পাকিস্তানের নির্বাচন: কারচুপি ও অনুশোচনা
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০২ মার্চ ২০২৪, ০৬:৪৪, আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪, ০৬:৪৪
আজকের বাংলাদেশ-ভারত-ও পাকিস্তান তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের আগ পর্যন্ত এই তিন রাষ্ট্রের ভূ-খণ্ড ব্রিটিশ-ভারত হিসেবে পরিচিত ছিল। মুঘল ও নবাবি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য গেড়ে বসেছিল এই ভূ-খণ্ডে। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত এই বিরাট ভূ-খণ্ড ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামের দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। প্রায় এক হাজার ২০০ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দু’টি অঞ্চল, আজকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সমন্বয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল। যার বাংলাদেশ অংশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান অংশের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সঙ্কট পাকিস্তানের দুই অংশকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে। মূলত রাজনৈতিক সঙ্কট থেকেই বাকি সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এসব সঙ্কটকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে তিক্ততার সূত্রপাত হয়েছিল এবং এই তিক্ততার সূত্র ধরেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস পর যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে, পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে।
১৯৪৭ সালের পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট এতটা প্রকট যে, সেখানে কোনো নির্বাচিত সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। বারবার সেনাবাহিনী হয় ক্ষমতা দখল করেছে নতুবা তাদের কারণে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সেদেশে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। তাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট আগের মতোই আছে। তেমনি পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেরও প্রায় শুরু থেকেই রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সর্বশেষ ইমরান খানের সরকারকেও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। ইমরান খান যিনি ক্রিকেটার থেকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। ক্রিকেটার থেকে রাজনৈতিক বনে গিয়ে সর্বোচ্চ চূড়ায় যেতে তাকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত হজম করতে হয়েছে। কিন্তু তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আরোহণপর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ ও পিপলস পার্টি তার উত্থানকে সামরিক শাসকদের প্রভাব বৃদ্ধিরই অংশ হিসেবে দেখেছিল। আবার তার ক্ষমতাচ্যুতির পেছনেও সেনাবাহিনীর সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককেই দায়ী করা হয়। যার খেসারত হিসেবে তার রাজনৈতিক দলের প্রতীক কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং ইমরান খানকে বিভিন্ন মামলায় সাজা দিয়ে জেলবন্দী রাখা হয়েছে। এমনকি তাকে পাঁচ বছরের জন্য পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইমরান খানকে জেলে বন্দী রেখে, তার দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে, মুসলিম লীগ এবং পিপলস পার্টি নির্বাচনে যে সুবিধা নিতে চেয়েছিল তা বুমেরাং হয়ে গেছে। বহু রকম কারচুপি সত্ত্বেও পিটিআই দলের নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বেশি সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ জনগণ সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও পিপিপিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছে। যদিও এই দুই দল মিলে ঐক্য করেই সরকার গঠন করছে। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট, পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ক্ষমতায় বসা ও ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। যার কারণে বলাই যায়, পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর যে সম্পর্ক, তা দেশটির রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালের দেশ স্বাধীনের পর থেকেই দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী এ ধরনের প্রভাব বিস্তার করে আসছে। আজকের দিনের বাস্তবতায় পাকিস্তানের অর্থনীতি চরমভাবে পর্যুদস্ত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিও ভয়াবহ, ক্রমাগত জঙ্গি হামলা চলছে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, বিভিন্ন রাজ্যে যেমন, বেলুচিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত বেলুচরা; এ পরিস্থিতির মধ্যে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে তার সমাধানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কতটা বিবেকের উদয় হবে তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
পাকিস্তান ক্রমাগত যে সহিংসতা ও রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার পরিসমাপ্তি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা অস্পষ্ট। তবে, এই রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণেই ১৯৭১ সালে একটি যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়ে, গণহত্যা সংঘটিত করে পাকিস্তানকে ভাঙতে বাধ্য করেছিল। সেই সময়েও ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছিল সেনাবাহিনী। তবে এটি সত্য যে, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে বিরাগভাজন করে কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়ে ইমরান খান যেমন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তেমনি সেনাবাহিনীর বদ নজর পড়ায় মেয়াদ শেষের আগেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তার পরও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইমরান খানের দল সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থেকেও নিজ শক্তি প্রদর্শনে এক বিন্দুও ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়; ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল সেই সত্যতা প্রমাণ করে।
ইমরান খানের দলের নেতাকর্মীদের ওপর নানা নির্যাতন, নিপীড়ন ও বহু নেতাকর্মীকে জেলে বন্দী রেখে, ভোটে নানা কারচুপি করেও জনগণকে ইমরানবিমুখ করা যায়নি। ২৬৪টি আসনের মধ্যে ৯৩টি আসনে ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। যেখানে সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র সমর্থন থাকা সত্ত্বেও নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ-এন পেয়েছে ৭৫টি আসন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন। যদিও সরকার গঠনের মতো ১৩৪টি আসন কেউ পায়নি। বড় ধরনের কারচুপি করেই যে ইমরান খানের দল পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজিত করা হয়েছে তা নির্বাচনের পরও অনেকেই জানিয়ে দিয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার লিয়াকত আলী খান চাতা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তুলে বলেছেন, নির্বাচনের ফল জালিয়াতিতে তিনিও জড়িত ছিলেন। তার দাবি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দেশের প্রধান বিচারপতিও এতে জড়িত ছিলেন। তিনি নির্বাচনের ফল জালিয়াতির ‘বন্দোবস্ত’ করে দেয়ার জন্য অনুতাপও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এ অপরাধের জন্য যা শাস্তি হয় মেনে নেবেন। তিনি বলেছেন, রাওয়ালপিন্ডির নির্বাচনী আসনগুলোতে যেসব প্রার্থী বড় ব্যবধানে জয়ী হচ্ছিলেন, সেসব প্রার্থীকে পরাজিত দেখানো হয়েছে। আর যেসব প্রার্থী হেরে যাচ্ছিলেন, তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
আর এ নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়; কারচুপি করে জেতানো হয়েছে অভিযোগ তুলে করাচির একটি আসনের বিজয়ী প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর নেতা হাফিজ নাঈম উর রেহমান সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে তাদের এই নজিরবিহীন প্রতিবাদ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। আজকের লেখার মূল কারণও এটি।
বর্তমানকালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ থাকলেও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ছিল না। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পরণতিতে পাকিস্তান বিভক্ত হয়। লেখার শুরুতে উল্লিখিত অন্যান্য কারণ থাকলেও মূলত ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জনগণের ম্যান্ডেট মেনে না নেয়ার কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে যাওয়া ত্বরান্বিত হয়েছিল। অথচ সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই বারবার জনগণের ম্যান্ডেট কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা হচ্ছে। পাকিস্তানে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশে এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে আমলা এবং পুলিশ বাহিনীকে। পাকিস্তানের নির্বাচনে কারচুপিতে সহায়তা করার অপরাধ স্বীকার করে অন্তত একজন কমিশনারের মনে অনুশোচনা হয়েছে এবং তিনি এই অপরাধের জন্য নিজের শাস্তিও চেয়েছেন। আবার একজন বিজয়ী প্রার্থী কারচুপির বিজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে বিবেকবোধ কাজ করেছে। ঠিক উল্টো চিত্র বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের বেলায়। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার কূট-কৌশলের ভাগীদার নির্বাচন কমিশনের অন্তত একজনের মধ্যেও যদি অপরাধবোধের কারণে একটু অনুশোচনা বোধ জন্ম নিত, হয়তো এই জাতি কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বাঁচত।
রাজনীতির দুর্দশার চিত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে যে মামলায় সাজা দিয়ে জেলে বন্দী রাখা হয়েছে, একই ধরনের মামলায় নওয়াজ শরিফ দায়মুক্তি পেয়ে রাজনীতির উন্মুক্ত ময়দানে বিচরণ করছেন। বাংলাদেশের চিত্র এর ব্যতিক্রম নয়। একই মামলায় একজন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে চার দেয়ালে বন্দী, অন্যজন দায়মুক্তি নিয়ে বছরের পর বছর জনগণের ম্যান্ডেটের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করছেন। বিচিত্র দেশ ! বিচিত্র নিয়ম! বোঝা বড় দায়!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা