দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও
- শিমুল বিশ্বাস
- ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:১০
এক.
হাজার বছরের অধিককাল এই জনপদে বসবাসকারী মানুষ একটি পৃথক স্বাধীন, সার্বভৌম ও নিরাপদ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের আকাক্সক্ষা কেউ অবদমিত করতে পারেনি। ইতিহাসের সাক্ষী এই জনপদের লড়াকু মানুষ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বশ্যতা কখনো মেনে নেয়নি। সেই আকাক্সক্ষা থেকেই ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বেঙ্গল জনপদের সাধারণ মানুষ বিপুলভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সারা দিয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সে লড়াইয়ে বাংলার নমঃশুদ্র আন্দোলনের নেতা যোগেন মণ্ডলের নেতৃত্বে তফসিলি সম্প্রদায়ও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়া মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীন হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি না দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির অক্টোপাসে আবদ্ধ করে।
পাকিস্তানের ২৩ বছর স্বাধীনতার জন্য গোপন ও প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, মোজাফফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ, ছাত্র সংগঠন, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন কাজ করে। অগ্রভাগে ছিল আওয়ামী লীগ। ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রাম ও যুদ্ধের পর ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ। উভয় দল মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে জনগণকে দেয়া ওয়াদা পূরণ না করে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়। দেশের শোষিত বঞ্চিত সাধারণ মানুষের ওপর জুলুমের অবসান ঘটানোর ওয়াদার কথা ভুলে যায়। উভয় দলই শোষিত ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষকে শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকারের সাথে প্রতারণা করে। প্রথমে ১৯৪৭-এ মুসলিম লীগ এবং দ্বিতীয়ত ১৯৭১-এ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা লাভের পর ক্ষমতাসীন হয়ে সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা পদদলিত করে।
মুসলিম লীগের ব্যর্থতার ওই পটভূমিতে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার পটভূমিতে বিএনপির জন্ম হয়। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ পরবর্তী শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতার পটভূমিতে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী রাজনীতি করার অঙ্গীকার নিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক অকুতোভয় জিয়া প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। সৎ নির্ভীক ও অসম সাহসী জিয়ার আদর্শে গঠিত বিএনপি সঙ্কটে, শান্তিতে ও সংগ্রামে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৪৫ বছরব্যাপী এ দেশের রাজনীতির মূলধারায় অবস্থান করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, জুলুম, নির্যাতন ও শত শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ অবধি বিএনপি দ্বন্দ্ব-বিভাজন-সঙ্ঘাতের বিপরীতে জাতীয় ঐক্যের পতাকা উড্ডীন রেখেছে। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-পেশা, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, পাহাড় ও সমতলের মানুষ মিলে এক অখণ্ড জাতিসত্তার ঐক্যের প্রতীক এখন বিএনপি। ধর্মীয় মূল্যবোধ সঞ্জীবিত রেখে বিএনপি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং জাতীয় ঐক্যের পক্ষে সব সময়। সমমর্যাদার ভিত্তিতে সবার সাথে বন্ধুত্ব চায় বিএনপি। কোনো দেশের অধীনতামূলক দাসত্ব নয়।
জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও দেশের সার্বভৌম মর্যাদা রক্ষায় বিএনপি অনড় ও অটল। বিএনপি ডান কিংবা বামপন্থী নয়। বিএনপির ডানে যাদের অবস্থান তারা ডানপন্থী, বিএনপির বামে যাদের অবস্থান তারা বামপন্থী। বিএনপির অবস্থান কেন্দ্রে। এই ঐতিহাসিক অবস্থানের কারণে শহীদ জিয়া, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের দল বিএনপি এত জনপ্রিয়। এই অবস্থানের কারণে বিএনপি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ দেশের রাজনীতির মূলধারা ও কেন্দ্র হয়ে আছে।
দুই.
গণমানুষের কাছে দেয়া ওয়াদার বরখেলাপ করায় দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ। উপরন্তু সম্প্রতি দলীয় লুটেরা ও বাজিকরদের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ায় বাজারে অগ্নিমূল্য। পাশাপাশি জনগণের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রতারণামূলক অপকৌশল প্রয়োগের পদ্ধতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপকৌশলকেও হার মানিয়েছে। ২৮ অক্টোবর ২০২৩, বিএনপির স্মরণকালের বৃহৎ শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন বাহিনীর বর্বরোচিত সশস্ত্র হামলাকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার সাথে তুলনা করা যায়। উভয় হামলার নেপথ্য উদ্দেশ্য অনেকাংশে মিলে যায়। ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা গণমানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিল। গত ২৮ অক্টোবর ২০২৪ আওয়ামী লীগ বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা দেশের গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের জন্য দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছে।
আওয়ামী লীগ দেশের খায় আর বিদেশী প্রভুর গীত গায়। আওয়ামী লীগ তার বিদেশী প্রভুর পরিকল্পনামাফিক ১/১১’এর প্লট তৈরি করে। গণবিরোধী ১/১১ ঘটিয়ে বিদেশী প্রভুর মদদপুষ্ট মঈন-ফখরুদ্দীনকে ক্ষমতায় বসায়। প্রভুদের পরিকল্পনামাফিক মঈন-ফখরুদ্দীন ২০০৮ সালের এক সাজানো ভোটে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হাতে পেয়ে বিদেশী প্রভুর পরিকল্পনামাফিক কাজ করে। সমাজের সর্বত্র অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটিয়েছে। নিরপেক্ষ ভোটব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও সুশাসনের টুঁটি চেপে ধরেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক লুটসহ আর্থিক খাত থেকে অর্থ লুটপাট করে বিদেশী প্রভুসহ আত্মীয়-পরিজনদের নামে-বেনামে বিদেশে পাচার করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, সহাবস্থান, নৈতিক শিক্ষা, আদর্শ শিক্ষা ও দেশপ্রেমকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। প্রিয় মাতৃভূমি আজ আওয়ামী বাকশালীদের লুটপাট ও ভোগের মচ্ছবে পরিণত হয়েছে। প্রভুদের পরিকল্পনামাফিক সর্বত্র মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দিয়ে ছাত্র, যুব ও তরুণ সমাজের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়েছে। দেশকে প্রভুর আজ্ঞাবহ কলোনিতে পরিণত করার জন্য ধীরে ধীরে দেশকে অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত করছে। দেশের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করা হয়েছে। দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবলে দেশ থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ন্যায় নীতিবোধ। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিপ্লব ও প্রতিবাদের স্পৃহা ধ্বংস করে দিতে মাদকের অবাধ প্রবাহ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনামাফিক সব কিছু নষ্টদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। মেগা প্রজেক্টের নামে চলছে মেগা লুটপাট।
তিন.
বিদেশী প্রভুর আজ্ঞাবহ কলোনিতে পরিণত করার জন্য আওয়ামী লীগ সভ্যতার সব সূচকে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
সীমান্তে নিয়মিত হত্যা ও কাঁটাতারে ঝুলছে ফেলানীদের লাশ। সুষ্ঠু নির্বাচন আজ নির্বাসনে। গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে চরম কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মানুষের অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। আওয়ামী জাহেলিয়াত গণমানুষের অধিকার হরণ করেছে। গণতন্ত্রের নামে তারা বার্মা ও উত্তর কোরিয়া মডেলের চরম একনায়কতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছে।
চার.
অপশাসনের নমুনা!
ক
১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী দুঃশাসনের সময়কালে ৪০ হাজার দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের হত্যা, ওয়াদা ভঙ্গ করে চার আনা সের চাল ১০ টাকা, দুই আনা সেরের লবণ ৮০ টাকা, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে সাড়ে ছয় লাখ আদম সন্তান হত্যা, ভোটের বাক্স দখল, পথেঘাটে হাইজ্যাক, নদীতে ভাগাড়ে বেওয়ারিশ লাশ এবং পিণ্ডির শৃঙ্খল থেকে দেশকে দিল্লির দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করা হয়।
খ.
১৯৮২ সালে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলে সহায়তা করা। এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অংশীদার।
গ.
প্রভুর পরামর্শে ২০০৭’ ১/১১’এর ঘটনা ঘটানোর যাবতীয় প্লট তৈরি করে আওয়ামী লীগ। তারা ওই সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে মন্তব্য করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করার চূড়ান্ত প্লট তৈরি করা।
ঘ.
২০০৯ পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে জড়িত থেকে চৌকস সেনা অফিসারদের হত্যা করা। বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রভুর অন্যতম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
ঙ.
১৫ আগস্ট পরিকল্পনার পেছনে আওয়ামী লীগের বিরাট এক অংশের সংশ্লিষ্টতা। এমনকি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনার পেছনে প্রভুর রহস্যজনক তৎপরতা।
চ.
বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বিলোপ কাদের সহায়তায়? সেটা স্পষ্ট।
ছ.
আওয়ামী লীগ এখন উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ক্ষমতার মদে আকণ্ঠ মত্ত। সরকারি মদদে সর্বত্র লুটপাট, দুর্নীতি এবং বিশৃঙ্খলার রাজনীতি চালু করা হয়েছে। দেশ থেকে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও দেশপ্রেম বিতাড়িত করেছে। রাজনীতি কলুষিত করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এখন প্রকাশ্যে বলে রাজনীতি করতে হলে টাকা লাগে, ছেলেপেলে পোষা লাগে, ক্যাডারদের পেছনে টাকা ঢালা লাগে, টাকা জোগাড় করা লাগে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন দেউলিয়া চিন্তাভাবনার কারণে রাজনীতি এখন অবৈধ বাণিজ্যে পরিণত হয়ে গেছে। সমাজের সব দুই নম্বরি ব্যক্তি ও কালো টাকার মালিক আওয়ামী লীগের পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কালো টাকার মালিকরা রাজনীতিতে অর্থ বিনিয়োগ করে চক্রবৃদ্ধি হারে টাকা উসুল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
পাঁচ.
বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে হুমকির মুখে। ঢাকা থেকে নয়, প্রভুর দেশ থেকে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়। আমাদের গণতন্ত্রকে খুন করেছে আওয়ামী লীগ এবং তার প্রভু মিলিতভাবে। প্রভুর চাপিয়ে দেয়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। বিনা অপরাধে অগণিত বিএনপির নেতাকর্মীদের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং বলপ্রয়োগে বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে।
দেশের মানুষ এখন আওয়ামী জাহেলিয়াতের এই দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়। যার জন্য প্রয়োজন এক নতুন লড়াই ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’। এ লড়াই বিএনপিকে ক্ষমতার ভাগিদার করার জন্য নয়। এ লড়াই গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। পরস্পর দোষারোপ, হতাশা, ভোগবাদের মতো আত্মঘাতী রাজনীতিকে পরাস্ত করে মানুষকে জেগে উঠতে হবে। সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশ রক্ষার এই লড়াইয়ে জনগণকে জিততে হবে। এ লড়াইয়ে হেরে গেলে হেরে যাবে সার্বভৌম বাংলাদেশ।
লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা