দরকার কৃষি ও উৎপাদনমুখী খাতে বরাদ্দ বাড়ানো
- মো: মাঈন ঊদ্দীন
- ০৪ জুন ২০২৪, ০৫:৫৪
আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। চলতি বাজেটের সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাড়িয়ে আগামী বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ধরা হচ্ছে বলে খবর এসেছে।
এতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেয়ার কথা জানা গেছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার (পাঁচ লাখ কোটি টাকা) চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে মোট বাজেট ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে জোগান দেয়া গেলেও ঘাটতির বাকি ৩২ শতাংশের জোগান দিতে নেয়া হবে দেশী-বিদেশী ঋণ। এবারো বাজেটে রাজস্বপ্রাপ্তির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা থাকছে; সাথে যোগ হচ্ছে ব্যয় সঙ্কোচন নীতি, যে কারণে এবার বাজেটঘাটতি সামান্য কমার আভাস পাওয়া গেছে। কিছুটা কমলেও আয়-ব্যয়ের ঘাটতি এখনো বিপুল। ঘাটতি পূরণে বিকল্প কম, সেই ঋণনির্ভরতাই প্রধান সমাধান। এবারো অপেক্ষাকৃত কম সুদের বিদেশী ঋণের পরিবর্তে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি সুদের ঋণের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলতে থাকায় তা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ নেয়ায় তারল্য সঙ্কট পরিস্থিতিও দেখা দিয়েছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বারবার চাপের মুখে পড়ার কথা বলে আসছেন তারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ভর্তুকি কমানো উচিত। বাজেটে ঘাটতি বেশি হলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। ফলে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। আবার দেশের রিজার্ভ কম থাকায় অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যাচ্ছে। সেটি দেশী হোক আর বিদেশী হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের বেশির ভাগ খেয়ে ফেলছে। সুতরাং বাজেটে এসব বিষয় ভারসাম্য থাকা চাই।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে এবারের বাজেটে আগের বছরের তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ কমে যাচ্ছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বা ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। জানা গেছে, বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা অর্থবছর শেষে আরো কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত ২২ শতাংশ। বর্তমানে মোট ঋণের ৬৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে, ৩৩ শতাংশ বিদেশী ঋণ। ঘাটতি পূরণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশী ঋণ ও অনুদান থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হলেও আগামী বাজেটে তা আরো বাড়িয়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এখানে অনুদান বাবদ ধরা হচ্ছে চার হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেট হিসাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে আগামী অর্থবছরে বিদেশী ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাজেটসংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে বিদেশী ঋণ পরিশোধ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধরা হলেও আগামী বাজেটে তা ধরা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ধরা হলেও নতুন অর্থবছরে ধরা হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশী ঋণের হার কমলেও দেশী উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে ৯ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আভাস মিলছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এবারেও ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। যেখানে সুশাসন বা কৃচ্ছ্রসাধন বা ব্যয় সাশ্রয়ের বিষয়টি অনুপস্থিত। তার বিপরীতে উচ্চাভিলাষী বাজেট দেয়া হচ্ছে এবং খরচ বাড়ানো হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন কেনাকাটায় খরচ বাড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না, যে বছরের প্রকল্প সে বছরেই শেষ করা উচিত। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে খরচ বাড়ানো ঠিক না।
অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়িয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ দিতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। বর্তমান অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক নি¤œমুখী। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। বেড়েছে মানুষের কষ্ট। বৈদেশিক মুদ্রার পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। শুধু ডলারের কারণে নড়বড়ে হয়েছে অর্থনীতির অনেক সূচক। ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি করলেও তা কমছে না।
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে অর্থনীতির সূচকগুলো খারাপ হতে থাকে। ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতির খাতগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম জবাবদিহির ঘাটতি, অর্থপাচার ও শৃঙ্খলাহীনতার কারণে মূল কাঠামোগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা ২০২২ সালের এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.২৯ শতাংশ গত এপ্রিলে তা বেড়ে হয়েছে ৯.৭৪ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে জনগণকে স্ব^স্তি দেয়ার জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ জোরদার করা উচিত। উৎপাদনমুখী খাতগুলোর প্রতি জোর দেয়া উচিত। তাই কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি ও রফতানিমুখী খাতগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সহজে ও দ্রুত উৎপাদনমুখী প্রকল্প বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। জানা গেছে, আগামী বাজেটে এডিপিতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য সব মিলিয়ে ৭৬৬টি নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ৬৮২টি প্রকল্পকে ‘উচ্চ’ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮২টি প্রকল্পকে মধ্যম এবং ১৪টি প্রকল্পকে নিম্ন অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। তবে দেখা উচিত এসব প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণ সরাসরি উপকৃত হবে কি না। বর্তমানে অর্থনীতিতে সঙ্কট আছে। রাজস্ব আদায়ও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হচ্ছে না। তাই এসব প্রকল্প কোনোভাবে কোনো উচ্চ অগ্রাধিকার হতে পারে না। যেখানে ২৭০ কোটি টাকা কর্মসংস্থান ব্যাংক ভবন নির্মাণ ও ১১৫ কোটি টাকার মিরপুর তাঁত বোর্ড কমপ্লেক্স নির্মাণ ও সরকারের উচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। অথচ এডিপির প্রায় পুরো অর্থই আসবে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের মাধ্যমে। অর্থনীতির ভালো সময়ে ভবন নির্মাণ প্রকল্প করা জরুরি, সার্কিট হাউজ ও সরকারি কর্মচারীদের ফ্ল্যাট না দিলেও কোনো ক্ষতি নেই।
এখন প্রয়োজন সঙ্কট উত্তরণ হবে, উৎপাদন বাড়বে, রফতানি বাড়বে এমন খাতগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ওপর বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। শিক্ষা খাতে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম স্বচ্ছতার সাথে তদারকি করে গবেষণা প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এই মুহূর্তে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে প্রবৃদ্ধি অর্জনে কোনো ধরনের লাভ হবে না। চলতি অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি ৬.৫০ শতাংশ ধরা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্য মাত্রার মধ্যে আনা সম্ভব নয়। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৬৭ শতাংশ। আগামী অর্থ বছরের মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ ধরা হবে বলা হচ্ছে। যা অর্জন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড়ো হচ্ছে। এই অর্থনীতির আকারকে এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের লেনদেনের জন্য আর্থিক খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাজেটের বরাদ্দ থাকা উচিত। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ভারসাম্যপূর্ণ কার্যকরী বাজেট সবার প্রত্যাশা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা