২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ট্রান্সজেন্ডারবাদের আদ্যোপান্ত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ট্রান্সজেন্ডারবাদের আদ্যোপান্ত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ - প্রতীকী ছবি

ভূমিকা
গত দশকে পশ্চিমা বিশ্বে যে মতবাদটি একপ্রকার গেড়ে বসেছে তার নাম ট্রান্সজেন্ডারবাদ (transgenderism)। এর মূল কথা হলো, মানুষের মানসিক লিঙ্গ দৈহিক লিঙ্গ থেকে পৃথক হতে পারে এবং মানুষের লিঙ্গকে তার মানসিক লিঙ্গ অনুযায়ীই নির্ধারণ করতে হবে। অতএব, দৈহিকভাবে একজন পুরুষ যদি নিজেকে নারী দাবি করে কিংবা দৈহিকভাবে একজন নারী যদি নিজেকে পুরুষ দাবি করে তাহলে এ ধরনের দাবির সামাজিক ও আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। একই উদ্দেশ্যে অপারেশন অথবা হরমোন ট্রিটমেন্ট করে একটি পুরুষদেহকে নারীদেহে কিংবা নারীদেহকে পুরুষদেহে রূপান্তর, কিংবা মানসিকভাবে বিপরীত লিঙ্গের দাবি করা পুরুষকে নারীদের মতো এবং নারীকে পুরুষদের মতো পোশাক পরার অধিকারও দিতে হবে। পাশ্চাত্যে ইতোমধ্যেই এ মতবাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্কুলগুলোতে শিশুদের নারী-পুরুষের বাইরেও একাধিক লিঙ্গ আছে বলে শেখানো হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়াই শিশুদের লিঙ্গ পরিবর্তনে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যাতে বাবা-মা বাধা দিতে পারছেন না। সাম্প্রতিককালে কিছু এনজিও ও মিডিয়ার মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার কথার আড়ালে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ বাংলাদেশে আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় হইচই সৃষ্টি করেছে সপ্তম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইতে ‘শরীফ থেকে শরীফা’-গল্পটি যেখানে হিজড়া জনগোষ্ঠী অথচ হিজড়া জনগোষ্ঠী ও ট্রান্সজেন্ডার পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়। প্রথমটি জন্মগত দৈহিক বৈকল্য এবং পরেরটি মানসিক বৈকল্য।

ট্রান্সজেন্ডারিজমের গোড়ার কথা
পাশ্চাত্যে ট্রান্সজেন্ডারবাদের উত্থানের গোড়া পাওয়া যায় লিবারেলিজম, যৌন বিপ্লব (sexual revolution) এবং লিঙ্গ তারল্য (gender fluidity) মতবাদের মধ্যে। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ধীরে ধীরে খোদাকেন্দ্রিক বিশ্বদর্শন (theocentric worldview) থেকে দূরে সরে ধীরে ধীরে বস্তুবাদী ও অধিযন্ত্রবাদী (mechanistic) বিশ্বদর্শনের দিকে যেতে শুরু করে। ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি, প্রোট্যান্সট্যান্টবাদ প্রভাবিত সংস্কার, বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক (industrial) বিপ্লব ইত্যাদির প্রভাবে প্রকৃতিকে আল্লাহর সৃষ্টি ও এর উপর তার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ব্যাপারে পশ্চিমা জনসমষ্টির বিশ্বাস কমতে থাকে। ওহিভিত্তিক ও অবরোহী জ্ঞানের বদলে অভিজ্ঞতামূলক (empirical) আরোহী (inductive)জ্ঞানের প্রভাব বাড়তে থাকে। নবলব্ধ জ্ঞানের প্রভাবে বাইবেলের ঐতিহাসিক (historical) ও ভূবিজ্ঞানভিত্তিক (geological)সমালোচনা হতে থাকে। এর সাথে আগুনে ঘি হিসেবে যোগ দেয় চার্লস ডারউইনের ‘Origin of Species’ বইটি যেখানে তিনি ‘বিবর্তনবাদ’ নিয়ে আসেন, যা ছিল ঐতিহ্যবাহী ‘পরিকল্পনাবাদ’ (design argument)-এর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ এতকাল মনে করা হয় প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের সৃষ্টির পেছনে একটি পরিকল্পনা কার্যকর ছিল। আর সে পরিকল্পনাকারী (designer) হচ্ছেন মূলত আল্লাহ তায়ালা। এই মহাপরিকল্পনায় মানুষের অবস্থান ছিল কেন্দ্রে। কিন্তু ডারউইন এসে বললেন, মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতোই প্রকৃতির অন্ধ নিয়মে লক্ষ্যহীন বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট। ফলে প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে মানুষের বিশেষ স্থানটি আর থাকল না। মানুষ প্রকৃতিরই অবিচ্ছিন্ন অংশ এবং অন্যান্য প্রাণীর মতোই একটি প্রাণী হয়ে পড়ল, তবে একটু বেশি বিবর্তিত। এসব নতুন নতুন চিন্তার বদৌলতে জনমানসে বাইবেল ও খোদায়ি ওহির ধারণা দুর্বল হতে থাকে। পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্টের চিন্তাবিদরা এক নতুন মানবকেন্দ্রিক (anthropocentric) ও সেক্যুলার বিশ্বদর্শনকে তাদের লেখনীর মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমর্থন ও ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করে।

সেক্যুলারিজমের কোনো একক রূপ নেই। তবে সেক্যুলারিজমের বিভিন্ন চিন্তাগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ব্যাপার ছিল অভিন্ন আর তা হচ্ছে মানবীয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিই মূল্যবোধের একমাত্র উৎস। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ দার্শনিক জ্যাক রুশোর মতে, মানবসত্তার সঠিক পরিচয় তার মনস্তত্ত্বের অন্তর্গত বিষয়ের মুক্ত ও বাধাহীন বহিঃপ্রকাশের মধ্যেই নিহিত। কার্ল মার্ক্স মানবমর্মকে (human essence) অস্বীকার করেন এবং মানুষের প্রকৃতিকে আদি সাম্যবাদ, দাসপ্রথা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদসহ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিক সম্পর্কের সমষ্টিমাত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। যেহেতু উৎপাদন ব্যবস্থা বিবর্তন ও পরিবর্তনশীল, তাই একাট্টা মানবমর্ম বলেও কিছু নেই। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক নিৎশে খোদাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং সব প্রচলিত নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে স্বীয় ক্ষমতা জাহির করাকেই সর্বোচ্চ কল্যাণ হিসেবে ঘোষণা করেন। অস্ট্রিয়ান মনস্তত্ত্ববিদ ও দার্শনিক সিগমন্ড ফ্রয়েডও ধর্মের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মানুষকে প্রাথমিক যৌনপ্রাণী ও তার সব কার্যক্রমের পেছনে যৌনতাকে মূল কারণ ও প্রণোদনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

তবে বর্তমানে পুরো বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারী মতবাদ হিসেবে সেক্যুলার মতবাদ লিবারেলিজমের আলোচনা না করলেই নয়। ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে যে টানাপড়েন লিবারেলিজম তার সুরাহা করে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে। এ মতবাদ অনুযায়ী সমাজ অস্তিত্বেই এসেছে ব্যক্তির জন্য এবং তা একাধিক ব্যক্তির সমষ্টিমাত্র। তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি সমাজের অন্য কোনো ব্যক্তিকে স্পৃশ্যগত (tangibly) দিক দিয়ে ক্ষতি না করছে, সে স্বাধীন। এভাবেই লিবারেলিজম ব্যক্তি স্বাধীনতাকে পরিবার ও সম্প্রদায়ের উপর স্থান দেয়।

অন্যদিকে লিঙ্গ তারল্য মতবাদের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রবক্তা জুডিথ বাটলার হলেও এর গোড়া পাওয়া যায় কার্ল মার্ক্স, জ্যঁ পল সার্ত্রে, সিমন দা বুঁভুয়ার লেখাজোখায়। জ্যঁ পল সার্ত্রে ও আলবেয়ার কামুর মতো অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা বলেন, মানবমর্ম বলতে কিছু নেই। মানুষ নিজেই তার মর্ম ও জীবনের অর্থ নির্ধারণ করে। জ্যঁ পল সার্ত্রের সঙ্গিনী সিমন দা বুঁভুয়া তার ‘The Second Sex’ গ্রন্থে নারীত্বকে দৈহিক ব্যাপার নয়; বরং সামাজিক নির্মাণ (Social Construct) বলে দাবি করেন। জুডিথ বাটলার আরো একধাপ এগিয়ে লিঙ্গের শারীরিক দিকটিকেও সামাজিক নির্মাণ বানিয়ে দেন। তার মতে, একটি শিশুর দেহের প্রজনন অঙ্গ দেখে যে তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় এ ব্যাপারটিও সামাজিকই। মূলত জন্ম দেয়ার মতো সামাজিক ভূমিকার জন্য এভাবে একটি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়। প্রজনন অঙ্গ কেন, কানের লতি দেখেও তো এ পৃথকীকরণ করা যেত! অর্থাৎ তার মতে, প্রজননের মতো একটি মৌলিক মানবীয় শারীরবৃত্তীয় দিকটিও জুডিথ বাটলারের মতে সামাজিক নির্মাণ, যা অপরিহার্য (essential) নয়।

ষাটের দশকের যৌনবিপ্লব সাধারণভাবে বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে পশ্চিমা সমাজে স্বাভাবিকীকরণ করে। এর ফলে খ্রিষ্টীয় পশ্চিমা বিশ্বে যৌনতা, বিয়ে, পরিবার ও নৈতিকতার মধ্যে যে একসূত্রিতা কল্পনা করা হতো তা ভেঙে যায়। তৃতীয় ধারার নারীবাদী আন্দোলন, সমকামী অধিকার আন্দোলন এবং গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ঘটা যৌনবিপ্লবের মিশ্রণে তৈরি হওয়া জেন্ডার আইডেন্টিটি আন্দোলন, চিকিৎসক, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির একটি অংশ এবং সমকামিতা ও অন্যান্য যৌন বিকৃত স্বাভাবিকীকরণে বিপুল অর্থ খরচ করা দাতাদের রয়েছে ট্রান্সজেন্ডারবাদ উত্থানের পেছনে সরাসরি ভূমিকা। ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া প্রায় পাঁচ দশক ধরে দাতা, মিডিয়া, অ্যাকটিভিজম, আইন-আদালত, এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থা- ইত্যাদির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক বিশাল নেটওয়ার্ক যারা সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রচার-প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ কাজে রত এনজিওগুলো রাজনীতিবিদদের কাছে দেনদরবার করছে, অনলাইন-অফলাইনে তৈরি করছে বিপুল অ্যাকটিভিস্ট, আইনজীবীদের ব্যবহার করে খসড়া আইন তৈরি করছে। এসব নেটওয়ার্কের প্রভাবে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর বিধানসভাগুলোতে সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডারবাদ বৈধ করে নিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে এ ধরনের বিকৃত যৌনতা বৈধ হওয়ার পর এসব রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ব্যবহার করে অন্য দেশগুলোতেও সমকামিতাসহ ট্রান্সজেন্ডারবাদ স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।

(বাকী অংশ আগামীকাল)


আরো সংবাদ



premium cement