২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের দৃষ্টান্ত

বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের দৃষ্টান্ত - নয়া দিগন্ত

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনার মহাকাব্য। একুশে ফেব্রুয়ারি জাতির জীবনে চিরভাস্বর একটি দিন। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাঙালিদের আত্মত্যাগ কখনো ভুলবার নয়। শহীদদের রক্তস্নাত আর গৌরব গাথার অনন্য স্মৃতির দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিতে আবার এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি একই সাথে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি আজ নিজের দেশের সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্প্রসারিত হয়েছে। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয় একুশে ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস কারো দানে নয়; বরং প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ফসল। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বায়ান্নয় রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বীর বাঙালি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবদান সর্বজনবিদিত। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমাদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার চেতনা তথা স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও সূত্র অন্বেষণ করতে গেলে সবার আগে মনে আসে বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা। এর পরেই আসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর আবুল কাসেম ও তমদ্দুন মজলিসের ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম ভাষা আন্দোলনের কারণে কারাবরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ ভাষাসৈনিক। অন্যান্য ভাষাসৈনিকের মধ্যে তমদ্দুন মজলিসের আবুল কাসেম, অলি আহমদ, আব্দুল মতিন, গাজিউল হক, মো: তোয়াহা, নুরুল হক ভূঁইয়া, অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, বদর উদ্দীন ওমর, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, কামর উদ্দীন আহমেদ, বশির আল হেলাল, শেখ আমানুল্লাহ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. এস এম লুৎফর রহমান, ভাষা আন্দোলন গবেষক মোহাম্মদ আমীন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের গ্রন্থের লেখক এম আর মাহবুব প্রমুখ ব্যক্তির নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিদেশীদের মধ্যে প্রথম মত দেন ব্রিটিশ লেখক ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হলহেড। ১৭৭৮ সালে তিনি তার বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটিতে ওই অভিমত প্রকাশ করেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন রফিক উদ্দীন। পরে আরো শহীদ হন শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, রিকশাচালক আউয়াল, কিশোর অলিউল্লাহ, সিরাজ উদ্দীন প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, মাতৃভাষা রক্ষা আন্দোলনে খুলনা থেকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ নেতৃত্ব দিয়ে বন্দী হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সাতক্ষীরার বুধহাটার সন্তান ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন। তারা অনেকেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের বীর। তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধিকার, অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দেদীপ্যমান।
সর্বপ্রথম শহীদমিনার তৈরি হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতারাতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে, যেখানে ভাষার জন্য বাঙালির প্রথম রক্ত ঝরেছিল। সাড়ে ১০ ফুট লম্বা সেই প্রতীকটির প্রথম নাম ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। সেটি জনৈক পিয়ারু সরদারের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল।

২১ ফেব্রুয়ারি ও মাতৃভাষা ভাষা আন্দোলনের উপর বিভিন্ন গীতিকার এবং কবিদের গান ও কবিতার মধ্যে আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি...’, চারণ কবি শেখ শামসুদ্দিন রচিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি, ঢাকা শহরের রাজপথ রক্তে ভাসাইলি...’, আব্দুল লতিফের বিখ্যাত গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়...’, প্রতুল মুখোপধ্যায়ের কথা ও সুরে দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পী মিংজুর কণ্ঠে ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই...’, কবি ফররুখ আহমদের কবিতা ‘আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান, বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার রূপ যে অনির্বাণ...’, মাহবুব আলম চৌধুরী রচিত একুশের ঐতিহাসিক কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি...’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য চারণ কবির মধ্যে আব্দুল হাকিম, মোশারফ উদ্দীন, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ নাম স্মরণযোগ্য।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালের মার্চে। এর প্রকাশক ছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি মো: সুলতান ও সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ওই গ্রন্থে কবির উদ্দীন আহমদ ‘একুশের ঘটনাপঞ্জি’ নামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেন- ‘১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।’ তৎকালীন পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তার ‘পাকিস্তানস আদার স্টোরি : দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘পুলিশের গুলিতে ২৬ জন শহীদ ও ৪০০ জনের মতো আহত হয়েছিলেন।’
একুশ আমাদের শাশ্বত প্রাণের স্পন্দন। একুশ আমাদের বাতিঘর। ১৯৫২ সালের রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতিসত্তার চাবিকাঠি। ১৯৪৭-পরবর্তী জাতীয় জীবনে সব গণজাগরণ, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনার মূলে জড়িয়ে আছে ফেব্রুয়ারি স্মৃতি। এটি কোনো সাধারণ সন তারিখ নয়। এটি শোক, প্রেরণা, শপথ আর অঙ্গীকারের মিলিত স্রোতধারা। একুশের পথ ধরেই বাঙালি হেঁটেছিল স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার দিকে। পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে একমাত্র বাংলাদেশের মানুষ।

ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণফসল হলো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাঙালির আরেক বিজয়। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনেও রয়েছে দীর্ঘ সাধনা ও সংগ্রামের ইতিহাস। ‘The Mother Language Lover of the world’ নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আবেদন জানান। ওই আবেদনে ফিলিপিনো, ইংরেজি, ক্যান্টনিজ, মালয়, জার্মান, হিন্দি ও বাংলাভাষী অর্থাৎ সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০ জন স্বাক্ষর করেন। এর এক বছর পর ইউনেস্কো সদর দফতরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ রফিকুল ইসলামকে সম্মতিসূচক চিঠি লিখেন: Regarding your request to declare the 21 February as International mother language day, the idea is indeed very interesting. অবশেষে Bangladesh National Commission for UNESCO’র পক্ষে সচিব প্রফেসর কফিল উদ্দীন আহমদ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন।

ইউনেস্কোর ১৫৭তম অধিবেশন ও ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব ওঠে। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর ১৬০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে মতামত গড়ে তোলেন। ১৮৮টি দেশ ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনে সম্মত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) তার প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ১৬০তম ওই অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ ঘোষণায় বিশ্বের প্রায় আট হাজার মাতৃভাষা সম্মানিত হলো। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর সদর দফতরসহ পৃথিবীর ১৯৪টি সদস্য দেশে নিজ নিজ মাতৃভাষার আলোকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তাই বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবময় ও অবিস্মরণীয় দিন।

রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষা এক নয়। মাতৃভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ অর্জন করে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা দ্বারা, সাধনা দ্বারা, জ্ঞান-গরিমা নিয়ে অর্জন করতে হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে রাষ্ট্রভাষা সক্রিয় থাকে। চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষাকে বিকশিত করতে হয়। আর মাতৃভাষার চর্চা বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মাতৃভাষা দ্বারা জীবনটিকে বেশি উপভোগ করা যায়। আর মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই রাষ্ট্রভাষা গড়ে ওঠে। ভাষা-ই মাতৃভূমি। রাষ্ট্রভাষা শুধু সংবিধানে থাকলে হবে না, রাষ্ট্রীয় জীবনে সম্ভবপর সর্বস্তরে তার প্রকৃষ্ট ও জীবন্ত ব্যবহার থাকা দরকার। রাষ্ট্রভাষা তথা জাতীয় ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজন জাতীয় ভাষানীতি।

অনেকের ধারণা মাতৃভাষা পরিমণ্ডলের বাইরে বাংলা ভাষার ব্যবহার স্থায়ী হবে না। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো’ মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘মাতৃভাষাকে ছোট করা মানে নিজের মাকে ছোট করা’। সরোজিনী নাইডু বলেছেন, ‘মাতৃভাষা একটি জাতির হৃদয়, একজন মানুষের আত্মা’। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু ভাষায় পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের মাতৃভাষায় বাংলা চর্চা করতেন। তিনি জানতেন, মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনো ভাষা ভালোভাবে শেখা যায় না। মাতৃভাষা মানুষের একান্ত আপন ও কাছের। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার সেরা দান। মাতৃভাষার মর্যাদা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক।

মূলত ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা অনেকেই বাংলা ভাষাকে নিয়ে মাতামাতি করি। বাংলা যেন শুধু ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক না হয়। বাংলা ভাষার প্রতি চাই বছরজুড়ে ভালোবাসা। শুধু মুখে মুখে ভালোবাসা নয়; বরং সর্বক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে গুরুত্বসহকারে নিশ্চিত করা গেলেই বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব। বাংলা বাঙালির হোক, বাঙালির জয় হোক, বাংলার জয় হোক। আমরা বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করতে পেরেছি কিন্তু বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। সর্বত্র বাংলার ব্যবহার ও চর্চা সমুন্নত রাখাই হোক আমাদের কামনা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।


আরো সংবাদ



premium cement