২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নারী নির্যাতন রোধে ধর্মীয় অনুশাসন

নারী নির্যাতন রোধে ধর্মীয় অনুশাসন - নয়া দিগন্ত

সময়ের সাথে সাথে ঘরে বাইরে সর্বত্রই নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বাড়ছেই। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক মেয়ের জীবনে ভয়াবহ দুর্ভোগ নেমে এসেছে। শিক্ষাঙ্গনেও ছাত্রীরা আজ যৌন নির্যাতিত হচ্ছে। অপমান সইতে না পেরে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আবার যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেকে লেখাপড়া পরিত্যাগ করেছে। আবার নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়েও অনেকে নির্যাতিত এমনকি জীবনও হারিয়েছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই কথা বলা হচ্ছে। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রতি বছর ৮ মার্চ পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নারী দিবস। কিন্তু নির্যাতন কমছে না বরং তা আরো বাড়ছে।

নারী নির্যাতন না কমার প্রকৃত কারণ, আমাদের ধর্মীয় অনুশীলন বর্জন। ধর্ম ছাড়া মানুষ কখনো নৈতিক চরিত্রে সমৃদ্ধ হতে পারে না। আর নৈতিকতা ছাড়া কখনো কোনো অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। ধর্মহীনতা মানুষের নৈতিক অধঃপতনের প্রধান কারণ। ধর্ম পরিত্যাগ করে কেউ ভালো হতে পারেনি। আধুনিকতার নামে ধর্মকে পরিত্যাগ করার ফলে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে চারিত্রিক মাধুর্য, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানবিকতা। ফলে নারী নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়ন বাড়ছে। সুতরাং সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা নারী নির্যাতনমুক্ত এবং নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত একটি সমাজ চাই তাহলে ধর্মকেই অনুশীলন করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনই কেবল নারীর প্রতি সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতন বন্ধ করতে পারে। কারণ প্রত্যেক ধর্মই নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করেছে।

নারী এবং পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী-পুরুষের পারস্পরিক ভালোবাসা এবং আকর্ষণ চিরন্তন, শাশ্বত এবং সৃষ্টিগত। কিন্তু নারী-পুরুষের এই ভালোবাসাকে উপভোগ করার জন্য আল্লাহ একটি সুনির্দিষ্ট সীমারেখা দিয়েছেন। স্রষ্টা কেবল বিয়ের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ককে বৈধ করেছেন। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব কল্যাণ এবং শান্তি নিয়মমাফিক ব্যবহারে যে জিনিস ভালো ফল দেয়, নিয়মবহির্ভূত ব্যবহারের কারণে সেই একই জিনিস খারাপ ফল বয়ে আনে। সঠিক ব্যবহারে বিদ্যুৎ মানুষের অনেক উপকার করে। আবার নিয়ম না মানার কারণে এই বিদ্যুৎই মানুষের জন্য মরণ নিয়ে আসে। একইভাবে নিয়ম মানলে নারী-পুরুষের সম্পর্ক শান্তি আনে আবার এই নিয়ম না মানলে তা কেবল অশান্তি সৃষ্টি করে। সুখ শান্তির স্বার্থেই স্রষ্টা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করেছেন এবং নারীদের জন্য শালীন পোশাকের নির্দেশনা দিয়েছেন। পাশাপাশি পুরুষকে ও তাদের দৃষ্টিকে সংযত করা এবং শালীন পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তোমরা জাহেলি যুগের মতো রূপ যৌবনের প্রদর্শনী করে বেড়িও না’ (সূরা আল আহজাব-৩৩)। তিনি আরো বলেন, ‘হে নবী, তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মুমিন মহিলাদের বলে দাও, তারা যেন নিজেদের ওপর নিজেদের চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়। এটা বেশি ভালো নিয়ম ও রীতি। যেন তাদেরকে চিনতে পারা যায় ও তাদের উত্ত্যক্ত করা না হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু ( আল আহজাব:৫৯)।

নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান বিজ্ঞানসম্মত এবং কল্যাণকর। যার কারণে ইসলামের অনুসারী নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় না, একইভাবে ইসলামের অনুসারী পুরুষরা নারী নির্যাতনে লিপ্ত হয় না। এই কারণে নারী নির্যাতনের হার মুসলিম সমাজেই সবচেয়ে কম। পশ্চিমা সমাজ ধর্ম পরিত্যাগ করে কিন্তু সুখী হতে পারেনি। যৌনতাকে ফ্রি করা সত্ত্বেও, পশ্চিমা সমাজেই নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। পারিবারিক অবকাঠামো সেখানে পুরোপুরিই ধসে পড়েছে। বিয়ে না করে সেখানে নারী-পুরুষরা লিভ টুগেদার করছে।

সমকামিতাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। কুমারী মাতা এবং অবৈধ সন্তানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে মুসলিম সমাজসহ যেসব সমাজে ধর্মের প্রভাব রয়েছে, সেখানে এখনো পারিবারিক কাঠামো বিদ্যমান এবং নারী নির্যাতনের হার কম। মুসলিম দেশগুলোতে সংঘটিত অপরাধের পরিমাণ এখনো পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। আর এটা হচ্ছে বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে লাভ নেই। মানবতার কল্যাণের স্বার্থেই আজ আমাদের সবাইকে ধর্মের কাছে ফিরে যেতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে ধর্মীয় মূল্যবোধে গড়ে তুলতে হবে।

ধর্ম বাদ দিয়ে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা কী পরিণতি নিয়ে এসেছে কয়েকটি উদাহরণ দিলে তা পরিষ্কার হবে। পশ্চিমা সমাজে নারীরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীন। অথচ সেখানেই নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, সবচেয়ে বেশি ধর্ষিত। সেখানেই দাম্পত্যজীবন সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী এবং ডিভোর্সের হার সবচেয়ে বেশি। ইতিহাসের পাতা থেকে এ বিষয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি।

সিএনএন পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ২৯ শতাংশ আমেরিকান পুরুষ জীবনে ১৫ জন বা ততোধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছেন। অন্যদিকে ৯ শতাংশ নারী তাদের জীবনে ১৫ বা ততোধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছেন। ১৫ বছর বয়সের আগে যৌনতার স্বাদ পেয়েছে এমন বয়স্কের সংখ্যা ১৬ শতাংশ। মাত্র ২৫ শতাংশ নারী এবং ১৭ শতাংশ পুরুষ বলেছে, তাদের একজনের বেশি জীবনসঙ্গী নেই। মাদক ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২৬ শতাংশ পুরুষ এবং ১৭ শতাংশ নারী কোকেন ও অন্যান্য মাদক গ্রহণ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিজ কন্ট্রোল সেন্টারের শাখা ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিস্টিকস ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ২০ থেকে ৫৯ বছর বয়স্ক ৬,২৩৭ জন নর-নারীর ওপর জরিপ চালিয়ে এই ফলাফল পায় (২৫/০৬/২০০৭ আমার দেশ)। অন্যদিকে ব্রিটেনের অফিস ফর ন্যাশনাল স্টাটিস্টিকস পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩১ সাল নাগাদ ব্রিটেনে বৈধ মা-বাবার সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাবে। রিপোর্টে বলা হয়, বিগত এক দশকে অবৈধ জুটির সংখ্যা ৬৫ শতাংশ বেড়ে ২.৩ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। শুধু লন্ডনের পরিবারগুলোর মধ্যে সিঙ্গেল মাদার বা স্বামীহীন মায়ের পরিবার রয়েছে ২২ ভাগ, যা ব্রিটেনের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি (০৬/০১/০৮ যায়যায়দিন)।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘পল রবিসন হাইস্কুলের’ মোট ৮০০ ছাত্রীর ১১৫ জনই ‘কিশোরী মা’ হয়েছে বলে মার্কিন সিবিএস নিউজ জানিয়েছে। স্কুলটির প্রতি সাতজন ছাত্রীর একজন কিশোরী মা। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হয়তো আরো অনেক ছাত্রী নিজেদের ভেতর সন্তান বয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেগুলো শনাক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা সঠিক সংখ্যা বলতে পারছি না (২৩.১০.০৯ ইত্তেফাক)।

এই হলো ধর্মহীন পশ্চিমা সমাজের চিত্র। একইভাবে পশ্চিমা দেশগুলো, তাদের মতে নারী স্বাধীনতা এবং নারী অধিকারের তীর্থস্থান হলেও সেখানেই নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার।

এ অবস্থায় নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানিমুক্ত একটি সুন্দর সমাজের জন্য প্রত্যেকের উচিত তার নিজ নিজ ধর্ম অনুসরণ করা এবং এর আলোকে মানুষকে চরিত্রবান করে গড়ে তোলা। আমাদের সমাজেও আজকে যারা আধুনিকতার নামে ধর্ম পরিত্যাগ করেছে তাদের জীবনে কিন্তু শান্তি নেই। দা¤পত্য কলহ, বিচ্ছেদ, হতাশা এবং সুইসাইডই এদের সঙ্গী হয়ে যায়। নাটক-সিনেমার পর্দায় যারা ভালোবাসার গান গায়, তাদের অধিকাংশের জীবনেই কিন্তু ভালোবাসা নেই। এটি প্রমাণিত সত্য। ধর্মহীনতা যদি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারত, তাহলে ধর্মহীন নারীরা নির্যাতিত হতো না। আর বিয়ে ছাড়া একজন নারী এবং পুরুষের মধ্যে কখনোই শুধু বন্ধুত্বের স¤পর্ক হতে পারে না এবং থাকতে পারে না। কারণ এখানে পারস্পরিক শারীরিক এবং মানসিক আকর্ষণ ও আবেদন এবং নির্ভরতার বিষয় রয়েছে। তাই আসুন আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম মেনে চলি এবং এর মাধ্যমেই নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করি। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও হয়রানিমুক্ত সমাজ গঠনে এর বিকল্প নেই।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল