ভাষার মাস ও একুশে বইমেলা
- ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
- ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৪৫, আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৫৯
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের অমলিন স্মৃতি স্মরণের মাস ফেব্রুয়ারি। বাঙালির কাছে এই মাস ভাষার মাস, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার মাস। তাই জাতি নানা আয়োজনের মাধ্যমে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ভালোবাসা জানাবে ভাষাশহীদদের প্রতি।
উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণায় পূর্ববাংলার বাংলাভাষী জনমনে ক্ষোভের জন্ম হয়। জাগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ববাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিককর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ নাম না জানা আরো অনেকে।
এরপর পথ পরিক্রমায় রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। সেই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও একাত্তরে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতাযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এ দিন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হয়।
১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেন। মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার এই সংগ্রামে সেদিন ছাত্র-জনতা একসাথে রাজপথে নেমে পড়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন কমই হয়েছে। সে জন্য ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার মাস নয়, আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হওয়ারও মাস, বাঙালির গর্ব-অহঙ্কারেরও মাস।
শুরুটা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই। পাকিস্তান কৌশলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার ওপর প্রথম আঘাত হানে। মায়ের ভাষায় কথা বলাও তারা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায় উর্দুকে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে একবিন্দু পিছু হটেনি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিদিন রাজপথে চলতে থাকে মিছিল-সমাবেশ। শুরু হয় বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। হানাদারদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণ ঝরে ছাত্র-জনতার। বায়ান্নর আগুনঝরা সে দিনগুলো বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
মূলত সেই দিনগুলোর মধ্য দিয়েই বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আরো বেগবান হয়। তারই সূত্র ধরে এসেছিল ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
এ মাসের প্রথম দিন থেকেই ধ্বনিত হয় সেই অমর সঙ্গীতের অমিয় বাণী- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...’। বাঙালি জাতি পুরো মাসে ভালোবাসা জানাবে তাদের, যারা ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন।
ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগ পৃথিবীতে বিরল। এই আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। তারপর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে বিভিন্ন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বীর সন্তানদের স্মরণ করবে জাতি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবার হয়ে উঠবে জমজমাট। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মাসে আয়োজন করবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের।
অন্যদিকে বইমেলা ২০২৪ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
বরাবরের মতো এবারো পয়লা ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে ভাষাশহীদদের স্মরণে আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সাল অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) হওয়ার জন্য এবারের বইমেলা হতে যাচ্ছে ২৯ দিনের। বইপ্রেমী পাঠক, লেখক, প্রকাশক- সব পক্ষের জন্যই খুশি হওয়ার মতো বিষয় এটি।
বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেবেন একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। এ অনুষ্ঠানেই দেয়া হবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এ বছর ১১টি বিভাগে ১৬ জনকে কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ বা গবেষণা, অনুবাদ, নাটক, শিশুসাহিত্য বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, পরিবেশ বা বিজ্ঞান ক্ষেত্র, জীবনী ও লোককাহিনী ইত্যাদি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ দেয়া হবে।
বইমেলার পরিধি ও বিন্যাস
বইমেলার পরিধি ও বিন্যাস অপরিবর্তিত থাকছে এবার। গত বছর মোট সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে আয়োজিত হয় একুশে বইমেলা। স্টল বিন্যাসের ক্ষেত্রে ফাঁকা জায়গা কম রেখে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাছাকাছি রাখা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন প্রান্তের স্টল সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল উদ্যানের ভেতরের দিকে। এ বছর সে বিন্যাস প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
এবার লিটল ম্যাগ চত্বর নিয়ে আসা হয়েছে মুক্তমঞ্চের পাশে। টিএসসির দিকের গেট দিয়ে মেলায় প্রবেশ করলে হাতের ডানে একেবারে শুরুতেই পাওয়া যাবে এই চত্বর। বাঁ দিকে এবার কোনো স্টল থাকছে না। অন্যদিকে মন্দিরের ফটক দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করলেই পাওয়া যাবে শিশু চত্বর।
এবার মেলায় ৫৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৮৯৫টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮৬টি সাধারণ স্টল ও ১০৯টি স্টল লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে দেয়া হবে। তা ছাড়া এ বছর মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বছর ৬০১টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। বইমেলা এলাকায় নিখুঁত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে যথারীতি। বইমেলার ভেতরে ও বাইরে পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এ ছাড়া মেলার মাঠ ও এর আশপাশ সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে।
প্রতি বছরের মতো এবারো মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে পাওয়া যাবে নতুন বইয়ের খবর। মেলা চলাকালে প্রতিদিন থাকবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা। ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে থাকছে বই নিয়ে লেখক-পাঠকের মতবিনিময়।
ইতিহাসের পাতায় বইমেলা
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সাথে আরো অনেকে যোগ দেন।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এ বইমেলার সাথে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলার। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে।
ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্য দিকে, আছে এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেটি ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের গৌরব।
লেখক : কলামিস্ট। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান,
জাতীয় রোগী
কল্যাণ সোসাইটি
ইমেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা