২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ফেরাউনের শেষ দিন

ফেরাউনের শেষ দিন - ছবি : সংগৃহীত

দুনিয়াতে যুগে যুগে বহু অত্যাচারী, খোদাদ্রোহী শাসকের জন্ম হয়েছে, যারা নিজেকে খোদা দাবি করে তাকে উপাস্যরূপে পূজা-অর্চনা করার আদেশ দিয়েছিল জনগণকে। কেউ খোদা দাবিকারী বাদশাহকে খোদা হিসেবে মেনে না নিলে তার উপর চালানো হতো অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ফেরাউন, নমরুদের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা নিজেদেরকে খোদা দাবি করেছিল। এ ছাড়া এমন অনেক অত্যাচারী শাসকের কথা বর্ণনা করেছেন, যাদের জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা ছিল ভয়াবহ। তবে এ ধরনের শাসকদের পরিণতির কথাও পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন, মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা কারুনের জুলুম ও তার শেষ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। কারুন ছিল মুসা আ:-এর সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। আল্লাহ তায়ালা তাকে এত ধনভাণ্ডার দিয়েছিলেন যে, সেই ভাণ্ডারের চাবির গোছা বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। সে আল্লাহর প্রতি শোকর গোজার না করে, দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছিল এবং তার স্বগোত্রের লোকদের প্রতি জুলুম করেছিল। পরিণামে আল্লাহ তাকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিয়েছিলেন।
নমরুদের কথাও আমরা পবিত্র কুরআন থেকে জানতে পারি। নমরুদ প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করেছে। পবিত্র কুরআনে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে সে-ই সর্বপ্রথম রাজমুকুট পরিধান করেছে এবং নিজেকে খোদা দাবি করেছে। নমরুদ রাজার রাজা (কিং অব কিংস) উপাধিতে ভূষিত হয়েছিল। এই খ্যাতি ও সম্মানের শিখরে পৌঁছে নিজেকে দেবতা বলে দাবি করে এবং তার কাছে প্রার্থনা করার আদেশ দেয়, আর তখন থেকেই প্রজারা উপাস্যরূপে তার পূজা ও অর্চনা শুরু করে। তার ঔদ্ধত্য এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সে মহান আল্লাহকে হত্যার উদ্দেশ্যে আকাশে তীর নিক্ষেপ করেছিল। শুধু তাই নয়; নমরুদ আল্লাহর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিলো। অথচ তাকে ও তার সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মশাবাহিনীই যথেষ্ট ছিল। একটি দুর্বল লেংড়া মশা নমরুদের নাসিকাপথে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল। এই লেংড়া মশার দুঃসহ দংশন যন্ত্রণায় ৪০ বছর মাথায় পাদুকা আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছিল।

পৃথিবীতে যত অত্যাচারী ও খোদাদ্রোহী শাসক ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো- ‘ফেরাউন’। অত্যাচারীর উদাহরণ খুঁজতে গেলে সবার আগে আসে তার নাম। ফেরাউন শুধু অত্যাচারী শাসকই ছিল না, সে নিজেকে খোদা দাবি করত, আল্লাহর পরিবর্তে মানুষকে তার ইবাদত ও পূজা করতে বাধ্য করত। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘(হে মুসা!) ফেরাউনের কাছে যাও, সে তো সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং (তাকে) বল, তোমার কি আত্মশুদ্ধির কোনো আগ্রহ আছে? আর আমি কি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের পথ দেখাব, ফলে তুমি তাঁকে ভয় করবে? অতঃপর সে তাকে মহা নিদর্শন দেখাল। কিন্তু সে মিথ্যাজ্ঞান করল ও অবাধ্য হলো। অতঃপর সে পেছন ফিরে প্রতিবিধানে সচেষ্ট হলো। সে সবাইকে সমবেত করল এবং উচ্চস্বরে ঘোষণা করল। আর বলল, আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।’ (সূরা নাজিয়াত, আয়াত : ১৭-২৪) পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘ফেরাউন তার দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র-সন্তানদের হত্যা করত এবং নারীদের জীবিত রাখত। নিশ্চয় সে ছিল অনর্থ সৃষ্টিকারী।’ (সূরা কাসাস, আয়াত-৪)

বাদশাহ ফেরাউন তার উজির হামানের পরামর্শ মতো দুনিয়ার বাদশাহ হওয়ার এবং নিজেকে খোদা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশি উৎসাহিত হয়েছিল। হামানের পরামর্শ মতোই সে রাজ্যের সব পাঠশালা ও মক্তব উঠিয়ে দিয়ে গোটা জাতিকে মূর্খ বানিয়ে রেখেছিল, যাতে করে প্রজারা তাকে খোদা মানতে বাধ্য হয়। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার পর সে প্রত্যেককে একটি করে নিজের প্রতিমূর্তি দিয়ে তাকে সৃষ্টিকর্তা এবং উপাস্য বলে পূজা করতে হুকুম দিলো এবং প্রজারা তার আদেশ মতো ফেরাউনের প্রতিমূর্তিকেই খোদা বলে মানতে শুরু করল। যে তার আদেশ অমান্য করত তার উপর চালানো হতো সীমাহীন অত্যাচারের স্টিম রোলার।

এ সময় আল্লাহ তায়ালা মুসা আ:-এর ওপর ওহি নাজিল করলেন এবং পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্য ধর্মে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব প্রাপ্তির পর একদিন মুসা তার বড় ভাই হারুন আ:-কে সাথে নিয়ে ফেরাউনের দরবারে এসে হাজির হলেন। ফেরাউনকে উদ্দেশ্য করে মুসা আ: বললেন, ‘তুমি যে নিজেকে খোদা বলে প্রচার করছ, তা অত্যন্ত অন্যায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ মানুষের উপাস্য নেই। আমি আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর।’ ফেরাউন তাকে তাচ্ছিল্য করে তার ওপর এবং তার ধর্মে বিশ্বাসীদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালাতে লাগল। যখন ফেরাউনের অবাধ্যতা ও অনাচার চরমে পৌঁছে, তখন নিপীড়িত জনতার আর্তি পৌঁছায় আল্লাহর দরবারে, ‘হে আমাদের রব! এই অত্যাচারীর হাত থেকে আমাদের জনপদকে মুক্তি দাও...।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৭৫)

এ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা মুসা আ:-কে হুকুম করলেন তার অনুসারীদের নিয়ে মিসর ত্যাগ করার জন্য। মুসা আ: আল্লাহর হুকুমে তার অনুসারীদের নিয়ে রওনা হলেন এবং তারা লোহিত সাগরের তীরে এসে পৌঁছে গেছেন। এমন সময় তারা পেছন তাকিয়ে দেখতে পেলেন, ফেরাউনের অগণিত সৈন্য তাদের ধরার জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের পেছনে এই বিপদ, সামনে প্রকাণ্ড লোহিত সাগর। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। এমন সময় মহান আল্লাহ তায়ালা মুসা আ:-কে আদেশ করলেন, মুসা, ‘তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রের ওপর আঘাত করো।’ মুসা আ: মহান আল্লাহর নির্দেশমতো তাই করলেন। বিশাল সাগর দুই ভাগে ভাগ হয়ে দেয়ালের মতো দু’পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সেই পথ দিয়ে মুসা আ: ও তার অনুসারীরা নিরাপদে ওপারে চলে গেলেন। তখনও সাগরের সেই রাস্তা সেভাবেই রয়ে গেল। ফেরাউন তার লোকজন ও সৈন্যসামন্তসহ ওপারে এসে থামল। সে দেখল, সাগরের মধ্যে একটি আশ্চর্য রাস্তা তৈরি হয়েছে। সে মুসা আ: ও তার লোকজনদের ওপারে পার হতে দেখল। সে মুসা আ: ও তার অনুসারীদের আক্রমণ করতে তার বাহিনী নিয়ে লোহিত সাগরের সেই রাস্তায় নেমে পড়ল। যখন ফেরাউনের বাহিনী সাগরের মাঝামাঝি এসে পৌঁছাল ঠিক তখন মহান আল্লাহ মুসা আ:-কে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি সাগরের ওপরে তোমার লাঠি দিয়ে আবার আঘাত করো।’ মহান আল্লাহর হুকুম মতো মুসা আ: আবারো সাগরের পানিতে আঘাত করলেন, অমনি দুই দিক থেকে পানির খাড়া উঁচু স্রোত ফেরাউন ও তার সৈন্যদের ওপর পড়ে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল ফেরাউন ও তার বাহিনী। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে!’ (সূরা কাসাস : ৩৯-৪০) ফেরাউনের লাশ মিসরের কায়রো জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোর দেহ সংরক্ষণ করব, যাতে তুই তোর পরবর্তীকালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকিস...।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত-৯২)

দুনিয়ার সব জালিম-নির্যাতনকারী শাসক আল্লাহর হুকুমতকে ভুলে গিয়ে নিজের ক্ষমতাকে চিরকালীন টিকিয়ে রাখার বাসনা থেকে নিজ দেশের জনগণের উপর অত্যাচার-জুলুম-নির্যাতন করে থাকে। তারা বুঝতে চায় না, এক সময় তাদেরকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। আমরা নমরুদ, ফেরাউন, কারুনদের পরিণতির ইতিহাস যেমন পড়েছি, তেমনি বর্তমান জামানার হিটলার, মুসোলিনি, গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেনদের করুণ পরিণতিও দেখেছি। এই যুগের হামানদের পরামর্শ নিয়ে যদি কেউ তার নিজ দেশের জনগণের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে প্রভু সেজে বসে থাকার চিন্তা করে তাহলে তাদের পরিণতিও ফেরাউন, নমরুদদের মতোই হবে।

ফেরাউন সমুদ্রের তীরবর্তী যাওয়া পর্যন্ত সে জানত না এটিই তার জন্য শেষ দিন। সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জালিম, অত্যাচারী, খোদাদ্রোহী, নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। মানুষের সামনে উদাহরণ হিসেবে তার লাশ কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় থেকে যাবে, যা দেখে মানুষ শিক্ষা নেবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- ‘অতএব, আজকের দিনে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত-৯২)

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement