ট্রান্সজেন্ডারবাদের আদ্যোপান্ত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব
- ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৪২
(গতকালের পর)
ইসলাম ও ট্রান্সজেন্ডারিজম
ইসলামে কেবল দু’টি লিঙ্গ স্বীকৃত : পুরুষ ও নারী। কুরআনের অনেক আয়াতের মাধ্যমে তা সাব্যস্ত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘এবং তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল-পুরুষ ও নারী।’ (৫৩:৪৫)
‘এবং তাঁর, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন।’ (৯২:৩)
তাহলে তথাকথিত তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে যারা পরিচিত তাদের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান কি? এই তথাকথিত তৃতীয় লিঙ্গ অথবা হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার নামেই তো ট্রান্সজেন্ডারিজমকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মূলত, তৃতীয় কোনো লিঙ্গের স্বীকৃতি ইসলাম দেয় না। মূলত হিজড়া বলে যারা পরিচিত তাদের জন্মগত শারীরিক বৈকল্য বা ত্রুটি থাকে। বিভিন্ন শারীরিক চিহ্ন দেখে তাদের লিঙ্গ পুরুষ কিংবা নারী হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। শারীরিকভাবে ত্রুটি নিয়ে জন্মানো হিজড়াদের ইসলাম দুই ভাগে ভাগ করেছে : ১. খুনছা আল মুশকিল এবং ২. মুখান্নাছ খিলকি। খুনছা আল মুশকিল শ্রেণীর হিজড়ারা দুই লিঙ্গের অবিকশিত প্রজনন অঙ্গ নিয়েই বা কোনোটি ছাড়াই জন্মায়। প্রথম ক্ষেত্রে প্রস্রাব করার রাস্তা দ্বারা লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অপ্রাথমিক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য (secondary sexual characteristics) যেমন- বুকের আকার, লোম-শ্মশ্রু এসব দেখে লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় শ্রেণী তথা মুখান্নাছ খিলকি হচ্ছেন সেসব হিজড়া যাদের জননাঙ্গে কোনো ত্রুটি না থাকলেও চলাফেরা, কণ্ঠ, ভাবভঙ্গিমায় অনিচ্ছাকৃতভাবে ও জন্মগতভাবে বিপরীত লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। তাদেরকে ইসলামের পরিভাষায় বলে মুখান্নাছ খিলকি। তাদের জননাঙ্গ দেখেই তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় এবং তাদের বিপরীত লিঙ্গ-সুলভ বৈশিষ্ট্যের জন্য তারা নিন্দিত হন না, যেহেতু জন্মগত হওয়ায় তা তাদের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। এভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ করে দেয়ার মাধ্যমে ইসলাম হিজড়া জনগোষ্ঠীকে যেকোনো ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও বৈষম্য থেকে রক্ষা করে।
অন্যদিকে ট্রান্সজেন্ডার বলে দাবিকারীদের কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা বা ত্রুটি থাকে না। কিন্তু তাদের মনে হয় তারা বিপরীত লিঙ্গের, কিন্তু ভুল শরীরে তা আটকা পড়েছে। এ জন্য অপারেশন করে বা হরমোন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে অথবা এসব কোনো কিছু ছাড়াই তারা নিজেদের বিপরীত লিঙ্গের মানুষ বলে দাবি করে এবং তাদের এ দাবির সামাজিক ও আইনি স্বীকৃতি দাবি করে। মূলত অপারেশন করে (gender reassignment) কিংবা হরমোন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দেহে বিপরীত লিঙ্গের জননাঙ্গ স্থাপন করা সুস্পষ্টভাবে হারাম, যা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেন-
‘শয়তান বলল, আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট অংশগ্রহণ করব। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দেবো; তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেবো।’ (সূরা নিসা : ১১৮-১১৯)
আর সম্পূর্ণ শারীরিক সুস্থতা নিয়ে নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের দাবি করা এবং আচার-আচরণ করাকেও হাদিসে অভিশপ্ত কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: নারীর বেশধারী পুরুষদের এবং পুরুষের বেশধারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন। (বুখারি-৫৮৮৫)
বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারবাদ বিতর্ক
সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৫১-৫৬ পৃষ্ঠায় ‘শরীফার গল্প’-এ সরাসরি ট্রান্সজেন্ডারবাদকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী গণমানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে তুলে ধরার দুঃসাহসিকতাও সহজেই বোধগম্য। শিশুদের মনে যেকোনো কিছুই সহজে গেঁথে যায়। শিশু বয়সেই যদি বর্তমানে ট্রান্সজেন্ডারবাদ ও এর সূত্র ধরে পরবর্তীতে সমকামিতাকেও তুলে ধরা হয় তাহলে তারা ট্রান্সজেন্ডারবাদ, সমকামিতা ও এলজিবিটিকিউকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেবে। তবে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে স্বাভাবিকীকরণের এটিই প্রথম প্রচেষ্টা নয়। বাংলাদেশে অনেক দিন থেকেই ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে মিডিয়া ও বেশ কিছু এনজিও।
ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশী অনেক মিডিয়া পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। বহু মিডিয়ায় বিভিন্ন ট্রান্সজেন্ডারদের সফলতার কাহিনী তুলে ধরে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। দৈনিক সমকালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশব্যাপী হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করছে ৩০টি কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন। এসব সংগঠন হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় কাজ করার কথা বললেও এসবের আড়ালে তাদের অনেকেই কাজ করে যাচ্ছে। গত বছরের ১০ আগস্ট বাংলাদেশের আলোচিত ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট হোচিমিন ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে সাক্ষাতও করেছে। এমনকি ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি সংসদেও পৌঁছে গেছে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় আইন পাস হচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে।
ট্রান্সজেন্ডারবাদ ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা
ট্রান্সজেন্ডারবাদকে স্বাভাবিকীকরণ করলে অনৈতিকতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার দুয়ার খুলে যাবে।
প্রথমত, ট্রান্সজেন্ডারবাদ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টিতে ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে চরম সীমালঙ্ঘন। এ ছাড়াও ট্রান্সজেন্ডারবাদ সমলিঙ্গের মধ্যে যৌনতা স্বাভাবিকীকরণ ও আল্লাহ নির্ধারিত পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ধ্বংসের পথ অবমুক্ত করে দিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
দ্বিতীয়ত, ট্রান্সজেন্ডারবাদকে বৈধতা দেয়ার অর্থ হলো- সামাজিকভাবে নারীদের জন্য নির্ধারিত পরিসরে নারী দাবি করা পুরুষদের অনুপ্রবেশের সুযোগ দেয়া। নারীদের কমনরুম, টয়লেট, প্রিজন ওয়ার্ড ইত্যাদিতে নারী দাবি করা পুরুষদের প্রবেশাধিকার দেয়াটা বিপজ্জনক। এর কিছু ফলাফল আমরা পাশ্চাত্যে ইতোমধ্যেই দেখেছি। ইসলা ব্রাইসন নামে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়া ট্রান্সজেন্ডার জেলের ভেতর দু’জন নারী বন্দীকে ধর্ষণ করে। পাশ্চাত্যে নারী ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোতে ট্রান্সজেন্ডার নারীদের অংশগ্রহণ ইতোমধ্যেই অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়াও ট্রান্সজেন্ডারবাদ আইনি ক্ষেত্রেও ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। উত্তরাধিকার, শিশুর কাস্টোডি ইত্যাদি বিষয়ে ট্রান্সজেন্ডারবাদ ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে।
তৃতীয়ত, ট্রান্সজেন্ডারবাদের অবধারিত ফলাফল হচ্ছে সমলিঙ্গের সাথে যৌনতা স্বাভাবিকীকরণ। নারী দাবি করা একজন পুরুষ যদি নারী হিসেবে আইনি স্বীকৃতি পেয়ে কোনো পুরুষের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয় তা হবে স্পষ্ট সমকামিতা; আর যদি সে অন্য কোনো নারীর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয় তাহলে তা কার্যত সমকামিতা না হলেও সমাজের চোখে তা হবে সমকামিতা। উভয় ক্ষেত্রেই সমকামিতাকে প্রমোট করা হবে।
চতুর্থত, ট্রান্সজেন্ডারবাদকে স্বাভাবিকীকরণ করা হলে পরিবার ও সমাজের ধ্বংস হবে অনিবার্য। পরিবার গঠিত হয় নারী ও পুরুষের পরিপূরকতাকে কেন্দ্র করে, যাদের মিলনের ফলে জন্ম নেয় একটি মানবশিশু। পরিবারের ছায়াতলে এ শিশু বেড়ে উঠে; মানবীয় গুণাবলি অর্জন করে। নারী-পুরুষের এই পরিপূরকতার মূল হচ্ছে তাদের লৈঙ্গিক পার্থক্য ও অপরিবর্তনীয়তা। এ লৈঙ্গিক পার্থক্য ও অপরিবর্তনীয়তাকে যখন অস্বীকার করা হয় তখন পরিবার, সমাজ, আইন, বিয়ে ইত্যাদি অর্থহীন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ট্রান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের সম্ভাব্য নেপথ্য কারণ
ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা এত দিন ধরে চলে এলেও সম্প্রতি এ বিষয়কে কেন্দ্র করে হঠাৎ এত হইচই সৃষ্টি হওয়ার সময়টি বেশ সন্দেহজনক। আমরা সবাই জানি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একটি ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে। আওয়ামী লীগের এভাবে একপাক্ষিক ও বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা সরকার সন্তুষ্ট ছিল না। এখন সরকারি বইতে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রমোট করা এবং দেশে আইনিভাবে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে বৈধতা দেয়ার জন্য দেশের আপামর তৌহিদি জনসাধারণের মধ্যে যদি ট্রান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন সৃষ্টি হয় তাহলে আওয়ামী সরকার ট্রান্সজেন্ডারবাদসহ এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রমোটকারী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে বলতে পারবে যে, তারা যেহেতু বাংলাদেশে পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রচার-প্রসার করতে চায়, তাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর উচিত আওয়ামী সরকারকে সমর্থন দেয়া। এ ছাড়াও ডামি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যকার বিক্ষোভ অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্যও আওয়ামী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে জলঘোলা তৈরির চেষ্টা করে থাকতে পারে।
উপসংহার
ট্রান্সজেন্ডারবাদ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের নামে কেবল কিছু বিকৃত রুচি ও মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের উদ্ভট মতবাদ নয়। এটি লিবারেলিজম নামক বৃহত্তর একটি মতবাদের অধীনে একটি উপমতবাদ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য-উপনিবেশবাদ উপনিবেশবাদ-উত্তর সময়ে পুরো বিশ্বের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে লিবারেলিজম চাপিয়ে দিচ্ছে। এই অন্যায্য আরোপের ধারাবাহিকতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এলজিবিটিকিউ অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়ার চাপ। পশ্চিমা বিশ্বে লিবারেলিজম মূল্যবোধের অবক্ষয়, যৌন বিশৃঙ্খলা ও পরিবারব্যবস্থার ধ্বংস ডেকে এনেছে, তা পশ্চিমা বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের উপরও চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। এর পেছনে সরাসরি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা সরকার এবং তাদের এ দেশীয় বরকন্দাজ হিসেবে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও ও মিডিয়া হাউজ। আমাদের সভ্যতা ও মূল্যবোধ রক্ষা করতে এলজিবিটিকিউ এবং এর নামে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে এ দেশে স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা