স্মার্ট সুদহার মূল্যস্ফীতি কতটা সহনীয় রাখবে
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ২৭ মার্চ ২০২৪, ০৫:০১
২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক স্মার্ট সুদহার চালু করে। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির সিদ্ধান্তের আলোকে এটি চালু করা হয়। স্মার্ট সুদহারের সাথে ৩.৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি এক সার্কুলারে জানানো হয়েছে, মার্চ মাসের শুরুতে মার্জিন কমিয়ে স্মার্ট সুদহারের সাথে সর্বোচ্চ ৩.৫০ শতাংশ মার্জিন যোগ করতে পারবে। জুলাই মাসের প্রথম ভাগে স্মার্ট ছিল ৭.১০ সেই হিসাবে সুদের হার ছিল ১০.৮৫ শতাংশ, আগস্টে স্মার্ট রেট ছিল ৭.১৪ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৭.২০ শতাংশ, অক্টোবরে হয় ৭.৪৩ শতাংশ, নভেম্বরে ৭.৭২ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৮.১৪ শতাংশ, জানুয়ারি ২০২৪-এ ছিল ৮.৬৮ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে স্মার্ট রেট ১ শতাংশ বেড়ে ৯.৬১ শতাংশে উঠেছে। স্মার্ট হার প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত আট মাসে বাড়ে ২.৫১ বেসিস পয়েন্ট বা ৩৫.৩৫ শতাংশ। মূলত স্মার্ট রেট প্রতি ছয় মাসে ট্রেজারি ও বন্ডের গড় সুদহার বের করে হিসাব করা হয়। সেই হিসাবে মার্চের ঋণ বিতরণে স্মার্ট (সিক্স মানথস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল)-এর নতুন হার নির্ধারিত হয়েছে ৯.৬১ শতাংশের সাথে নতুন মার্জিন যোগ করে সর্বোচ্চ সুদহার ১৩.১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রি-শিপমেন্ট রফতানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে স্মার্ট সুদহারের সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ শতাংশ যোগ করে। এতদিন যা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর সাথে ১ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে এসএমই ঋণের বিপরীতে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে স্মার্ট (সিক্স মানথস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহারের সাথে সর্বোচ্চ ২.৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে আমানত নিতে পারবে আর সাড়ে ৫ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন সিদ্ধান্তে আমানত ও ঋণে ৫০ বেসিস পয়েন্ট মার্জিন কমল এনবিএফআই আমানত ও ঋণে। সে হিসাবে এ খাতে আমানতের সুদহার ১২.১১ শতাংশ এবং ঋণে তা ১৫.১১ শতাংশ। চলমান স্মার্ট রেট অনুসারে ব্যাংকসমূহের ঋণের সুদহার ১৩.১১ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণের সুদহার ১৫.১১ শতাংশ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা একে সমালোচনা করে স্মার্ট সুদহারকে আনস্মার্ট সুদহার নীতি হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই সুদহারের ভিত্তিতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়বেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, তারা ব্যবসায় করে দেশের বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, লাভের একটি অংশ ব্যাংকঋণ পরিশোধে প্রদান করেন। সুদের হার এভাবে বাড়তে থাকলে অনেক ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এতে ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন। যারা পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায় করতে গিয়ে খেলাপি হচ্ছে উভয়ের ক্ষেত্রে একই আইন থাকা ঠিক নয়। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আরো দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরীর মতে, ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধির কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হচ্ছে।
আবার ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কটের কারণে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে ডলার সঙ্কটের কারণে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার এলসি খুলতে গেলেও নির্ধারিত হারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে বেশি রেট নিচ্ছে। আবার সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট যেখানে ৩৫ শতাংশ ছিল তা এখন ২৫ শতাংশ ধরা হয়েছে যার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় করতে সমস্যা হচ্ছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রমান্বয়ে সুদহার বৃদ্ধির উদ্যোগ ভালো হলেও তা ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশ রক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রতিও নজর দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে এখানে সুদহার ১২ বা ১৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। আমানতের সুদের হার ও ঋণের সুদের হারের মধ্যে যৌক্তিকতা থাকা চাই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে এখন আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়ছে, এটি ঠিক সেটি সর্বোচ্চ ১২-১৩ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। এর চেয়ে বেশি হলে যেমন ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন, তেমনি ১৭-১৮ শতাংশ সুদের আমানত নিয়ে ব্যবসায় করলে সেই ব্যবসাও টিকবে না। এদিকে ব্যাংকগুলোতে চলছে বর্তমান ঋণ তীব্র তারল্য সঙ্কট। আমানত সংগ্রহের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারের অঙ্কের অনুপাতে ও মেয়াদের আলোকে ১২-১৩ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে আমানতের সুদহারের অফার অত্যন্ত গোপনীয় মাধ্যমে বলা হচ্ছে। এভাবে উচ্চ হারে আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো যেমন বিপাকে পড়তে পারে, তেমনি আমানতকারীরাও ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
আমানত ও ঋণের সুদহারের বিভিন্ন বাজারব্যবস্থা ও উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনের গতি-প্রকৃতি কাক্সিক্ষত না হলে জনদুর্ভোগ কমার পরিবর্তে আরো বাড়তে পারে। বাজারের সরবরাহের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোতে এখন ঋণের চেয়ে আমানত প্রবৃদ্ধি কম। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। করোনার কারণে বিগত দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় পাওয়ার ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেয়ার মতো তহবিল কমে এসেছে।
আবার শরিয়াহ-ভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকও তারল্য সঙ্কটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়ায় তারল্য সঙ্কট আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঋণগ্রহীতার কিস্তি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ঋণ আদায়ে ঘাটতি দেখা দিলে অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতি হারাতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ জানুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্যই ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। কিন্তু দেখা গেছে, নীতি সুদহারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চমূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। বিবিএস তথ্য থেকে দেখা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে (২০২৪) একটু কমলেও খাদ্য বহির্র্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে।
জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫৬ শতাংশ, ডিসেম্বরে ছিল ৯.৫৮ শতাংশে। জানুয়ারিতে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৫২ শতাংশ । মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়ে যায়। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সাথে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে, দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ লম্বা সময় ধরে দেখা যাচ্ছে। এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব আছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে।
এ চাপ সামাল দেয়া সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। মূল্যস্ফীতির সাথে অর্থনীতি জড়িত। এ ক্ষেত্রে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুব একটা সফল নাও হতে পারে। মুদ্রানীতির সাথে ফিসকেল পলিসির সংযোগ সাধন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষকের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্যই দরকার সুশাসন, সঠিক ও সময়মতো সংস্কার এবং রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা