২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মরহুম রইস উদ্দিন : একজন বিনয়ী মানুষ

মরহুম রইস উদ্দিন - ফাইল ছবি

বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির ঢাকা কেন্দ্রের প্রায় দুই দশক ধরে তিনি ছিলেন পরিচালক (প্রশাসন)। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি সংস্থাটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দুনিয়ার সব বাঁধন ছিন্ন করে চলে গেলেন মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

এস এম রইস উদ্দিন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় খুব দীর্ঘদিনের নয়। সম্ভবত ২০১৭ সালের মাঝামাঝি তার চেম্বারে অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিন ও কথাশিল্পী মাহবুবুল হক আমাকে রইস ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয়ের সুবাদে, একদিন আমি আমার, ‘জাতীয় কবির জীবনে ট্র্যাজেডি’ নামক বইটি পুনঃপ্রকাশের কথা রইস ভাইকে জানাই। রইস ভাই বললেন, নজরুল, ফররুখ, জসীম উদ্দীন, কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলী আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রেরণা। তাদের ওপর যে কোনো গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আগামী প্রজন্মকে সঠিক মনন ও সংস্কৃতিতে গড়ে তুলতে এদের সাহ্যিত্যের নানাদিক আপনারা তুলে ধরবেন। সে কাজে আমরা সম্পৃক্ত থাকব।

তার সুন্দর ও বিনয়ী আচরণ সব সময়ই মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে। সে কারণে প্রথম দিন থেকেই আমি তার গুণমুগ্ধ হয়ে পড়ি। তার মহৎ গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলা। যা আমাদের সমাজে বিরল প্রায়। এমনকি যারা ইসলামের অনুশীলন করেন বা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী তাদের মধ্যেও বিনয় এবং অন্যকে সম্মান দেয়ার অভ্যাস তেমন একটা চোখে পড়ে না। রইস ভাইয়ের কাছে কোনো আবেদন নিয়ে গেলে, তিনি কখনো ফিরিয়ে দেননি কিংবা বিরক্তও হননি। নাবিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংসদ থেকে বড় ভলিউমের একটি বিশেষ সংখ্যা বের করার সিদ্ধান্ত হলো। বিষয়টি রইস ভাইয়ের দৃষ্টিতে আনা হলে তিনি তার মুদ্রণ ও বাইন্ডিং-এর দায়িত্ব নিলেন। এরপর আমার সম্পাদিত ‘প্রসঙ্গ : নজরুল’ সংখ্যাটিরও তিনি মুদ্রণ ও বাইন্ডিং ফ্রি করে দেন। প্রতি রমজানে কবি-সাহিত্যিকদের ইফতারসহ কিছু ঈদ উপহার দিয়ে থাকি। সেখানে তার সহযোগিতার হাত অব্যাহত ছিল। বুক সোসাইটির বোর্ড রুমটি আমরা সচরাচর সাহিত্য আড্ডায় ব্যবহার করতাম। আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের আপ্যায়ন তিনি বরাবরই করতেন।

সাহিত্যকর্মীদের প্রতি সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেও রইস ভাই যে উদারতা দেখিয়েছেন, তা আকাশছোঁয়া। কবি-সাহিত্যিকদের তিনি আর্থিকভাবে সহযোগিতাও করতেন। এ ব্যাপারে রাসূল সা: বলেন, গরিব কবিকে আর্থিক সাহায্য করা, বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সাহায্য করার সমতুল্য। এ হাদিসটিকে তিনি মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন বলেই, আমরা তাঁর কর্মে সেটির প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি। তিনি সাধারণতই বলতেন, আমরা যদি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা না করি, কে তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আহা!

রইস ভাইয়ের মনে কখনো অহঙ্কার দেখিনি। মানী লোকদের সম্মান দেয়া এবং ছোটদের স্নেহ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তার অধস্তন কর্মচারীদের প্রতি রূঢ় আচরণ বা বেইনসাফি করেছেন এমন কখনো শুনিনি। তার ইন্তেকালের পর তার স্টাফদের পরস্পরকে বলতে শুনেছি, স্যারের মতো দরদি মানুষ কি আর আমরা পাবো! বুঝতে পেরেছি তিনি চিন্তা ও মননে কথটা বিশুদ্ধ ছিলেন। যেমন তার মুখে হাসি লেগে থাকত, তেমনি গভীরভাবে তাকালে মনে হতো তিনি সবর ও ধৈর্যের বিশাল এক পাহাড়। আমি তার সহকর্মীদের কাছে শুনেছি, প্রতিষ্ঠান চালাতে তাকে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে তিনি দৃঢ়তার সাথে ম্যানেজ করেছেন। কখনো অন্যায় আবদারের সাথে আপস করেননি। রইস ভাইয়ের মধ্যে কখনো আমি ভারসাম্যহীনতা দেখিনি। দেখিনি কথা ও কাজে মধ্যে কোনো ব্যত্যয়। কোনো চঞ্চলতা বা অস্থিরতা ছিল না তার স্বভাবে।

মাঝে মধ্যে জোহর নামাজ পড়তাম বুক কো-অপারেটিভের দফতরে। কখনো, কখনো তিনি আমাকে বলতেন, চৌধুরী সাহেব, আপনি আমাদের উদ্দেশে কিছু বলুন। রইস ভাইয়ের অনুরোধে ৫-৭ মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করতাম। বুক কো-অপারেটিভের ইফতার মাহফিলে তিনি একবার আমাকে প্রধান আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার এ গভীর ভালোবাসা মনে রাখব আজীবন। গত বছর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা ও পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে রইস ভাইকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি সানন্দে রাজি হন এবং যথাসময়ে হাজিরও হন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এম. শমসের আলী এবং প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি পিএইচপির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান। অনুষ্ঠানে তিনি নজরুল এবং ফররুখের ওপর যেকোনো গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশে বুক কো-অপারেটিভ দায়িত্ব নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সুফি মিজান সাহেব এবং ড. এম. শমসের আলী স্যার রইস ভাইয়ের বক্তব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।

কুরআনুল করিমে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ব্যবহারিক জীবনে যে সৌন্দর্য ও শিষ্টাচারের কথা বলেছেন এবং আল্লাহর রাসূল সা: ভদ্রতা ও উত্তম জীবনাচারের কথা বলেছেন, তার উত্তম দৃষ্টান্ত আমি রইস ভাইয়ের চরিত্রে দেখতে পেয়েছি। সদা হাস্যোজ্জ্বল আমাদের প্রিয় রইস ভাইকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম জান্নাতের অধিবাসী করুন।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, কালচারাল রিসার্চ সেন্টার
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement