২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অর্থনীতির ক্ষত চিহ্নিত, সমাধান কখন

অর্থনীতির ক্ষত চিহ্নিত, সমাধান কখন - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতির আলোচিত বিষয় হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এছাড়া চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা। ডলার বাজারে স্থিরতা আনা, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধি করা, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রফতানি বাজার ঠিক রাখা, অর্থ পাচার, সিন্ডিকেট দমন, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও জ্বালানি তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান পাঁচটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়। এখানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে জ্বালানি স্বল্পতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য ঝুঁকিগুলো হলো উচ্চমূল্য, প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া? সম্পদ ও আয় বৈষম্য, সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। শিল্প খাতের বড় সমস্যা হলো চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকা। অন্য দিকে ক্ষুদ্র বাজারি শিল্পগুলো চাহিদা মতো গ্যাস পাচ্ছে না। একই সাথে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। শিল্পের সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, তার মানে বেকারত্ব বৃদ্ধি প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।

অর্থনীতিতে ক্রমাগতভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাবে নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তসহ সবাই বড় কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ও প্রভাবও রয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রভাব এর মধ্যে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির দাবি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। পরোক্ষ প্রভাব হলো উচ্চমূল্য স্ফীতি কারণে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ বিরোধী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার মুখে পতিত হওয়া। উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে লেনদেনের ভারসাম্য থাকে না। ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র এলসি খুলতেও সমস্যা হয়, রফতানিকারকদের রফতানিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়?

গবেষণায় দেখা যায় বর্তমানে অর্থনীতিতে বড় ক্ষত হলো বৈষম্য ও দুর্নীতি। দেশের বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিতে সম্পদ ও আয় উভয়ের মধ্যে বৈষম্য উন্নতম ঝুঁকির কারণ। সিপিডির গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চ আয় বৈষম্য থাকলে নিম্ন মাধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তেমন বাড়ে না। সমাজে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের হাতে সম্পদ ও অর্থ জড়ো হলে তারা অতিরিক্ত অর্থ বেশি ব্যয় করে না। অনেকে অর্থ বিদেশে ব্যয় করেন। মধ্যম শ্রেণীর ভোক্তারা হলো সমাজের মূল ভোক্তা। তাদের আয় না বাড়লে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের গতি কমে যায়? সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। একসময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা দেখা দেয়।

দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সঙ্কট। এতে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পখাতে সব উপকরণ আমদানি করা উৎপাদন ও নতুন শিল্প স্থাপন হ্রাস পেয়েছে। ফলে বেড়েছে সব পণ্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি। কমে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান? সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিলেও শতভাগ মার্জিনে অনেকেই এলসি করলে ডলার সঙ্কটের কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে দেনা শোধ করতে হচ্ছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স কাক্সিক্ষত হারে না আসায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ দিন দিন বাড়ছে। চলমান ডলার সঙ্কটের কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়িয়ে অর্থ ছাড় বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগ ইআরডি সূত্র থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। যার টাকা রূপকে প্রায় ১৭ হাজার ২৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ হয়েছিল ১০৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলার? এসবে তুলনামূলক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে তার মধ্যে সুদ ছিল ৬৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে একই সময়ে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ হয়েছিল তাতে সুদ ছিল ২৭ কোটি ৫১ লাখ ডলার। সুদ পরিশোধে সুদের পরিমাণ সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে। বিশ^ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ডক্টর জাহিদ হোসেনের মতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত যে হারে অর্থ ছাড় হয়েছে পরিশোধ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। তবে যে হারে প্রতিশ্রুতি রয়েছে সেগুলো থেকে যদি ছাড় ঠিকমতো হয় তাহলে সমস্যা হবে না। তবে এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে অর্থ ছাড়ানো হবে না- বিষয়টিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

প্রকল্পের দুর্নীতি অনিয়ম ও অবচয় রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ইআরডির হিসাব থেকে দেখা যায়, আগামীতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে ইআরডির প্রকল্প অনুযায়ী ২০২৬ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সাথে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এর ঋদের পাঁচ বছরের রেয়াত শেষ হয়েছে গত এপ্রিল ২০২৩ এ। ফলে চলতি অর্থবছর এই ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৬ সালের পর মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের আসল পরিশোধ শুরু হবে। তখন বার্ষিক আসল পরিশোধ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যেতে পারে। তাই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ সামাল দেওয়ার জন্য সক্ষমতা বাংলাদেশকে কি অর্জন করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় করোনার পর অর্থনীতি যখন পুনঃরুদ্ধার হচ্ছিল তখন আমদানি বাড়ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ১৯.৫০ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৭.৫২% অথচ বর্তমানে আমদানি কমার কারণে রফতানি শিল্পের কাঁচামালের সঙ্কটে রফতানি খাতে উৎপাদন কমেছে। ফলে রফতানি আরো কমেছে। অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা কমেছে ১ শতাংশ। আমদানি কমেছে ২৫%। বিনিয়োগ কমে গেছে, ঋণ প্রবাহও কমেছে। বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। সরাসরি বৈদেশিক এফডিআই কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় এফডিআই কমেছে চার কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে বেড়ে সর্বোচ্চ চার হাজার ৮০৬ কোটি ডলার উঠেছিল। আমদানি চাপে রিজার্ভ কমতে থাকে। এখন কমে তা দুই হাজার ৫২৭ কোটি ডলারে নেমেছে। ডলারের দাম ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে। ডলার সঙ্কটের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও টাকার মান কমায় মূল্যের হার বেড়ে চলেছে। বর্তমানে তা বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশের ঠেকেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হার বেড়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশে উঠেছিল চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে। অল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়ে চলেছে। জনগণ এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। তাই মূল্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

বাজার নজরদারিতে প্রযুক্তি সহায়তা আনতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি আমাদের রাজনীতিবিদদের সততার চর্চা বাড়াতে হবে এবং সরকারি আমলানির্ভরতা কমাতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। আমাদের রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। যারা বাইরে যাচ্ছে তাদের সহায়তা দিতে হবে। আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ উৎপাদনমুখী ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা, নিষ্ঠার যে অভাব রয়েছে তা পূরণ করতে হবে। উন্নয়নের বিকেন্দ্রীয়করণ করতে হবে এবং উন্নয়ন হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement