২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সমমান নিয়ে কিছু কথা

ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সমমান নিয়ে কিছু কথা - নয়া দিগন্ত

দুই বছর বা তার বেশি সময় কর্মরত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সমমান মর্যাদা দিতে যাচ্ছে সরকার। এ নিরিখে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড)। আর সদস্য সচিব করা হয়েছে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের উপসচিবকে (কারিগরি শাখা-৩)। এছাড়াও কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- যুগ্ম সচিব (কারিগরি অধিশাখা-২) এবং বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রমুখসহ প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য (সদস্যদের সম্মতিক্রমে) করা যাবে।

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের কারিগরি শাখা-৩ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ডিপ্লোমা-প্রকৌশলীদের মধ্যে দুই বছর বা তার বেশি সময় কর্মরত বা কাজের অভিজ্ঞতা থাকাদের বিএসসি (পাস) সমমান মর্যাদা দেয়ার বিষয়ে সরকার কমিটি গঠন করেছে। জরুরি সভা করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় মতামত ও সুপারিশ দিয়ে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর জমা দিবে এ কমিটি (১৮ এপ্রিল-২০২৪, নয়া দিগন্ত)।

শিক্ষার্থীদের ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনে চার বছর মেয়াদে মোট ১৪৩ ক্রেডিটের ওপর একাডেমিক কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। প্রত্যেক বছরে দু’টি মিড এবং দু’টি সেমিস্টার ফাইনাল অর্থাৎ চার বছরে মোট আটবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণসহ উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও পৃথক ও আলাদাভাবে সিলেবাসে নির্ধারিত একাডেমিক বিষয়ে ও ব্যবহারিক ক্লাসে ন্যূনতমসংখ্যক উপস্থিতির পর শুধু পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ, অভ্যন্তরীণ ও বোর্ড নির্বাচিত পরীক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র যথাযথভাবে মূল্যায়ন এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে কেবল চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জিপিএভিত্তিক ফল ঘোষণা এবং ডিপ্লোমা পাসের সনদ ইস্যুর দায়িত্ব বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার।

অথচ এ ক্ষেত্রে দেশের সরকারি কারিগরি কলেজে ৭০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্যসহ নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে একাডেমিক বিষয় ও ব্যবহারিক ক্লাসের সময় ও সংখ্যা কমিয়ে কোনোভাবে সিলেবাসসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শিক্ষার্থীদের সনদ দেয়া হচ্ছে। কেবল একাডেমিক বিষয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান ঘাটতির কারণে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে দায়িত্ব সম্পন্ন করতে পারছেন না। এ কারণে আগে দেয়া পদমর্যাদা, আর্থিক সুবিধা ও বিল্ডিং কোড প্রভৃতি ক্ষমতা ছিনিয়ে নিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। দেশ ও বিদেশে কর্মক্ষেত্রের পরিধি ক্রমে ছোট হয়ে আসছে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য। সমস্যা সমাধানের উপুর্যপরি প্রতিশ্রুতি বারবার দেয়ার পরও বাস্তবায়ন হয়নি (১৬ ফেব্রুয়ারি-২০২৩, নয়া দিগন্ত)।
এ অবস্থায় ডিপ্লেমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সমমান মর্যাদা দিতে গঠিত কমিটিকে জরুরি সভা করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় মতামত ও সুপারিশ দিয়ে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।

অথচ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) একাডেমিক বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সুযোগ পায় শুধু ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর। দেশের ৪৯টি সরকারি এবং ২২০টি বেসরকারি কারিগরি কলেজ হতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা নির্ধারিত ৬০০ হতে ৭০০টি আসনের বিপরীতে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ভর্তির সুযোগ পান প্রত্যেক বছর। চার বছর মেয়াদে ১৫৮ ক্রেডিটের ওপর একাডেমিক কারিগরি বিএসসি (পাস) উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে প্রয়োজন- প্রতি ৬ মাসের জন্য দু’টি পরীক্ষা, যথা- ১টি মিড এবং ১টি সেমিস্টার ফাইনাল অর্থাৎ চার বছরে মোট ১৬ বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এ নিরীখে নির্ধারিত পাঠ্য বিষয় ও ব্যবহারিক ক্লাসে ন্যূনতম ৭০ শতাংশ উপস্থিতি থাকা বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক সেমিস্টারে কমপক্ষে ১৬ ক্রেডিট পেলে শুধু পরবর্তী সেমিস্টারে পড়ার সুযোগ মেলে। এ ছাড়াও টার্ম পেপার ও ফিল্ড গবেষণা বাধ্যতামূলকসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে কেবল চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা বিএসসি (প্রকৌশল) জিপিএভিত্তিক (পাস) সনদ অর্জনে সক্ষম হন।

ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট বিএসসি একাডেমিক কারিগরি বিষয়ে রুটিন অনুযায়ী পাঠদান এবং যথাযথভাবে মূল্যায়নসহ সব আনুষ্ঠানিকতা পালন শেষে শতভাগ প্রমাণের ভিত্তিতে সনদ বা মান দেয় ঢাকা প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়। এ ক্ষেত্রে কমিটি বিএসসি (উচ্চ শিক্ষায়) প্রকৌশলীদের একাডেমিক বিষয়ে জ্ঞানদান, মেধার উৎকর্ষসাধন ও যোগ্যতা অর্জনে নির্দিষ্ট পাঠদান, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ শেষে যথাযথভাবে মূল্যায়ন এবং টার্ম পেপার ও প্রকল্প গবেষণা প্রভৃতিতে কোনো ভুমিকা ও দায়িত্ব পালন করেনি বিধায় বিএসসি প্রকৌশলীদের একাডেমিক শিক্ষায় (পাস) সমমান মর্যাদা দেয়ার বিষয়ে সুপারিশ ও মতামত প্রদান সম্পূর্ণভাবে এখতিয়ারবহির্ভূত, অযোগ্য এবং অগ্রহণযোগ্য।

স্মরণ করা যেতে পারে- করোনা অতিমারীর জন্য এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল এ মর্মে জাতীয় সংসদে বিল পাস ছিল দেশে প্রথমবারের মতো অটোপাসের ইতিহাস। পরীক্ষার্থীদের একাডেমিক পাঠ্য বিষয়ে জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন ছাড়া এ পাস ঘোষণা করা হয়। এর পরিণাম হিসেবে ‘নবম শ্রেণীতে পড়তে হবে অষ্টমের পড়া’ (২৭ জুলাই-২০২২, প্রথম আলো)। আর ‘অটোপাসের সাড়ে তিন লক্ষ লাপাত্তা’ (৪ নভেম্বর-২০২২, নয়া দিগন্ত) প্রভৃতি দুঃখজনক চিত্র জাতির সামনে ফুটে ওঠে।

এ কমিটির সুপারিশে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সমমান দেয়া হলে- সনদধারীরা ডিপ্লোমার ঘাটতি জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা অথবা লাপাত্তা হবেন। স্মরণে রাখতে হবে- এরাও দেশের শিক্ষিত সন্তান। সম্মানজনকভাবে জীবন ধারণের অধিকার তাদেরও আছে। কখনো এভাবে সমাজ হতে ছুড়ে ফেলে দেয়া উচিত হবে না।

দেশের কর্মযজ্ঞের ৮৫ শতাংশ দক্ষ জনশক্তির তৈরির কারখানা, জাতীয় সম্পদের বেশির ভাগ বিনিয়োগ করা খাত এবং বিপুলসংখ্যক জনগণের কর্মসংস্থানে সুযোগ হয়েছে কারিগরি কলেজে। নানা দৈন্যতা ও সমস্যা এবং সরকারের অবহেলা প্রভৃতি কারণে এ খাত ধ্বংসের দারপ্রান্তে।

প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক একাডেমিক কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন এবং যুগোপযোগী প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা কার্যকরের মাধ্যমে উপর্যুক্ত সমস্যা সমাধানসহ পূর্বের স্বর্ণযুগ ফিরে পেতে নিম্নের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। যথা- ১. আধুনিক কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যবিষয় প্রবর্তন, ২. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা, ৩. অকেজো, পুরাতন, নতজানু ও দুর্বলের স্থলে আধুনিক কারিগরি শিক্ষা উপকরণের জোগান নিশ্চিত করা, ৪. জনশক্তি ও উপকরণের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ৫. অধ্যক্ষকে আহ্বায়ক করে প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধানের নেতৃত্বে দক্ষ, সাহসী ও দায়িত্বশীল শিক্ষকদের নিয়ে কমিটি গঠন। দুর্বল, অনিয়ম ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রভৃতি সমস্যা নিরসনে প্রয়োজনে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে এ কমিটি। কলেজ কর্তৃপক্ষের বহির্ভূত যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও শিক্ষামন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ করা।

লেখক : সরকারি কলেজের অধ্যাপক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement

সকল