২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

লাহোর প্রস্তাব : বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ

লাহোর প্রস্তাব : বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ - ফাইল ছবি

২৩ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব দিবস। এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ১৯৪০ সালের আজকের এই দিনে পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে ও তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ দলীয় প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রস্তাবেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে ভারতবর্ষের মানচিত্র পরিবর্তনকারী ও মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণী যে যুগান্তকারী ও দূরদর্শী প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল সেটাই ছিল বর্তমান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।

অধুনা অসাম্প্রদায়িকতার ফেরিওয়ালা বহু বিজ্ঞজনেরাই লাহোর প্রস্তাবকে নিতান্তই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভাগবাটোয়ারার ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে উড়িয়ে দিলেও, বস্তুনিষ্ঠ প্রকৃত ইতিহাস কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয় না। কেননা, কিছুকাল পূর্বেও এই উপমহাদেশের রাজনীতি-সমাজনীতি আবর্তিত হতো সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, এমনকি তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ায়, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই যে এই ভূখণ্ডটি গঠিত হয়েছিল সে কথা ইতিহাস স্বীকৃত। একটি কথা বলাই বাহুল্য যে, তখনকার সময়ের মুসলমানরাই শুধু ভারত বিভক্ত করে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা চায়নি, মুসলমানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তখন বাংলার নিম্নবর্গের হিন্দুরাও ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।

ঠিক কোন কোন কারণে আমাদের পূর্বপুরুষরা সে দিন ‘বাঙালিত্ব’ ঝেড়ে ফেলে উপমহাদেশের মুসলমানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মুসলিম আবাসভূমি গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন সেটা জানতেই কিছুটা পিছনে ঘুরে আসা যাক।

৭১২ সালে বিখ্যাত সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতে মুসলিম শাসনের যে বিজয় সূর্যটি উদিত হয়েছিল, ১৭৫৭ সালে বাংলায় ব্রিটিশদের ক্ষমতা গ্রহণে তা মধ্যগগন থেকে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে এমনকি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পরে মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের রিক্ত-সিক্ত নয়নে রেঙ্গুনে নির্বাসনের মাধ্যমে অস্তমিত হয়ে গোটা ভারতীয় মুসলমানদের জীবনে গভীর অন্ধকার ছেয়ে আসে। সদা বিদ্রোহী বাঙালি মুসলমানদের ‘বুলগাকপুর’ নগরীতে তখন বিদ্রোহের ছিটেফোঁটা তো দূর বাত, সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় নিজের পরবর্তী প্রজন্মের টিকে থাকাই ছিল দুষ্কর। কেননা, ব্রিটিশ অপশাসন ও বর্ণহিন্দুদের শোষণে ১৭৭০ সালের কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে না খেতে পেরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল যাদের অধিকাংশই ছিল বাঙালি মুসলমান ও দলিত-অচ্ছুৎ হিন্দু।

ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মনীষী আবুল মনসুর আহমদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের ১২৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তৎকালীন বাংলার জমিদার ছিল হিন্দু-প্রজা মুসলমান, মহাজন হিন্দু-খাতক মুসলমান, ডাক্তার হিন্দু-রোগী মুসলমান, উকিল হিন্দু-মক্কেল মুসলমান, হাকিম হিন্দু-আসামি মুসলমান, অফিসার হিন্দু-ঝাড়ুদার মুসলমান...।’

বাঙালি মুসলমানদের সেই কঠিন দুঃসময়ে বাঁচার শুধু একটিমাত্রই পন্থা ছিল, মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি তৈরা করা, যেখানে তারা জীবনের নিরাপত্তা, পরিপূর্ণ মৌলিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ভোগ করতে পারবে। ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি শুধু যে উপমহাদেশের মুসলমানদেরই জনজীবনেই নরকযন্ত্রণার সৃষ্টি করেছিল তাই নয়, রাজক্ষমতার সুবিধা ও উচ্ছিষ্টভোগী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারের স্টিমরোলারে তখন নিম্নবর্গের হিন্দুদের জীবনও ছিল ওষ্ঠাগত।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সে দিন বাংলা ও আসামকে নিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব করলে, এ অঞ্চলের তফসিলি হিন্দুরাও তাদের কিংবদন্তি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেননা, মুসলিম ও তফসিলি হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের টিকে থাকার জন্যই তখন বর্ণহিন্দুদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। বরিশালের পিরোজপুরের এক জনসভায় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সে সময়ের পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করার কারণ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তফসিলি সমাজ ও মুসলমান সমাজের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উভয় সম্প্রদায়ের খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণও প্রায় একই। এই দুই সম্প্রদায়ের সাথে বর্ধিষ্ণু হিন্দুদের কোনো মিলও নেই, সম্পর্কও নেই।’ যোগেন বাবু অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলতে লাগলেন, ‘বর্ধিষ্ণু হিন্দুরাও এতকাল ধরে তফসিলিদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে, তারা মুসলমানদের ওপরও সমান অত্যাচার করেছে। কুকুর-বিড়ালের মর্যাদাও তারা তফসিলি কিংবা মুসলমানদের দেয়নি। এই অত্যাচারের হাত থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি পাওয়ার জন্যই তফসিলিদের পাকিস্তান চাইতে হবে।’ (সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে : অন্তরালের শেখ মুজিব। লেখক, কালিদাস বৈদ্য। লেখক নিজেই ওই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন)।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমি
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
গুলামের প্রথম সেঞ্চুরিতে সিরিজ জিতলো পাকিস্তান রাঙ্গামাটিতে বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের বাস উল্টে আহত ১৯ ইরানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে দেবে না ইসরাইল : নেতানিয়াহু অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংখ্যালঘুরা আগের চেয়ে নিরাপদ মনে করেন রাঙ্গামাটিতে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ১ ট্রাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন পুতিন মিয়ানমারের এক মহাসড়কে ১০ মাসে দুর্ঘটনায় নিহত ৮২ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া নিরপেক্ষ ইসির পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় : ড. বদিউল ঈশ্বরগঞ্জে টিসিবির উধাও হওয়া সেই ডাল উদ্ধার গণতন্ত্রের জন্য দেয়া রক্তের সাথে বেঈমানি করা যাবে না : নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহে কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে

সকল