২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাহুলই ‘বাজিগর’

রাহুল গান্ধী - ফাইল ছবি

‘পাপ্পু’, ‘শাহজাদা’ যে ‘বাঘ’ হয়ে যাবে কল্পনাই করেননি মোদি-অমিত শাহরা। আর নানাভাবে রাহুল গান্ধীকে অপদস্থ করার প্রশ্নে সর্বক্ষণ তাদের লেজুড় ছিল ‘গোদি মিডিয়া’ অথবা বিজেপির আইটি সেল। রাহুল প্রমাণ করে দিয়েছেন এবারের ভারতের লোকসভা ভোটে তিনিই ‘বাজিগর’, তাকে উপহাস বা কটাক্ষ করে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ধর্মীয় জিগির, বুলডোজার কিংবা মন্দির রাজনীতির অভিমুখের বদলে কীভাবে সংবিধান, গণতন্ত্র, গরিব মানুষ, কৃষকের সঙ্কট, শ্রমিকের দুর্দশা ভোটের ইস্যু হতে পারে- তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি। এ কারণেই মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে রাহুল জোর গলায় বলতে পেরেছেন, ‘দেশের গরিব মানুষ সগর্বে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা মোদিকে চায় না, শাহকেও চায় না।’

কীভাবেই না হেনস্তা করা হয়েছে তাকে! নেতাদের তির্যক মন্তব্যই শুধু নয়, বিজেপির আইটি সেল নানা কদর্য ‘মিম’ও প্রচার করে ঢালাওভাবে। পাল্টা আক্রমণে না গিয়ে রাহুল রাজনীতিতে ধীরে ধীরে জ্বলন্ত ইস্যু সামনে তুলে আনেন। প্রথম কোনো কংগ্রেসের নেতা হিসেবে আঘাত হানতে দ্বিধা করেননি মোদি-ঘনিষ্ঠ করপোরেটদের বিরুদ্ধে। তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন মোদির ‘স্বৈরতন্ত্র’কেও।

সূত্রপাত অবশ্যই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা দিয়ে’। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মির পর্যন্ত পদযাত্রা করেছেন ‘দেশ বাঁচানোর’ স্লোগান তুলে। বলেছেন, দেশের সামনে এখন মূল লড়াই হলো ‘ভারত জোড়ো’ মতাদর্শের সাথে ‘ভারত তোড়ো’ ভাবনার। ভারতীয়দের প্রকৃত সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন গোটা যাত্রাপথে। বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, মোদিরা ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভাজন চান।

কংগ্রেস এবার অনেক বেশি নমনীয়তা দেখিয়ে বিরোধীদের নিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ গড়ে তুলে মোদিদের বিরুদ্ধে লড়েছে। এ ব্যাপারেও রাহুল গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কংগ্রেস এবার ৫৪৩-এর মধ্যে ৩২৮ আসনে লড়াই করে ইন্ডিয়া মঞ্চের অন্য দলগুলোর জন্য ছেড়ে দিয়েছে ২১৫ আসন। মোদিকে হারানোই পাখির চোখ করেছিল কংগ্রেস, ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্য দিয়ে, সে সূত্র বেঁধে দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধীই। হয়তো সম্পূর্ণ সফল হননি রাহুল, কিন্তু ‘মোদি মিথ’-কে বড় ধাক্কা দিতে পেরেছেন নিশ্চিতই।

তার সভায় ভিড় উপচে পড়তে দেখা গিয়েছে। বার বার হাতে লাল মলাটের সংবিধানের কপি তুলে ধরে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন ভারতবাসীকে। জনগণও তার আহ্বানে ভালোমতোই সাড়া দিয়েছে।

পাল্টে গেছে অনেক হিসাব-নিকাশ
নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে আসন পেয়েছে ২৪০টি। সরকার গঠনের জন্য দরকার ২৭২ আসন। ফলে দলটি এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। সরকার গঠনের জন্য জোটের ওপর নির্ভর করতে হবে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট মোট ২৯৩ আসন পেয়েছে। অন্যদিকে, বিরোধী কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯ আসন। কংগ্রেসের ‘ইন্ডিয়া’ জোট পেয়েছে ২৩৩ আসন। আগের বারের তুলনায় বিজেপি এই ভোটে ৬৩ আসন কম পেয়েছে। ২৪০ আসনে থমকে যাওয়ার অর্থ সরকার গঠনের ম্যাজিক ফিগার থেকে ৩২ কদম দূর। বিস্ময়কর হলো, এই ৬৩ আসনের মধ্যে ৪৪টি আসন বিজেপি হারিয়েছে তিন রাজ্য-উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থান-যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি! এই লোকসভা নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কার্যত পুনরুত্থান হয়েছে কংগ্রেসের। বিরোধী দলনেতার পদের জন্য লোকসভায় ৫৫টি আসনে জেতা প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৪-তে ৪৪ এবং ২০১৯-এ ৫২টি আসনে জেতা কংগ্রেস সংসদীয় বিধি অনুযায়ী সেই মর্যাদা পায়নি। এবার সেই মর্যাদা পেতে চলেছে কংগ্রেস।
সারা ভারতে ২৮৬টি আসনে মুখোমুখি লড়াই করেছে বিজেপি এবং কংগ্রেস। মুখোমুখি লড়াইয়ে এবারও তারা হেরেছে বিজেপির কাছে কিন্তু আসন বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালে কংগ্রেসের স্ট্রাইক রেট ছিল ৮.৩ শতাংশ। এবার ২৯ শতাংশ।

বলা হয়, উত্তর প্রদেশ যার, দিল্লি তার। এই প্রদেশের লোকসভার আসন ৮০টি। গত বছর বিজেপি একাই পেয়েছিল ৬২টি আসন। এবার সব হিসাব পাল্টে গেছে। আসনের মধ্যে ৩৭টিতে জিতে একক বৃহত্তম দল হয়েছে অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি। কংগ্রেস জিতেছে ছ’টিতে। অন্যদিকে, বিজেপি জিতেছে ৩৩টি লোকসভা আসনে। মোদির মেরুকরণের রাজনীতি আর যোগী আদিত্যনাথের ঔদ্ধত্যকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’। বারানসিতে দিনের শুরুতে প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং মোদি। ২০১৯ সালে চার লাখ ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জেতা মোদি এবার এক লাখ ৫২ হাজার ভোটে হারিয়েছেন কংগ্রেসের প্রার্থীকে। অথচ বিজেপি ঘোষণা দিয়েছিল মোদি এবার জিতবেন ১০ লাখ ভোটের ব্যবধান।

রাজস্থানেও বিজেপির হিসাব মেলেনি। গত দু’টি লোকসভায় রাজস্থানে ২৫টি আসনের মধ্যে ২৫টিই পেয়েছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। সেই রাজস্থানে এই লোকসভায় ভোটে বিজেপি এসে ঠেকল ১৪ আসনে। তাদের পুরনো জোটসঙ্গী আরএলপি পেয়েছে একটি। আর অন্য দিকে, বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার শরিক সিপিএম একটি আসন পেয়ে খাতা খুলেছে এ রাজ্যে। আর গত দুই লোকসভায় রাজস্থানে শূন্য পাওয়া কংগ্রেস পেয়েছে আটটি আসন। অর্থাৎ হিসাব দাঁড়াল এনডিএ ১৫, ইন্ডিয়া জোট ৯টি।

আর মহারাষ্ট্র নিয়ে বিজেপি যে খেলাধুলা করেছে তার ফলও ভোগ করেছে। ২০১৯ সালে এই রাজ্যে বিজেপির ২৩ জন এমপি ছিলেন। সেটাই নেমে দাঁড়িয়েছে ৯টিতে। বড় জয় পেয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। ৪৮ আসনের মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের শিবসেনা সাতটি আসন এবং এনসিপির অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী একটি আসনে জয়লাভ করেছে। অন্য দিকে, ইন্ডিয়া জোটের কংগ্রেস পেয়েছে ১৩টি আসন, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ৯টি, শারদ পাওয়ারের এনসিপি সাতটি আসনে জয়লাভ করেছে।

মোদি-শাহর নিজের রাজ্যের ২৬টি আসনের মধ্যে ২৬টিতে বিজয়ী হবে এমন ঘোষণা দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু কংগ্রেস একটি আসনে জয়ী হয়েছে। সেখানে অনেকগুলো আসনে কংগ্রেস হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে। ২০১৪ ও ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের মতো ২০২৪-এর নির্বাচনে গুজরাট এবার বিরোধীশূন্য নয়। কন্যাকুমারীতে মোদির ৪৫ ঘণ্টার ধ্যানও রক্ষা করতে পারেনি বিজেপিকে। তামিলনাড়ুতে একটি আসনও পায়নি বিজেপি। আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে রীতিমতো শুইয়ে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। এ রাজ্যে ভোটের প্রচারে রাজ্যে ২৩টি সভা করেছেন মোদি। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ১৮ আসন থেকে কমে ১২টি হয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূলের ২২টি থেকে ২৯-তে উন্নীত হয়েছে।

লাদাখে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু হানিফা। এখানে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন দ্বিতীয়। আর তৃতীয় হয়েছে বিজেপি। ৩৭০ ধারা বাতিলের জবাব পেয়েছেন মোদি।

বিজেপি নয়, এনডিএ সরকার
নতুন সরকার গঠন করতে জোট সঙ্গীদের সমর্থন পেয়েছে বিজেপি। এর ফলে টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএর সব দলের পক্ষ থেকে তাদের সমর্থন নিশ্চিত হয়েছে বলে দলটি ঘোষণা দিয়েছে।

অহঙ্কারী মোদি কখনো জোট সরকার চালাননি। গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল। এখন তাকে শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এখন তাকে হাত পাততে হচ্ছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের হবু মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর কাছে। তাদের সমর্থন ছাড়া মোদি সরকার গঠন করতে পারবেন না। চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি ১৬টি আর নীতিশের জেডি (ইউ) ১২টি আসন জিতেছে। নীতিশ ভারতের রাজনীতিতে ‘পাল্টু বাবু’ হিসেবে পরিচিত। ক’দিন আগেও তিনি বিজেপি বিরোধী ছিলেন। ইন্ডিয়া জোট গঠনে তার বিশাল ভূমিকা ছিল। মোদি সরকার বিরোধী ছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডুও। সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এবার লোকসভায় হেরে যাওয়া এই নেতা বুধবার বলেন, ‘নীতিশ এবং নাইডু বরাবরই পাল্টিবাজ। তাদের উপরে নির্ভর করা কতটা ঠিক হবে তা নিয়ে ভাবা উচিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।’

ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক সঞ্জীব শ্রীবাস্তব বিবিসিকে বলেছেন, নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু ছাড়া এই সরকার চলতে পারবে না এবং নীতিশ কুমার তো হাওয়ার দিক বদলের জন্য জোট বদলে ফেলেন। এই ক্ষমতার সমীকরণে তারা নিজেদের পাওনাগন্ডা বুঝে নেবেন।
মোদি তার ইচ্ছেমতো সরকার চালিয়েছেন। জোট সরকার মানেই অন্যদের কথা শুনতে হবে। এই মডেলে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই মোদির। ইতোমধ্যেই শোনা যাচ্ছে চন্দ্রবাবু নাইডু সমর্থনের বিনিময় কয়েকটি মন্ত্রী ছাড়াও স্পিকারের পদটি চেয়েছেন। নীতিশ কুমার কী চাইবেন সেটি এখন দেখার বিষয়। ছোট ছোট দল যারা একটি বা দুটি আসন পেয়েছে তারাও মন্ত্রী হতে চাচ্ছেন। মোদিকে তাদের দাবিও মানতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে এখন।

‘ইন্ডিয়া’ জোট কী করবে
তাড়াহুড়ো নয়, অপেক্ষা। লোকসভা ভোটে ভালো ফল করলেও বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সরকার গঠনের জন্য উপযুক্ত সংখ্যা নেই। তাই আপাতত ঐক্যবদ্ধ বিরোধী হিসাবেই লড়াই জারি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধী জোট। বুধবার ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক শেষে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে বলেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।’

লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement