বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব : মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
- মুহাম্মদ শাহ আলম
- ০২ জুলাই ২০২৪, ০৬:২২
বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়। এরপর বিএনপির দায়িত্ব নেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন নেত্রী হিসেবে খ্যাত বেগম খালেদা জিয়া; যিনি প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার নেতৃতে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়।
আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার আন্দোলনে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ওই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারেনি। পরবর্তীতে ফখরুদ্দীন-মইনের নেতৃত্বাধীন সেনা-সমর্থিত সরকার গঠনের পর বিএনপির ওপর নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরবচ্ছিন্ন নির্যাতন পরবর্তী বর্তমান সরকারের গুম খুন হামলা মামলার পরও এখন পর্যন্ত দলের মধ্যে কোনো ভাঙন ধরানো যায়নি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাহাড়সম ব্যর্থতার পরও বহু মামলা হামলায় জর্জরিত হয়েও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখনো শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ আছেন।
গত ৭ জানুয়ারি আরো একটি একতরফা নির্বাচনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা হতাশ করেছে জাতির গণতন্ত্রকামীদের; যার ফলে দলে পুনর্গঠন ও নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন অনুভূত হয় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের। বিএনপি নতুন উদ্যমে আন্দোলন শুরু করতে এবং দল শক্তিশালী করতে দল পুনর্গঠন করা শুরু হয়েছে। এ বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি ইউনিটের আহ্বায়ক কমিটিগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে। একই সাথে চট্টগ্রাম ও বরিশাল সিটি ইউনিটের আহ্বায়ক কমিটিগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়েছে।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যারা ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের সরিয়ে ‘পরীক্ষিত ও তরুণ’ নেতাদের নিয়ে আসতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে দলটির অন্দরমহলের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। যাদের ব্যর্থতায় দল যেমন আজ কঠিন সময় পার করছে সাথে সাথে পুরো দেশবাসীকেও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে এবং পর দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার আন্দোলনে গা-বাঁচিয়ে চলা, উপদলীয় কোন্দল এবং এর ফল এবং তাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করে দল পুনর্গঠন এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে দলে আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। এর আলোকে ২৬০ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
নির্বাচনের পর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দলের পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া শুরু করতে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকা সিটি ইউনিটের নেতাদের সাথে বৈঠক করা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেন, আন্দোলন বেগবান করতে হলে মহানগর কমিটিতে যোগ্য নেতৃত্ব আনতে হবে। এ জন্য যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, চট্টগ্রাম মহানগর ও বরিশাল মহানগরী কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
বিএনপিতে নতুন পদায়ন : নতুন যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে ত্যাগী ও পরিশ্রমীদের পদায়ন উৎসাহ জোগাবে বলে মনে করেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী। দলে পরিবর্তন নিয়ে আলাপকালে বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, নতুন যাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তাগিদে হয়েছে। কেউ মারা গেছেন, কেউ পদত্যাগ করেছেন; কেউ নিষ্ক্রিয় আছেন; সে হিসেবে দলে ৬০-৭০টি খালি পদ ছিল। এ শূন্যপদ পূরণে গণতান্ত্রিকভাবে শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষমতা ও অধিকার রয়েছে। আরপিওতে ৩০ শতাংশ মহিলা কোটা পূরণের কথা বলা আছে; তা আস্তে আস্তে পূরণ করা হবে। তার মতে, নতুন কমিটিতে নিবেদিতপ্রাণ ও যোগ্য নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যালোচনা করে কমিটিতে যোগ্যদের নিয়ে আসছেন। তবে সামান্য ভুলত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, মানুষমাত্র ভুল করতে পারেন। কাউন্সিল সম্পর্কে জানা যায়, নতুন কাউন্সিল সময়মতো হবে। এখন শুধু যোগ্যদের দিয়ে শূন্যপদগুলো পূরণ করা হচ্ছে। যেসব কমিটির মেয়াদ শেষ হয়নি সেখানে নতুন মুখ অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তবে যারা আন্দোলনের সময় নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের বাদ দেয়া হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ইতোমধ্যে ব্যর্থ নেতাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা : সরকারের অব্যাহত চাপ, গ্রেফতার এবং শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।
এ মুহূর্তে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে মাঠপর্যায়ের ও সচেতন মানুষের যেসব দাবি তা হলো : ১. মাঠের অবস্থা পর্যালোচনা করে যোগ্যদের পদায়ন করা। ২. মাঠপর্যায়ে দলের ত্যাগী ও মামলা হামলার শিকার কর্মীদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদায়ন করা। ৩. অযোগ্য ও দুর্বলচিত্তের নেতাদের চিহ্নিত করে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়া। ৪. তোষামোদের মাধ্যমে দলীয় পদ পাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। ৫. দলকে নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নেয়া। ৬. দলের মধ্যে সর্বত্র মানবিকতা ও গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ তৈরি করা।
বিএনপিকে ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এ জন্য কিছু কথা দলটিকে মাথায় রাখতে হবে বলে আমরা মনে করি। যেমন-
১. সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা: দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং সামনে হবে, তা দলের ভেতরে নতুন উদ্যম সৃষ্টি করতে যেন সহায়ক হয়। তবে এসব পরিবর্তন যাতে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না করে সেদিকে নজর দেয়া।
২. যুব ও ছাত্রদের অংশগ্রহণ : ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, যা তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয় করার একটি প্রচেষ্টা। এটি দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে যাতে সহায়ক হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তবে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সক্ষম নেতৃত্ব তৈরি : দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বকে আরো শক্তিশালী ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্রুততা ও দক্ষতা দেখাতে হবে। এ জন্য সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিও পুনর্গঠন করার কথা ভাবতে হবে।
৪. জনসম্পৃক্ততা : দলের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে এবং নতুন সমর্থক তৈরি করতে জনসংযোগ বাড়ানো সময়ের দাবি। বিভিন্ন সামাজিক ও জাতীয় ইস্যুতে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জাতীয় সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. প্রযুক্তির ব্যবহার : আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা, প্রচার এবং জনসংযোগ বাড়ানো যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সঠিকভাবে ব্যবহার করে দলের সাফল্য এবং উদ্যোগ জনগণের কাছে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ।
৬. অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মীমাংসা : দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, উপদলীয় কোন্দল ও মতবিরোধ মীমাংসা করে ঐক্যবদ্ধভাবে এগোতে হবে। নেতাকর্মীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব বাড়াতে হবে। যদিও বর্তমানে মাঠপর্যায়ে কোন্দল নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উপদলীয় কোন্দল দীর্ঘদিন ধরে জিয়ে রয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে- এটি একটি জনপ্রিয় ও জনমানুষের দল; সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে দলটিকে সামনে এগোতে হবে। দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়ার নীতি ও আদর্শ ধারণ করে শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে তা মেনে চলতে হবে। তবেই মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হবে বিএনপির। বর্তমান কঠিন সময় অতিক্রম করতে দলটির অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যেতে হবে। আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে পারবে বিএনপি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে বাস্তবতার আলোকে।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক আইআইইউএম, মালয়েশিয়া
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা