পুঁজিবাদের দুষ্টচক্র : গ্রামীণ সভ্যতায় অবক্ষয়
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৪:২৭
আমরা বর্তমানে এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যে সমাজ তার প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে নব্যরূপ ধারণ করেছে। আজকের সমাজে আবেগ নেই, সহানুভূতি নেই, হৃদয়ের মেলবন্ধন নেই, পারস্পরিক সহানুভূতির জায়গা দখল করেছে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা খুব দ্রুতই সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন আর গ্রামীণ সভ্যতায় প্রাণ নেই, সরসতা নেই। রাখালের কণ্ঠে এখন আর প্রেম-বিরহের সংমিশ্রণে বিচ্ছেদ গানের সুর শোনা যায় না। ভাটিয়ালি, জারি-সারি অনেক আগেই দূর হয়ে গেছে। ঈদ-পূজা-পার্বণে কিশোর-কিশোরীর আনন্দ উল্লাসের ছিটেফোঁটাও নেই। বৈশাখী মেলায় গ্রাম্য ঐতিহ্যের বালাই নেই। এখন ১০ গ্রাম খুঁজেও একটি একান্নবর্তী পরিবার পাওয়া ভার। আগে সমাজ শাসনের ভার ছিল গ্রামের অভিজাত পরিবারের হাতে। যাদের মধ্যে শাসন ছিল, মান্যতা ছিল, সমাজগঠনের তাগিদ ছিল। আজ সেই জায়গাগুলো পুঁজিবাদের দুষ্টচক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যাদের অনেকের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা নেই বললেই চলে। যারা ছিল সমাজের একেবারেই নীচু স্তরের তারা এখন সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে। সম্মানহানির ভয়ে ঐতিহ্য ধারণকারী পরিবারগুলো অনেক ক্ষেত্রে নীরব হয়ে গেছে অথবা পুঁজিবাদের দুষ্টচক্রের সাথে পেরে না উঠে আপনা থেকেই অবস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এই সুযোগে আজকের সমাজজীবনে অনৈক্য, হিংসা, দলাদলি, কোন্দল, স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস ও চরম দুর্নীতি বিরাজ করছে। ফলে গ্রামীণ সমাজ সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে।
আমাদের সমাজনীতি-রাজনীতি-অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই মানহীনতার চিহ্নগুলো দৃশ্যমান। মাঝে মধ্যে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি এই সমাজটি রসাতলে নিয়ে যাওয়ার জন্য কে বা কারা দায়ী? কখনো ভাবি রাজনীতিকরা, কখনো ভাবি সাংবাদিকরা, কখনো ভাবি সাংস্কৃতিককর্মীরা, কখনো ভাবি সুশীলসমাজ নামধারীরা। তবে এটি সত্য, সমাজ ধ্বংসের পেছনে সবারই কমবেশি দায় আছে। সাংবাদিক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবী যাদের সমাজের আয়না হিসেবে কাজ করার কথা তারা বিবেকের জায়গা থেকে সেই কাজটি করতে পারছেন না। নগদ অর্থের কাঁচা গন্ধ তাদের বিবেককে ঘোলা করে দেয়। নগদ অর্থ ঘুণপোকার মতো তাদের মস্তিষ্ক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। এই সুযোগে এমন কিছু লোক সামনে চলে আসে যারা আদৌ সভ্য কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন রয়ে যায়। বিবেকের দায় সেখানে কাজ করে না। এখানে চলে পুঁজিবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ। পুঁজিবাদের নগ্ন থাবায় সহজেই পরাভূত সমাজের আয়নাগুলো যখন অমসৃণ হয়ে যায়, সেই সুযোগে নিম্নরুচির লোকগুলো, সমাজনীতি বলি, রাষ্ট্রনীতি বলি- সব জায়গায় ঢুকে পড়ছে এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য যা যা করার সবই করছে। ফলে সত্যিকারের সুসভ্যরা লজ্জায় সব ধরনের পরিচালনা নীতি থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে ফেলছে।
রাজনৈতিক দৈন্য সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। জোর করে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দিচ্ছে। সমাজব্যবস্থার ঐতিহ্য ভেঙে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলতে বাধ্য করছে। জবাবহীন শাসনব্যবস্থায় অতি সাধারণ কর্মীও টাকার পাহাড় বানিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রগুলোকে এতটাই ভোঁতা করে ফেলেছে যে, তারা সমাজকে রক্ষা করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করছে। অর্থাৎ তারাও অর্থ-বিত্তের পাহাড় বানানোর প্রতিযোগিতায় উঠে পড়ে দুর্নীতির অভয়ারণ্য গড়ে তুলছে। দুর্নীতি আজ রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্মীয় ও ব্যক্তিজীবনের সর্ব ক্ষেত্রে বিরাজ করছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তা থেকে বাদ যায়নি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবলে আজ বিপন্ন সমাজ ও মানবসভ্যতা।
দুর্নীতি আজ থেকে নয়, বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। কিন্তু পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশের কারণে আজ যত দ্রুতগতিতে এর বিস্তার ঘটছে, আগে ততটা ছিল না। দুর্নীতির বদৌলতে খুব সামান্য ব্যক্তিও অল্প সময়ে প্রচুর অর্থ-বৈভবের মালিক হয়ে যাচ্ছে। সে সমাজের বাকিদের খুব একটা পাত্তাও দিতে চায় না। রাষ্ট্রও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যার কারণে দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্র বারবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। এমনকি দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠানও বলতে বাধ্য হচ্ছে, ‘দুর্নীতিবাজরা অনেক বেশি ধূর্ত ও শক্তিশালী; অনেক প্রভাবশালীও বটে।’ যারা এমনটি বলছেন তাদের মধ্যেও দুর্নীতির রাঘববোয়াল আছেন। যাদের নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা অনেকেরই নেই। তাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে কাজ করেন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও আমলা। বর্তমানে আমাদের দেশে একটি সরকারের অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় থাকার মনোবৃত্তি রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করছে এবং সমাজের নৈতিক কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- গণতন্ত্র ছাড়া মানব উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা অসম্ভব। গণতন্ত্রবিহীন সমাজে সুশাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সুশাসন না থাকলে প্রতিষ্ঠিত আইনি কাঠামো ভেঙে দুর্বৃত্তরা রাষ্ট্র ও সমাজের শাসনভার গ্রহণ করবে, এটিই স্বাভাবিক। আজকের বাস্তবতায় সেটিই হচ্ছে।
সমাজ সভ্যতা বদলে যাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের একনায়কোচিত শাসনব্যবস্থা দায়ী। আবার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া যার মাধ্যমে সমাজের চিত্র সামনে উঠে আসবে সেগুলোর স্বাধীনতাও ক্ষমতার ভাগীদারদের কব্জায়। যার কারণে একজন সৎ সাংবাদিকের পক্ষেও দুর্নীতি কিংবা অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয় না। কিন্তু এটিও তো সত্য, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ অসম্ভব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজকের দিনে দেশের একজন মানুষও বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
রাজনীতির দুষ্ট ছোবল বিচারব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে ফেলেছে। বিচারব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্ষমতাবানদের নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির চিত্র পরিলক্ষিত হয়। অথচ একটা সময় গ্রামীণ বিচারব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আস্থা ছিল অনেক বেশি। এর জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অপশাসন ও পুঁজিবাদের দুষ্টচক্র। পুঁজিবাদের দুষ্টচক্রের কারণে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ রাতারাতি ধনী হওয়ার বাসনা থেকে দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই প্রবণতা অল্প সময়েই সমাজের চিত্র পাল্টে ফেলেছে। সমাজবিজ্ঞান এটিকে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখে। হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক জোসেফ নাই ১৯৬৭ সালে আমেরিকান পলিটিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত ‘করাপশন অ্যান্ড পলিটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট : এ কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস’ শীর্ষক আর্টিকেলে উল্লেøখ করেন: ‘বিশেষ করে একটি নতুন রাষ্ট্রে জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘুষ ও দুর্নীতি, যা আগাছার মতো সব ভালো গাছকে মেরে ফেলতে চায়; অথবা অন্য ভাষায় বলতে গেলে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মানুষের সদিচ্ছাকে নষ্ট করে এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর সব নীতিও নস্যাৎ করে দেয়।’
অনৈতিক উপায়ে অর্জিত অর্থই সমাজের গতি ঠিক করে দিচ্ছে। সহজ করে বলতে গেলে সমাজে অর্থের এতটা অন্তর্মুখী সরবরাহ গ্রামীণ ইতিহাসে বর্তমানের মতো আগে তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থনীতির এই বিকাশ শত বছরের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোকে যেমন নাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি ক্ষমতা-কাঠামোর এই ভাঙনে প্রায় অনৈতিক উপায়ে অর্জিত সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার ও প্রসারের অনিবার্য প্রভাব সামাজিক মূল্যবোধ এবং ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে আমাদের সমাজব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ।
সমাজের এই অবক্ষয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এক সময় গোটা কাঠামোটাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য সমাজ রেখে যাওয়ার জন্য আমাদের সন্তানদেরকে অবশ্যই সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। রাষ্ট্রকাঠামোয় জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। গণতন্ত্র ও জবাবদিহি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা, সব মতবাদ প্রচার করার সমান সুযোগ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামোয় সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে, গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা ছাড়া সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, আমরা যদি পুঁজিবাদের দুষ্টচক্র নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি এবং দুর্নীতি রুখতে না পারি তাহলে শুধু গ্রামীণ ও সামাজিক সভ্যতাই বিনষ্ট হবে না; বরং রাষ্ট্রকাঠামোকেও ভেঙে তছনছ করে দেবে। রাষ্ট্র ও সমাজকে এই দৈন্য থেকে বাঁচাতে পারেন কেবল একজন সৎ শাসক, যিনি উদার গণতন্ত্রে বিশ^াস করেন। কারণ, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তাই প্রদান করে না, সেই সাথে এটি আইনের শাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, কথা বলার স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোকে একটি মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত করে। কাজেই সময় থাকতে আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা