২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পাকিস্তানের নির্বাচন, কিছু কি নেয়ার আছে

পাকিস্তানের নির্বাচন, কিছু কি নেয়ার আছে - ফাইল ছবি

কাগজ-কলমে এবং সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা থাকলেও পাকিস্তানে সেনাবাহিনীই শেষ কথা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন হলেও সরকারে কে বসবে, কতদিন থাকবে এবং কখন বিদায় হবে আর নতুন করে কে আসবে, সবটা সেনাবাহিনীর ইচ্ছাতেই হয়। ভারত ও অবিভক্ত পাকিস্তান একই সময়ে স্বাধীন হলেও কেবল সেনাবাহিনীর কারণেই পাকিস্তানে বারবার গণতন্ত্র পথ হারিয়েছে। এরপর দেশটিরই বিভাজন হয়ে গেল; আমরা নতুন দেশ পেলাম। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতি ও প্রশাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। রাজনীতিকরা সেটি এক-রকমের করে মেনেও নিয়েছেন। কোনো কোনো সরকারপ্রধান সেনা-নিয়ন্ত্রণ থেকে খানিকটা বেরিয়ে আসতে চাইলেও সফল হননি বরং ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।

এই মাসেই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দলই পায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত সরকার গঠিত হয়নি। এই নিয়ে নানা মেরুকরণ ও টানাপড়েন চলছে। যদিও এই মাসের শেষের দিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ৭৫টি, প্রয়াত জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছেলে-জামাইয়ের এজমালি পিপিপি ৫৪টি এবং জেলে অন্তরীণ ইমরান খানের দলীয় প্রার্থীরা স্বতন্ত্ররূপে ৯৩টি, কওমি মুভমেন্ট ১৭টি আসন পেয়েছে। বাকি ১০টি দলও ১৮টি আসন পেয়েছে। সাধারণ নির্বাচনপূর্ব প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার মেয়াদ পূর্তির আগেই আস্থাভোটে পা পিছলে পড়ে যান। এর নেপথ্যেও সেনাবাহিনীর হাত ছিল। সাথে আমেরিকাকে যুক্ত করা হয়।

একমাত্র সেনাবাহিনীর কারণে পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক সরকার পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। সেনাবাহিনী তাবৎ সুবিধা ভোগ করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির বিশালাংশের নিয়ন্ত্রক। তা সত্ত্বেও কোনো সরকার বা প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে চাইলেই তাদের সরিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইমরান খান রাশিয়ায় ছিলেন তেল ক্রয়সহ নানা আলোচনার জন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটিকেই নিশানা করে এবং তাতে আমেরিকাকে সহজেই পেয়ে যায়। ইমরান খানের পিটিআইয়ের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে আস্থাভোটে পাকসেনারা সরকারের শরিকদের ভাগিয়ে বা ভয় দেখিয়ে সহজেই ইমরান খানকে গদিচ্যুত করতে পেরেছে। ইমরান খানের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়ে, একাধিক মামলায় সাজা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে রেখেছে। ইমরানের দলকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে দলীয় প্রতীকও খেয়ে ফেলেছে। সব কিছুতেই পাকসেনাদের হাত রয়েছে।
পাকবাহিনীর মতলব ছিল ইমরান খানকে এবারের নির্বাচন থেকে দূরে রাখা।

নির্বাচনের সময়ে ইমরান খান জেলে। দলের প্রার্র্থীরা স্বতন্ত্ররূপে নির্বাচন করে নওয়াজ শরিফ ও বিলওয়াল ভুট্টো-জারদারির দলের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বেশি অবাক হয়েছে সেনাবাহিনী। পাকসেনারা একদা তাদের দ্বারাই গদিচ্যুত এবং দেশছাড়া নওয়াজ শরিফকে দেশে ফিরিয়েছে ক্ষমতায় বসাতে। তাদের হয়তো দ্বিতীয় অপশন ছিল পিপিপি। নির্বাচনে নানা প্রকারের ইঞ্জিনিয়ারিং করে শরিফের মুসলিম লিগকে জেতাতে বদ্ধপরিকর ছিল পাক সেনাবাহিনী। কিন্তু হিসাবে গোলমাল হয়ে গেছে। পাকবাহিনী ভেবেছিল, কিছুটা করলেই শরিফের দল এসে যাবে, সর্বত্র কারচুপির দরকার হবে না। আরো ভেবেছিল, নিষিদ্ধ ইমরানের দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাত্র কয়েকটি আসন পেতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের ভোটাররা ইমরানকেই বেছে নিয়েছেন। প্রকারান্তরে থুথু দিয়েছেন সেনাবাহিনীর গায়ে। নেতা জেলে। দল নিষিদ্ধ। নেই নিজেদের প্রতীক। তারপরও স্বতন্ত্ররূপে নির্বাচন করে সেনাবাহিনীর এক-রকমের প্রত্যাশিত ও মনোনীত নওয়াজ শরিফের দলের চেয়েও ১৮টি আসন বেশি পেয়েছে। নির্বাচনের পর নানা খবর থেকে দেখা যায়, আরো বহু আসনে ইমরান খানের স্বতন্ত্রীদের ফল পাল্টে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন না হলে ইমরানের দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত। নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি নিয়ে পাকিস্তানে হরদম মিছিল-মিটিং-প্রতিবাদ চলছেই।

পাকিস্তানে একই সাথে প্রাদেশিক পরিষদেরও নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতা হারানো ইমরানের দল প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনেও ভালো করেছে; হয়তো সরকার, নির্বাচন কমিশন, সেনারা সেখানে হস্তক্ষেপ করেনি।
বর্তমান পাকিস্তানের সাথে বহু বিষয়েই আমাদের মিল নেই। অনেক বিষয়েই ওদের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। ক্ষেত্রবিশেষে পিছিয়েও। সেসব রেখে এবারের নির্বাচনে কী দেখেছি, আলোচনা হোক বরং তা নিয়ে।

একজন মানুষের সব কিছু খারাপ হয় না। খারাপ মানুষের মধ্যেও কিছু ভালো গুণের দেখা মেলে, যা গ্রহণযোগ্য। দেশের ক্ষেত্রেও তাই। পাকিস্তানের নির্বাচনের সাথে আমাদের বড় অমিলটাই হচ্ছে, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর মাথা ঘামানো। পাকিস্তানের সরকার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ১০ বার ভাবে, সেনাবাহিনী ব্যাপারটি কিভাবে নেবে। আদপে ওখানে সরকার সেনাবাহিনীর ক্রীড়নকমাত্র। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালে পাকিস্তানে নির্দলীয় সরকার থাকে; তবে সেটিও ওই সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহই। এসব বিবেচনায় নিয়েও কয়েকটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে। এসব থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার থাকতে পারে।

একটু নিজের ঢোল বাজানো যাক। ২০১৪ সালে (এই কাগজে প্রকাশিত) ‘সংবাদ যখন প্রণব আর শরিফকে নিয়ে’ নিবন্ধে তিনটি বিষয়ের অবতারণা করেছিলাম। এক. ভারতের প্রেসিডেন্ট জাতীয় নির্বাচনে ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বলেছেন, ভোট দিলে একটি দলের পক্ষে যাবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এটি করবেন না। তখন সাহস করে লিখেছিলাম, আমি ভোট দিই না এবং আমার সাথে আমাদের মহামান্য, মাননীয় প্রধান বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চেয়েছিলাম। বলেছি, এই তিনজন ভোট না দিলে কিছুই হবে না, কিন্তু পদের নিরপেক্ষতা শতভাগ নিশ্চিত হবে, যেটি প্রণব মুখার্জি বলেছেন। দুই. পরের প্রসঙ্গ পাকিস্তানের। পাকিস্তানের উচ্চ আদালত কয়েকজন নাগরিককে বিদেশে গচ্ছিত তাদের সম্পদ ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই তালিকায় সিটিং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও ছিলেন। তিন. বিল বকেয়া থাকায় সিটিং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সরকারি বাসভবনের গ্যাসলাইন কেটে দেয়া হয়েছে। তবে এ ঘটনাটি প্রতীকী ছিল কিনা তা যাচাই করা যায়নি।

পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচন থেকেও তিনটি বিষয় বলার আছে। তার আগে ছোট্ট একটি বিষয়। ও-বাংলার অভিনেতা দেব এবং অভিনেত্রী মিমি পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দু’জনই বিধানসভার নয়, পার্লামেন্টের বর্তমান সদস্য। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে নির্বাচন করলে পুনরায় জিতে দিল্লির টিকিট পেয়ে যাবেন বলেই সবার ধারণা। তা সত্ত্বেও নির্বাচন না করার কথা; যদিও দলীয় প্রধানের অনুরোধে দু’জনই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন বলেই মনে করা হচ্ছে। আমাদের এখানে? বয়স ৮০ কিংবা তারও বেশি, তারও নমিনেশন চাই-ই চাই। সাত-আটবার এমপি হয়েছেন, তিনিও কাউকে ছাড়তে নারাজ। এ যেন মৌরসি পাট্টা।

পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর আমির পদ ছেড়েছেন। দলটি নির্বাচনে ভালো করেনি বলে। এখানে কেউ পদ ছাড়বে কি? রেল দুর্ঘটনায় কিংবা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতায় কে কবে পদ ছেড়েছে! পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী থেকে মনোনীত হাফিজ নাইমুর রহমান জয়ী হন। কিন্তু দু’দিন পরই তিনি জানান, অন্য এক প্রার্থীকে (পিটিআইয়ের) জোর করে হারিয়ে দিয়ে তাকে জেতানো হয়েছে; ফলে তিনি এই ফলাফল তথা তার বিজয় নেবেন না। এই দেশে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েও এমনটি কেউ বলেননি। কথিত নৈশ নির্বাচনের এমপিদের একজনও বলেননি, এভাবে জিততে চাইনি, তাই শপথ নেবো না। হতেই পারে, তারা কেউই নৈশ নির্বাচন অভিধাটি মানছেন না। তৃতীয় উদাহরণটি হচ্ছে, রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার লিয়াকত আলী চাত্তা। মি. চাত্তা পুরোদস্তুর সংবাদ সম্মেলন করে জানান দিয়েছেন, তাকে দিয়ে অনেকগুলি আসনে অনিয়ম করে হেরে যাওয়া প্রার্থীকে জেতানো হয়েছে। দায় স্বীকার করে বিবেকের তাড়নায় তিনি শুধু পদত্যাগই করেননি, বলেছেন, তার শাস্তি হওয়া উচিত। বাংলাদেশের কোনো প্রশাসককে কি কখনোই এমন করতে হয়নি? কথিত নৈশ নির্বাচনের সবটাই কি উদ্ভট আর বানানো গল্প! স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও আমাদের প্রশাসকরা ঠিক ঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন? উত্তর হ্যাঁ-বোধক হলে তো আর লিয়াকত আলী চাত্তা হওয়ার আদৌ কোনো দরকার নেই।


আরো সংবাদ



premium cement