২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হই

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হই - ফাইল ছবি

বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এ দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। স্বাভাবিকভাবেই এ দেশে রয়েছে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিশাল এক বাজার। ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশকে করেছে আরো বেশি দামি ও প্রয়োজনীয়। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগতভাবে এ দেশের ভূমি কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী।

বাংলাদেশের বিশাল উপকূলজুড়ে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবারিত এক সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশের সামনে রয়েছে নীল- ইকোনমিতে এগিয়ে যাওয়ার বিরাট এক হাতছানি। এ দেশের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে তেল, গ্যাস ও কয়লাসহ অতি প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান খনিজপদার্থের বিশাল এক সমাহার। প্রকৃতির দান সুন্দরবন বাংলাদেশকে বিশ^ মানচিত্রে আলাদা একটি পরিচিতি দান করেছে। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সম্বলিত স্থান এ দেশের পর্যটন খাতকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে। সব মিলিয়ে আমার প্রিয় বাংলাদেশ যেন অফুরন্ত সম্ভাবনার একটি জনপদ। এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে চাই আরো বহুদূর।

বাংলাদেশের নিকটতম ও বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের অবস্থান। বাংলাদেশের সাথে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। আয়তন, জনসংখ্যা, সামরিক বাহিনী- সবদিক দিকেই ভারত একটি বৃহৎ দেশ। ভারতের হাতে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই ভালো থাকে, এখনো আছে। ভারত তার সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত রাজ্যগুলোতে মালামাল পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত অনুমতি পেয়েছে। বাংলাদেশ কয়েক বছর থেকেই ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। সুন্দরবনের রামপালে ভারত যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ভারত কর্তৃক সীমান্ত হত্যা এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এবং তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত এখনো কোনো চুক্তি করেনি।

ভারতের মতোই চীন বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী দেশ। কিন্তু চীনের সাথে বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত নেই। চীন ও বাংলাদেশের মাঝখানে ভারতের সেভেন সিস্টার্স-খ্যাত রাজ্যগুলো অবস্থিত। আয়তন, জনসংখ্যা ও সামরিকবাহিনীর দিক দিয়ে চীন বিশাল একটি দেশ। চীনের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সেখানে বসবাস করে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। ভারতের মতো চীনও পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ একটি দেশ। চীন জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশ। চীনের অর্থনীতি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সর্বদা বিকাশমান। চীনের উৎপাদিত পণ্য সারা পৃথিবীর বাজার দখল করেছে। রফতানির ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান এখন পৃথিবীর শীর্ষে। পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে চীন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই চীনের মতো একটি শক্তিশালী দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা যেকোনো দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য যেমন অত্যন্ত সহায়ক, ঠিক তেমনিভাবে তার শত্রুতা ও অসহযোগিতা যেকোনো দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য বিরাট এক হুমকি।

বাংলাদেশের সাথে চীনের বরাবরই সুসম্পর্ক বিরাজমান। বাংলাদেশের অনেক বড় বড় প্রকল্প চীনের সহায়তায় নির্মিত হয়েছে। চীনের প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতু এবং চট্টগ্রামের কর্র্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করেছে। এখন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীন নির্মাণ করছে চায়না অর্থনৈতিক জোন। আমরা আশা করব, অতীতের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নে চীন আরো বেশি সহায়তা করবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও ক্ষুদ্র একটি দেশ হলেও ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ দেশের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী চীন ও ভারত পরস্পর শত্র“ভাবাপন্ন। সীমান্ত সমস্যা, তিব্বত সমস্যা ও শক্তি প্রতিযোগিতার কারণে ভারত-চীন পরস্পর বৈরিভাবাপন্ন। এক কথায়, দীর্ঘদিন থেকেই চীনের সাথে ভারতের অঘোষিত একটি দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ চলছে। আবার বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথেও চীনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। ভারতের চিরশত্র“ ও প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান হচ্ছে চীনের পরম বন্ধু এবং মিত্র। ফলে ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্ক গড়া এবং রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্ক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ঠিক একই ভাবে চীনের সাথে বাংলাদেশের বেশি ঘনিষ্ঠতা যেমন ভারতের অপছন্দ, তেমনি ভারতের সাথে মাখামাখিও চীনের অপছন্দ। এসবই কিন্তু বাস্তবতা। বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যে ঐক্য এবং দূরত্ব, শত্র“তা ও মিত্রতা, তার মাপকাঠি কিন্তু এই সম্পর্কের সমীকরণ। এর ভিত্তিতেই মেরুকরণ এবং বিভাজন চলছে। মূলত এই নিয়মেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখানে আদর্শ কোনো ফ্যাক্টর নয়। রাশিয়া যে পথে চলে যুক্তরাষ্ট্র চলে তার বিপরীতে। যুক্তরাষ্ট্রের শত্র“ বলেই চীন, রাশিয়া, ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানের ভালো সম্পর্ক। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শত্র“ বলেই সিরিয়ার সাথে চীন, রাশিয়া ও ইরানের ভালো সম্পর্ক।

বাংলাদেশের সাথে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক এই বাস্তবতার বাইরে নয়। সুতরাং বৃহৎ ও পরস্পর বৈরিভাবাপন্ন দুই রাষ্ট্র চীন এবং ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সাবধানে পথ চলতে হবে। কোনো ধরনের আবেগ নয় বরং বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে সম্মান করতে হবে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার অবস্থান ঠিক রাখতে হবে এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে। অপরের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, ঠিক তেমনি নিজের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও সুরক্ষিত করতে হবে। নিজের অবস্থান অক্ষুণ এবং সুদৃঢ় করে তবেই ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। স্বকীয়তা কখনো বিসর্জন দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যালেন্স অব পাওয়ার ও ব্যালেন্স অব রিলেশন বজায় রাখতে হবে এবং কারো বিরাগভাজন হওয়া যাবে না। বৃহৎ শক্তিকে কৌশলেই হ্যান্ডেল করতে হবে এবং সাবধানে এগোতে হবে। আমরা চাই সবার সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, ভারত ও চীন উভয় রাষ্ট্রের সাথেই আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হবে এবং সেটি সম্ভব। যদি আমরা আমাদের স্বকীয়তা অক্ষুণ রাখি এবং এরপর যুক্তি তর্কের সাথে সামনে অগ্রসর হই তাহলে সেটি অবশ্যই সম্ভব। আর সেই সম্পর্কের ভিত্তি করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। যদি সেই সম্পর্কের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশ যেন ভারত ও চীনের দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত না হয়। আমরা আশা করব, সরকার এ ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে এবং ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে আমরা সবার সহযোগিতা ও বিনিয়োগ চাই।
বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিজস্ব স্বার্থ ও স্বকীয়তা অক্ষুণ রেখে সবার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং সবার কারিগরি, প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement