্যতে তিনি আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান তাহলে স্বাভাবিকভাবে ভারতের স্বার্থে কাজ করতে পারেন। এই অঞ্চলে ভারত বংশোদ্ভূত আরো কর্মকর্তা তৈরি হলে ভারত বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিনিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ^জুড়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রনেতার মধ্যে রয়েছেন মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী কমলা হ্যারিস। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমলা হ্যারিসের মা ভারতীয় এবং বাবা আফ্রিকান। মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ্র যুগ নাউথ ও প্রেসিডেন্ট পৃথ্বিরাজ রুপুন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অর্ধশত মন্ত্রী রয়েছে। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মন্ত্রীর সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যের জনগণ এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিকে সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করছে। এছাড়াও ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির নেত্রী প্রীতি পাটেল ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি একসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এসব ব্যক্তিবর্গ বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে তার দেশের পরে ভারতের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারে। ফলে এক্ষেত্রেও ভারত নিকট ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বৈশ্বিক নীতিতে দেশটি ভবিষ্যতে ভারতের কাছে অসহায় হয়ে পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত যেসব শীর্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের কারণে বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন অবস্থান নাজুক হয়ে পড়তে পারে। সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন, তেমনি বিশ্বের জন্যও দুঃসংবাদ। মার্কিন প্রশাসনের ভ্রান্ত বিশ্বনীতির কারণে মাত্র দুই জেনারেশনের মধ্যে বিশ্বরাজনীতির নেতৃত্ব ভারতের অনুকূলে চলে যেতে পারে।
তবে এমনটি যদি হয় তাহলেও অনেকের ধারণা, ভারতীয় বিশ্ব নেতৃত্ব টেকসই হবে না। কারণ ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষমূলক নীতি বিশ্বশান্তির জন্য কখনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না। তবে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র একবার সরে গেলে তার পক্ষে আবার নেতৃত্বে ফেরা অসম্ভব হতে পারে। বিশ্বে এক নতুন পোলারাইজেশন হবে। আমাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতকে মিত্র হিসেবে সামনে এগিয়ে দিচ্ছে সেই ভারতই হবে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্ভাগ্যের কারণ।

বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বলা যায়, রাশিয়া এবং চীন বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে দিতে সদা সচেষ্ট। রাশিয়া তার বিশ্ব নেতৃত্ব ফিরে পেতে চায়। আর চীন বিশ্ব নেতৃত্ব প্রত্যাশী। চীন বাণিজ্যিকভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক সা¤্রাজ্য বিস্তারে চীন এখনও বেশ পিছিয়ে। রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা বিশ্বে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। চীনে মাওবাদ কিছুটা বিস্তার লাভ করলেও বর্তমানে এই তিন বাদ বিশ্বরাজনীতিতে অত্যন্ত দুর্বল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এখন সারা বিশ্বে পুঁজিবাদের জয়জয়কার। আর এ ক্ষেত্রে চীন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে বিশ্ব নেতৃত্ব অচিরেই চীনের কব্জায় এসে যেতে পারে এমন ধারণা মার্কিন প্রশাসনে রয়েছে। এই উপলব্ধি মার্কিন প্রশাসনকে অস্থির করে তুলছে। এই অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতৃত্ব নিজের কব্জায় রাখতে এবং চীনকে ঠেকাতে ভারতকে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু ভারতও যে বিশ্ব নেতৃত্বের আকাক্সক্ষী তা মার্কিন প্রশাসন কতটুকু অনুধাবন করতে পারছে? আমাদের মনে হচ্ছে, বিষধর সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে কেউ যেন অজগর পুষছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে ছিটকে ফেলার জন্য রাশিয়া, চীন, ভারত এই তিন পরমাণু শক্তির সাথে যুক্ত হতে পারে ইরান-উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। প্রথম তিনটির বিশ্ব নেতৃত্ব নেয়ার জন্য নিজ নিজ কৌশল থাকলেও বাকি দু’টি রাষ্ট্রের কোনো পলিসি আপাতত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। তবুও এই পঞ্চপারমাণবিক শক্তিকে মার্কিন নেতৃত্বের জন্য যৌথভাবে বা পৃথকভাবে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই সঙ্কট থেকে মুক্তির উপায় মার্কিনিদের বিশ্বনীতির সংস্কার। মার্কিন বিশ্বনীতি যদি ব্যাপকাংশে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে থাকে, তাহলে তা ব্যর্থ হবে এবং নেতৃত্ব হাতছাড়া হতে পারে।

মার্কিনিদের বাংলাদেশ নীতিতে মূলত মার্কিন স্বার্থই বিবেচনায় রাখা হবে এটাই স্বাভাবিক। মার্কিন স্বার্থ হলো- এ দেশে বা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব হ্রাস করে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে চীনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সেটি প্রধানত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক প্রভাব ততটা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ভারতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যেমন রাজনীতিতে, তেমনই ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ দেশে চীনের প্রভাব হ্রাস হলে ভারতের প্রভাব বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নয়।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সর্বকালের সর্বনিম্ন জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতা দখল করে আছে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে বয়কট করেছে। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেন্টিমেন্টের বিপরীতে গিয়ে বা পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দিয়ে জনসমর্থন অনুকূলে আনা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা চীনের চেয়ে কম। এই সত্য যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে।

লেখক : শিক্ষক নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : kazimain@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement