খুচরা বাজারে পাইকারি আলাপ না
- মুহাম্মদ কামাল হোসেন
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৪৪
বাজারের দু’টি দৃশ্য:
১.
বাজারের ভিড় ঠেলে গোশতের দোকানে ঢুকতেই লোকটার সাথে ধাক্কা খেলাম। তার হাতের পলিথিন ব্যাগে সামান্য কিছু গোশত ছিল। সেটা ফসকে নিচে পড়ে গেল। আধা কিলো হবে সম্ভবত। আমাদের বাজারে লোকটাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মুখে সাদা-কালো দাড়ি। জীর্ণশীর্ণ চেহারা। মাথায় উসকোখুশকো চুল। পোশাকআশাকও ময়লা।
গোশতের ব্যাগটা কুড়িয়ে লোকটার হাতে দিই। স্যরি বলে এগোতে যাবো অমনি লোকটি আমার দিকে না তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ইটস ওকে- ইয়াং ম্যান! হাউ আর ইউ?’আমি অবাক। এমন সাবলীল ইংরেজি সচরাচর কোনো সাধারণ মানুষকে বলতে দেখিনি। এমন পোশাকে তো নয়ই। দ্রব্যমূল্য, দারিদ্র্য মানুষের মুখের ভাষা ও পোশাকি আভিজাত্য কেড়ে নিয়েছে। মৃদু হেসে করমর্দন করতে করতে বললাম, ‘আই অ্যাম ফাইন।’
এই প্রথম লোকটা আমার মুখের দিকে তাকাল। কী যেন খুঁজছে আমার চোখেমুখে। আমি অপেক্ষা না করে ঢুকে গেলাম দোকানের ভেতর। গোশত নিলাম দু’কিলোর মতো। লোকটা তখনো বাইরে খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে। বের হতেই আমার পিছু নিলো। প্রায় দুই গজ দূরত্ব বজায় রেখে লোকটা হাঁটছে আমার পেছন পেছন। আমি দাঁড়ালাম। লোকটাও দাঁড়াল। আমি হাঁটতে লাগলাম, লোকটাও। এবার পেছনে ফিরে লোকটাকে বললাম, ‘কী ব্যাপার চাচা? কিছু বলবেন?
‘আমাকে চিনতে পারনি বাবা?’
অবারো আশ্চর্য হলাম আমি। কণ্ঠটা চেনা মনে হলো। এমন বিধ্বস্ত কণ্ঠে কথাটা বলল, সরাসরি ভেতরে গিয়ে লাগল।
‘না তো। চিনিনি। কে আপনি বলুন তো?’
‘ভালো করে একটু দেখে বলো তো বাবা, আমি কে?’
একটু এগিয়ে যাই তার সামনে। লোকটাকে গভীর মনোযোগে দেখতে থাকি। অগোছালো দাড়ির আড়ালে আসল চেহারা খোঁজার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, চেনাচেনা লাগছে।
‘আচ্ছা আপনি...আমাদের আজিজুল চাচা না!’
‘জে বাবা। আমি তোমাদের আজিজুল চাচা।’
‘ম্যালাদিন পর আপনাকে দেখলাম। কিন্তু এ কী অবস্থা আপনার! থাকেন কই?’
‘ভাগ্য বাবা ভাগ্য। বলতে পারো ভাগ্যই আজ আমাকে এখানে দাঁড় করিয়েছে। থাকি এই বাজারের পুবপাশে, ছোট্ট একটা বাসায়।’
‘এই সামান্য গোশত কার জন্য? এটুকু দিয়ে কী হবে? এই নিন আমার হাতের ব্যাগটা নিন। চাচীকে দিয়েন।’
‘না না বাবা নিতে পারব না। আমাদের এটুকুতেই ঢের চলবে। তা ছাড়া একে সামান্য বলছ বাবা? রীতিমতো জান বেরিয়ে গেছে এটুকু গোশত কিনতে। জিনিসপাতির যা আকাশছোঁয়া দাম! মানুষ কিভাবে বাঁচবে আল্লাহ জানে? আর কি খেয়ে বাঁচবে? নিত্যপ্রয়োজনীয় সবধরনের পণ্য এখন নাগালের বাইরে। আহা রে (!) কতদিন গোশত খাই না। তোমার অসুস্থ চাচীটা খেতে চেয়েছিল।’
‘চাচা আপনার না ছেলেপুলে আছে! কই তারা?’
‘কেউ নেই বাবা, আজ কেউ নেই। আমার কেউ নেই। এক আল্লাহ ছাড়া আমাগো আর কেউ নাই বাবা।’ এই বলে আজিজুল চাচা হন হন করে দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন।
২.
‘দাঁড়া, মনে আছে তো কি কি বলেছি?’
‘হ মা, একদম মনে আছে। ফর্দ রেডি। রসুন ১ কেজিই তো?’
‘হ্যাঁ, ১ কেজি’
‘আচ্ছা’
‘আর একটু দাঁড়া’
‘আবার কী?’
‘বাবা আনিস, ৫ কেজি পেঁয়াজও আনিস’
‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ...কও কী মা এসব?’
যেন কিছুই হয়নি। মা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
‘কেন কী হয়েছে আবার? আর তৌলা (ভাত) খাবি না?’
আনিস আর কথা না বাড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছা মা আনব।’
কড়কড়ে দু’খানা এক হাজার টাকার নোট পকেটে পুরে আনিস ব্যাগ হাতে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। ফর্দমাফিক সব আনতে হবে। মাসকাবারি খরচপাতি মাসের শুরুতেই কিনে নেয় ও। এতে সাশ্রয়ও হয় কিছুটা। সংসারে প্রতিদিন কত কিছুই তো লাগে। ভোরে ঘুম থেকে উঠলেই শুরু হয় খরচ। এটা ওটা সেটা কত কী লাগবে। পকেটে টাকা থাকুক কি না থাকুক। আনতেই হবে। প্রয়োজনে আইন মানে না। সাংসারিক খরচপাতি আনিসই করে। ওষুধপত্র, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল আরো কত ঝক্কি ঝামেলা! আনিসের মা সবসময় বলে, সংসার চালাতে ইঁদুর পায়ে এগোতে হয়। একটু শব্দ বা হোঁচট খেলে চলবে না। নয়তো নিশ্চিত আউল-কাউল বেঁধে যাবে মাসের মাঝামাঝিতেই।
বাজারে ঢোকার পর আনিস বোকা বনে গেছে জিনিসের দামের উত্তাপে! মেঘ বৃষ্টি কিছুই নেই অথচ ঝড়ের আলামত। সে টেনেটুনে পেঁয়াজ কেনে ৫ কেজির জায়গায় দুই কেজি। রসুন এক পোয়া। দেশী আর এলসি পেঁয়াজ এখন ৮০-১১০ টাকা। রসুন ২১০ টাকা। আনিস আঙ্গুলে বারবার হিসাব কষে। বাড়তি দামে জিনিস বেচে দোকানির পোয়াবারো। জিজ্ঞাসা করে,
‘হিসাবে গরমিল নাকি ভাইজান?’
‘না না, ঠিক আছে’
‘ভাইজান, খুচরা বাজারে পাইকারি হিসাব কইরা লাভ নাই। মাল ছাড়তে হবে!’ দোকানি লাল দাঁত বের করে ফিক করে হাসে।
ওর কথায় মাথায় আগুন ধরে যায় আনিসের। আনিস কিছু না বলে হন হন করে বেরিয়ে পড়ে। তার স্নায়ুচাপ বেড়ে গেছে। বাজারের আগুন মাথায় চড়েছে। আলু কেজি প্রতি ৬০-৭০ টাকা। শিম ৮০ টাকা! এতদিনকার পরিচিত বাজারটা ক্রমশ অপরিচিত লাগছে। মানুষগুলোও লাগছে অচেনা। কোনো রকম টলতে টলতে বিধ্বস্ত আনিস বাসায় পৌঁছে।
বাজারের এমন বহু গল্প আছে নিত্যদিনের। এখানে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত দুটি পরিবারের দুটো খণ্ডচিত্র দেখলাম।
জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তরতর করে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের হয়েছে মরণদশা! বাজারে ঢোকা যায় না। নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজারে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় শাকসবজির দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। সাধারণত শীতকাল ঘনিয়ে এলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বেড়ে যেত। ফলে কমত সবজির দামও। কিন্তু এবার চিত্র উল্টা। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও দাম কমছে না। শাকসবজি আলু, শিম, কপি থেকে শুরু করে পেঁয়াজ রসুনসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের ঝাঁজই বেশি।
সবকিছুর অস্থির দাম। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ে। তেল, মসলা, ছোলা, মুড়ি বাজারে লাগামহীনভাবে বেড়ে উঠেছে। হতাশায় খাবি খাচ্ছে সাধারণ ভুক্তভোগী ক্রেতারা। যেসব দ্রব্য বছরের অন্যান্য সময় সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে থাকে তাও এখন নাগালের বাইরে। এই নিয়ে প্রতিদিন পত্রিকায় লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু দাম আর কমে না।
অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসপত্রে আজ অগ্নিমূল্য। সমাজের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষগুলোর আরো করুণ ভগ্নদশা। দিন দিন জিনিসপত্রের চাপে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্যই সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় তারা একের পর এক এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বাজারে চলমান জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে এক প্রকারের কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে। উদার বাণিজ্য-ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রতি বছরই কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাজারের স্বাভাবিক ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া ব্যাহত করার পাঁয়তারা বা অপপ্রয়াসে লিপ্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অনেক ব্যবসায়ী আবার দ্রব্যপণ্য মজুদ করে রেখে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
সরকার বরাবরই বলতে চায় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক রাখতে তারা বদ্ধপরিকর ও সচেতন। কিন্তু বাজারচিত্র ভিন্ন কথা বলে। শুধুমাত্র কার্যকর তৎপরতা ও বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।
বন্যায় জিনিসপাতির দাম বাড়ে, খরা হলেও বাড়ে। দুর্যোগ হলেও বাড়ে, আবার না হলেও বাড়ে। রমজান ও ঈদ-পূজা পার্বণে তো কথাই নেই। এবারো কর্তৃপক্ষের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতিতে সাধারণ জনগণ আশান্বিত হওয়ার তেমন কারণ দেখছে না। দ্রব্যমূল্য বেড়ে এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্তদের কাছে বাজার এখন এক আতঙ্কের নাম। আজকাল অনুমান করে, হিসাব কষে হাট-বাজারে যাওয়া একধরনের বোকামি।
স্থিতিশীল বাজারব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকারের পাশাপাশি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদেরও যথেষ্ট আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। অথচ আজকাল বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপাতির মূল্য বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। সরকারকে অবশ্যই কঠোর হাতে এসব অতিলোভী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে দমন করতে হবে। বাজার পর্যবেক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা