২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মার্কিন প্রশাসনের ‘বাকস্বাধীনতা’র মুখোশ

মার্কিন প্রশাসনের ‘বাকস্বাধীনতা’র মুখোশ - ফাইল ছবি

ইউরোপ-আমেরিকা বাকস্বাধীনতার ‘ইজারাদার’ হিসেবে নিজেকে জাহির করে। বিশেষ করে আমেরিকা এ নিয়ে নানা দেশে ছড়ি ঘোরাতে পছন্দ করে। কিন্তু সেই আমেরিকা এখন উল্টো পথে হাঁটছে। নিজের দেশে বাকস্বাধীনতাকে গলা টিপে ধরার আয়োজন করছে।

গত সপ্তাহে ইসরাইল দেশটিতে সংবাদপ্রতিষ্ঠান ‘আলজাজিরা’কে নিষিদ্ধ করেছে। দেশটিতে কোনো কাজ করতে পারবে না সংবাদমাধ্যম ‘আলজাজিরা’। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়াামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাতারে এ প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র হলেও সারা বিশ্বে দর্শক রয়েছে। গাজায় ইসরাইলের ধারাবাহিক আগ্রাসন ও গণহত্যার খবর নিয়মিত বিশ্বের কাছে হাজির করছে এ প্রতিষ্ঠান।

নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ‘আলজাজিরা’। প্রতিষ্ঠানের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইল স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গাজায় বেছে বেছে সংবাদমাধ্যমের কর্মী এবং তাদের পরিবারের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে। সাংবাদিকদের হুমকি দেয়া হচ্ছে, গ্রেফতার করে রাখছে ইসরাইলের সেনারা। কিন্তু ভয় দেখিয়ে আলজাজিরাকে দায়িত্ব পালন থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না।’
দ্য ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন ইসরাইলের এ পদক্ষেপকে বলেছে, ‘গণতন্ত্রের জন্য অন্ধকার একটি দিন।’

এ দিকে আমেরিকায় টিকটক নিষিদ্ধ করেছে বাইডেন সরকার। মজার ব্যাপার হলো- এপ্রিল মাসে ইসরাইলের পার্লামেন্টে যখন আলজাজিরা নিষিদ্ধের উদ্যোগ চলছিল, তখন হোয়াইট হাউজ বলেছিল, এতে তারা ‘উদ্বিগ্ন’। এ নিয়ে ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর অব অ্যাডভোকেসি সেথ স্ট্রেন ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় গত সপ্তাহে একটি কলাম লিখেছেন। শিরোনাম ‘ইসরাইল ইজ ব্যানিং আলজাজিরা, আমেরিকা ইজ ব্যানিং টিকটক। উই নো হুয়াই’।

সেথ স্ট্রেন তার এ কলামে অনেক কিছু ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, জো বাইডেন ও তার প্রশাসন সম্প্রতি এমন কতগুলো সেন্সরশিপ আইন ও আদালতে চলমান মামলায় সমর্থন ও উৎসাহ দিয়েছে, যেগুলো কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য ‘কালো দিন’ নিশ্চিত করেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত দৃষ্টান্তটি হচ্ছে, গত মাসে জো বাইডেন টিকটক নিষিদ্ধ অথবা জোর করে বিক্রি করতে বাধ্য করার বিলে স্বাক্ষর করেছেন। ইসরাইল যেমন করে আলজাজিরা নিষিদ্ধ করেছে, ঠিক তেমন করে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি আসছে, এমন অপ্রমাণিত দাবির ওপর ভিত্তি করে বাইডেন প্রশাসন টিকটক নিষিদ্ধ করেছে।

আলজাজিরা বন্ধ ও টিকটক নিষিদ্ধ দুই আইনের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ মিল খোলাখুলিভাবে দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো, ইসরাইল-গাজা যুদ্ধে যে ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, সেটি থামিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা।

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধ করা শেষ ঘটনা নয়। এ আইন ভবিষ্যতে অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করার দরজা খুলে দিলো। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে পারে বিদেশী সাংবাদমাধ্যমগুলোর স্থানীয় শাখাগুলো। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি বলে মনে করেন।

সেথ স্ট্রেন আরো জানান, বাইডেন প্রশাসন অবশ্য এখানে থেমে থাকেননি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্প্রতি গোয়েন্দা কার্যক্রম ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইন রিফরমিং ইন্টেলিজেনস অ্যান্ড সিকিউরিং অ্যাক্টে (আরআইসিএএ) স্বাক্ষর করেছেন।

এ আইন অনুসারে সরকার, যেকোনো সার্ভিস প্রোভাইডার যারা তার অথবা ইলেকট্রনিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ অথবা মজুদের সাথে যুক্ত, বাধ্যতামূলকভাবে তাদের তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশের অধিকার পাবে। বিদেশী লক্ষ্যবস্তু নজরদারির জন্য এ আইন।
এ আইন পাসের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ে যে ঐকমত্য, সেটি উপেক্ষা করেছে। সিনেটর রন ওয়াইডেনের মতো আইনপ্রণেতাদের সতর্কবার্তাকেও তারা উপেক্ষা করেছে। রন ওয়াইডেন আরআইসিএএ নিয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, এ আইন পাস হলে সরকারের, ‘একজন কর্মচারী যে কিনা কোনো একটি কার্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নৈশপ্রহরী, তিনিও সার্ভারে ইউএসবি ডিভাইস প্রবেশ করানোর সুযোগ পাবে।’

আর সে কার্যালয় হতে পারে একটি সংবাদমাধ্যমের বার্তাকক্ষ। আরআইসিএএ হচ্ছে ফরেন ইন্টেলিজেনস সার্ভিলেন্স অ্যাক্টের সংশোধনী। এ আইন আগে থেকে সাংবাদিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার করা হতো।

প্রতিনিধি পরিষদে সম্প্রতি আরেকটি আইন পাস হয়েছে, যেখানে অর্থমন্ত্রীকে অবারিত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, অলাভজনক সংবাদমাধ্যমসহ যেকোনো অলাভজনক সংস্থার কর অব্যাহতির সুযোগ বাতিল করে দেয়ার। অর্থমন্ত্রী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থনদাতা সংস্থা’ বলে গণ্য করতে পারবেন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এর মধ্যে অবৈধ।
তাহলে নতুন করে এ আইন পাসের দরকার হলো কেন? তার কারণ হলো, একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হবে এবং কোন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের আওতায় আনা হবে, তার বিশদ বিবরণ সেখানে দেয়া হয়েছে।

আইনটি এমন একসময় পাস হলো, যখন কেন্দ্রীয় আইনপ্রণেতা ও রাজ্যপর্যায়ের অ্যাটর্নি জেনারেলরা সিএনএন, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও রয়টার্সের মতো প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের দিকে কটাক্ষ করে বলছেন, সেগুলো সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফিলিস্তিনি ফ্রিল্যান্সারদের কাছ থেকে তারা ছবি কিনছে কিংবা ইসরাইলের সমালোচনা করা হচ্ছে, এমন আধেয় কিনছেন।

কিছু কিছু বিশ্লেষক আগ বাড়িয়ে এটিও বলছেন যে, এ বিলে তাদের তালিকাবদ্ধ করা হোক, যারা আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট স্মরণ জোটের বিতর্কিত অ্যান্টিসেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষ সংজ্ঞা মেনে চলছে না। এ সংজ্ঞা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা গ্রহণ করেছে। ইসরাইলের সমালোচনা এ ক্ষেত্রে ইহুদিবিদ্বেষ বলে গণ্য হতে পারে।

সংবাদমাধ্যমগুলোকে নীরব করিয়ে দিতে এ বিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেবে। বিশেষ করে অলাভজনক সংবাদমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে সেটি বড় হুমকি। যদিও বাইডেন প্রশাসন এখনো নিশ্চিত করেনি, তারা নন-প্রফিট বা অলাভজনক সংস্থা সম্পর্কিত বিলটি সমর্থন দেবে কি না। কিন্তু প্রশাসন এর মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়, এমন সব সেন্সরশিপ আইনে স্বাক্ষর করেছে, যেটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

বাইডেন ও অন্যান্য ডেমোক্র্যাট নেতা অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসকের মতো আচরণ করবেন। আর বাস্তবে তারা এমন সব কাজ করছেন, যেটা কিনা নিপীড়নের জন্য ট্রাম্পের হাতকে শক্তিশালী করবে। নির্দিষ্টভাবে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে বলির পাঁঠা হয়ে উঠবে।

সেথ স্ট্রেনের দেয়া তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট, আমেরিকা সরকার চাইলে এসব আইনের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে গলা টিপে ধরতে পারে। টিকটক নিষিদ্ধের পেছনেও মূল কারণ ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ। টিকটকের মাধ্যমে গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার এমন সব ছবি প্রকাশিত হচ্ছিল যা আমেরিকার জন্য বিব্রতকর এবং হুমকি। আমেরিকা মানবাধিকার নিয়ে এতদিন যেসব বাগাড়ম্বর করেছে তা এখন তার জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকার ‘বাকস্বাধীনতার’ মুখোশও খুলে যাচ্ছে।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন


আরো সংবাদ



premium cement