হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৫০
আজকের লেখার শিরোনামটি প্রখ্যাত হিন্দি মুভির পরিচালক রাজকাপুর পরিচালিত ‘ববি’ মুভির একটি গানের চরণ। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমার নায়ক ঋষি কাপুর এবং নায়িকা ডিম্পল কাপাডিয়াকে নায়িকার সাথীরা খুঁজতে গেলে তারা একটি বাংলো ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। বাংলো ঘরের চাবির দায়িত্ব যার সে বুঝতে পারেনি ঘরে কেউ আছে কি না। তার ডিউটি শেষ হলে, সে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে যায়। তখন নায়ক নায়িকা গান গেয়ে ওঠেন, ‘বাইরে থেকে কেউ ভেতরে আসতে পারবে না, আবার ভেতর থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না, আমি আর তুমি এক ঘরে বন্দী, চাবিও হারিয়ে গেছে, এমন হলে কেমন হবে বলো তো’। হিন্দি গানের এই চরণ নিয়ে কেন আজকের আলোচনা তা অবশ্যই পাঠকদের কাছে পরিষ্কার করব।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সারা দেশ থেকে কয়েক লাখ লোক সেই সমাবেশে হাজির হন। লাখ লাখ লোকের এই সমাবেশ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু সরকারের মদদে সেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পণ্ড করার জন্য তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ হাজার হাজার টিয়ার শেল, শত শত সাউন্ড গ্রেনেড, ওপেন গুলি করে এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সমাবেশ ভন্ডুল করে দেয়। পরিকল্পিতভাবে একজন পুলিশ সদস্যকেও হত্যা করা হয়। একজন পুলিশ সদস্যের হত্যার ঘটনায় বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয় এবং ২০-২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলবন্দী করা হয়। গ্রেফতার করা হয় বিএনপির মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে। এই সাথে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে। লাল ফিতা দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হয় ‘ক্রাইমজোন’ হিসেবে। দীর্ঘ ৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর ১১ জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে মূল ফটকের তালা ভেঙে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এই ৭৫ দিন বিএনপির প্রধান কার্যালয়ের সামনে শ’খানেক পুলিশ যুদ্ধের মুডে রাত-দিন পাহারারত ছিল। যেন দলীয় কার্যালয়ে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। ১১ জানুয়ারির কয়েক দিন আগে ক্রাইমজোন লেখা লাল ফিতার ব্যারিকেডটি অবশ্য সরিয়ে নিয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের কুশীলবদের সহযোগিতায় ৭ জানুয়ারি ১৭ কোটি মানুষের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করে, একটি একনায়কোচিত সরকার প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার পরই কেবল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ সরিয়ে নেয়া হয়। এতদিন কেন বিএনপি নেতাকর্মীদের তাদের দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়নি? পুলিশ কেন বিএনপির অফিসে তালা লাগিয়ে নিজেদের কাছে চাবি রেখে দিলো?
দেশের জনগণ ইতোমধ্যে বুঝেছে যে, ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচন সহি-সালামতে শেষ করার জন্যই সরকার নিজ দায়িত্বে এই কাজটি করেছে। অবশ্য পুলিশ চাবি না দেয়ার কারণে রিজভী আহমেদ নেতাকর্মীদের নিয়ে এক ধরনের বিপ্লবী মুডে হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে দলীয় অফিসে প্রবেশ করেছেন। ভেতরে প্রবেশ করেই রিজভী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘...এভাবে নিপীড়ন করে জনগণকে দমিয়ে রাখা যাবে না। গণতন্ত্রের বিজয় হবেই।’
চাবি খুঁজে না পাওয়া এবং তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করাকে কেন্দ্র করে সরকার প্রধান বলেছিলেন, হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো, অউর চাবি খো যায়ে। তার এই উক্তিটি খুব সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। তিনি বিএনপি কার্যালয় তালাবদ্ধ রেখে গণতন্ত্রের বুকে কুঠারাঘাত করেছেন। বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের ৯২ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যায়নি। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সরকারপ্রধান ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে, মুখে একধরনের বিজয়ের আমেজ নিয়ে চাবি হারিয়ে যাওয়া এবং তালা ভাঙাকে কেন্দ্র করে যে রসিকতা করলেন, তাতে গণতান্ত্রিক অবয়ব ছিল না, ছিল স্বৈরতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। স্বৈরশাসকরা জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর করে না, রাষ্ট্রীয় বাহিনীই তাদের সহায়ক শক্তি। হিটলার বিরোধী জনগণকে শায়েস্তা করার জন্য গোপন পুলিশ বাহিনী তৈরি করেছিল, তার নাম ছিল গেস্টাপো। মুসোলিনির গুপ্তচর বাহিনীর নাম ছিল ‘ব্ল্যাক শার্ট’ বা ‘কালো কুর্তা’ বাহিনী, যেই বাহিনী দিয়ে গণতন্ত্রকামীদের শায়েস্তা করতেন। আমাদের দেশে অবশ্য পুলিশবাহিনী সরাসরি বা সাদা পোশাকে ধরে নিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের চরমভাবে শায়েস্তা করে থাকে। আমাদের দেশে যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, অধিকারের কথা বলেন তাদের ধরে নিয়ে যে রামধোলাই দিয়ে লাল দেয়ালে বন্দী করে রাখেন তা হিটলারের গেস্টাপো আর মুসোলিনির কালো কুর্তা বাহিনীর ধোলাইয়ের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। কেউ কেউ তো চিরজীবনের জন্য নিখোঁজ হয়ে আছেন।
দুনিয়ার সব স্বৈরশাসকই জনগণের মতের প্রতি তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তারা মনে করে, জনবিদ্রোহ দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী তো আছেই। তাতে কে মরল আর কে বাঁচল তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সাথে বিদ্রোহীগোষ্ঠীর যুদ্ধ চলার সময় বিবিসির এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি বিদ্রোহীদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করছেন তাতে তো শিশু এবং নিরীহ জনগণ মারা যাচ্ছে। এতে আপনার কি কোনো প্রতিক্রিয়া নেই? এই প্রশ্নে মুয়াম্মার গাদ্দাফি কেবল বিদ্রূপাত্মক হাসি হেসেছিলেন। রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তার এই নিষ্ঠুর হাসি তখন বিশ্বব্যাপী তা সমালোচিত হয়েছিল। তদ্রূপ বিএনপি কার্যালয়ের চাবি নিয়ে বিদ্রূপাত্মক হাসি দিয়ে উচ্চারিত হিন্দি গানের কলির মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষের সাথে কতটা নিষ্ঠুরতা রয়েছে তা পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত ১৫টি বছর গণতন্ত্রের চেহারা যে চেহারা দেখেছি ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ উপন্যাসের কল্পিত ‘ওশেনিয়া’ রাষ্ট্রের সাথে তার মিল খুঁজে পাই। উপন্যাসে অরওয়েল এমন এক রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে ভিন্নমত থাকবে না। ‘একদল’ এবং একজনই সেখানে সব ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেখানে প্রশ্নহীন আনুগত্যের দাবিদার কেবল ‘বিগ ব্রাদার’ বা ‘বড় ভাই’। তার অসঙ্গতি খোঁজা বা কোনো কিছুতে আপত্তি তোলা হবে অপরাধ। সেই ‘অপরাধ’ সামলাতে ওশেনিয়ায় আছে ‘থট পুলিশ’ বা ‘চিন্তারক্ষী’রা। গত ৭ জানুয়ারি প্রহসনের ডামি নির্বাচন করে সংসদ অধিবেশন ডাকার প্রতিবাদে বিএনপির কালো পতাকা মিছিল থেকে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, অত্যন্ত মার্জিত ও ভদ্র বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানকে ধমকের সাথে থাক্কা দিয়ে গাড়িতে তুলে পুলিশ জর্জ অরওয়েলের ‘ওশেনিয়া’ রাষ্ট্রের থট পুলিশের ভূমিকাই পালন করেছে। বাংলাদেশের পুলিশ ‘বিগ ব্রাদার’-এর কথামতো সব ধরনের শিষ্টাচার ভুলে সবার সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করছে। তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য স্পষ্ট ম্যাসেজ হলো, বিগ ব্রাদারের অঙ্গুলির হেলনি-দোলুনির বাইরে কেউ কিছু করতে পারবে না।
জর্জ অরওয়েলের কল্পিত ‘ওশেনিয়া’ রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার সীমানা ছিল ‘প্রোপাগান্ডা’ পর্যন্ত। সেখানে যত্রতত্র থাকে ‘চার্লিংটন’ নামের নজরদারি কর্মী দল। সঙ্গত কারণেই। এই সীমা অতিক্রম করলে বিপদে পড়তে হয়। সীমার ভেতর থাকলে পুরস্কার ও উপহার আছে। কেউ সেখানে খুব একটা বিপদে পড়তে চায়ও না। বিপদ মানে কারাগার, নির্যাতন, চিন্তাশক্তি নষ্ট করার ব্যবস্থা। সেখানে ভয়ে কেউ মন খুলে কথাও বলতে পারে না। আর এ অবস্থা কায়েম করতে পুরো দেশে একটা ভীতির আবহ তৈরি করে রাখে ‘বড় ভাই’ ও তার লোকজন। বড় ভাইয়ের নজরদারির ব্যবস্থা নাগরিকদের স্বাধীন চিন্তাচর্চা থামাতে সফল হয় ওশেনিয়ায়। আমাদের দেশে গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, ব্যক্তিমাত্রই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তাশক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা জর্জ অরওয়েলের কল্পিত ওশেনিয়া রাষ্ট্রের সাথে মিলাতে গেলে একই ফলাফল পাই।
আমরা আজকে এমন একটি রাষ্ট্রে বসবাস করছি, যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তা বলতে কিছু নেই। সবাই পুরস্কারের আশায় যা করার সবই করছে। রাষ্ট্রের জনগণের, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের কথা কেউ চিন্তাও করছে না। জয়গান, জয়ধ্বনি এক শাসক, এক দলের খুশি হওয়াকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। সেই জায়গা থেকেই বিরোধী দলকে এক কামরায় বন্দী করে রাখার বাসনা জাগে। কিন্তু এটিও সত্য, যে সিনেমার গান উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেই সিনেমার নায়ক-নায়িকাকে কিন্তু পরের দিন সকালে তালা খুলে বের করা হয়েছে এবং শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাদের ভালোবাসার জয়ও হয়েছে। বিএনপি অফিসের তালাও ভাঙা হয়েছে। আশা করি, গণতন্ত্রের বিজয় দিয়েই লাখো কোটি জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা