আঞ্চলিক যোগাযোগ: প্রসঙ্গ থেগামুখ
- মোহাম্মদ আজিজুল হক
- ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:২০
২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, দেশের ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফরকালে অনেক সিদ্ধান্তের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির সুবিধার্থে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন ‘রামগড়’ ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন ‘থেগামুখ’ এলাকায়, পৃথক দু’টি এলসি স্টেশন/স্থলবন্দর চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; যার মধ্যে প্রথমটি ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্য এবং অপরটি মিজোরামকে সংযুক্ত করার কথা। ওই সিদ্ধান্তের মধ্যে নিজ নিজ দেশের উপকারপ্রাপ্তির লক্ষ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘রামগড়’কে এলসি স্টেশন/স্থলবন্দর হিসেবে চালু করায় তাদের অতিরিক্ত আগ্রহ দেখায়; আর বাংলাদেশ পক্ষ ‘থেগামুখ’কে এলসি স্টেশন/স্থল বন্দর করার বিষয়ে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে।
এরই ধারাবাহিকতায়, ওই বছরই (২০০৯) রামগড় ও থেগামুখকে এলসি স্টেশন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরকারি আদেশ জারি করে, থেগামুখ এলাকায় কিছু বাঁশের ঘর তৈরি করার মাধ্যমে, প্রাথমিক কার্যাদি সমাপ্ত করা হয়।
এরপর ২০১০ সালে বর্ণিত থেগামুখ এলসি স্টেশন বাদ রেখে শুধু রামগড় এলসি স্টেশনকে স্থলবন্দরে উন্নীত করে, এতদসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রজেক্ট ডিরেক্টর বা পিডি নিয়োগ দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ২৫ অক্টোবর ২০১৮ পণ্যাদি পরিবহনে বাংলাদেশের দু’টি সমুদ্রবন্দর তথা চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ধারাবাহিকতায় রামগড় স্থলবন্দর দিয়ে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সংশ্লিষ্ট পণ্যাদি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রোমে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বর্তমানে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক মানের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল তৈরি করে এর অভ্যন্তরে বিজিবি চেকপোস্ট, কাস্টমস ইমিগ্রেশন অফিস স্থাপনসহ, এতে প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা রেখে এককেন্দ্রিক সেবা গ্রহণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অতি দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ ছাড়া ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে, রামগড়ের ‘মহামুনি’ নামক স্থানে, এ বন্দরের জন্য ৪১২ মিটার দীর্ঘ এবং ১৪.৮০ মিটার প্রশস্ত একটি ব্রিজ, আন্তর্জাতিক নদী ফেনীর উপর ইতোমধ্যে তৈরি সম্পন্ন করা হয়েছে; যা ২০২১ সালের শুরুর দিকে এক ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ-১’ নামে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেন। একই সাথে ১১০৭.১২ কোটি টাকা ব্যয়ে রামগড় থেকে হেঁয়াকো হয়ে চট্টগ্রামের বারোইয়ার হাট পর্যন্ত বিদ্যমান আঞ্চলিক সড়ক প্রশস্ত করার কার্যক্রমও হাতে নেয়া হয়েছে। এতে ভারতীয় সরকারের লাইন অব ক্রেডিটের (এড়া-খঙঈ) আওতায় ৫৯৪.০৭ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট অর্থ (৫১৩.০৫ কোটি টাকা) বাংলাদেশ ব্যয় করছে। ৩৮ কিলামিটার দীর্ঘ এ সড়কের জন্য নির্ধারিত কার্যাবলির মধ্যে ৯টি সেতু (মোট দৈর্ঘ্য ২৪১.২০ মিটার), ২৩টি কালভার্ট (মোট দৈর্ঘ্য ১০৮ মিটার), আরসিসির ট্রেইনিং ওয়াল নির্মাণ তিন হাজার ৮০০ মিটার, সসার ড্রেইন নির্মাণ ৩০ হাজার মিটার, আরসিসি ইউড্রেন নির্মাণ ১০ হাজার মিটার, সড়কের প্রশস্ততা ১১.৩০ মিটার, সর্বোপরি ৬৮.৬১ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের কার্য নির্ধারিত রয়েছে।
উল্লেখ্য, ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুসারে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার, আঞ্চলিক/জেলা মহাসড়ক, উন্নয়ন/পুনর্বাসন সাড়ে ৩৭ হাজার মিটার সেতু/কালভার্ট নির্মাণ, ৩৭৫ কিলোমিটার রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের অংশবিশেষ বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য তিনটি পূর্ত প্যাকেজ এবং নির্মাণকাজ তদারকির জন্য একটি পরামর্শকসেবা প্যাকেজ রয়েছে। বিবেচ্য ঢ়ষি-২ পূর্ত প্যাকেজের আওতায় ২২.৭০ কিলোমিটার সড়ক (৫.৫০ মিটার থেকে ১১.৩০ মিটার প্রশস্ততায়) প্রশস্তকরণ, ১৩.৮০ কিলোমিটার সড়ক উঁচুকরণ, ১.৫০ কিলামিটার রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করা হবে।
আশা করা হচ্ছে, ওই প্রকল্পটি প্রতিবেশী দেশের সাথে আমদানি-রফতানির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে ‘বাংলাদেশ-ভারত’-এর ব্যবসায়-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে; যাতে সাব্রোম (ত্রিপুরা) ও রামগড় (খাগড়াছড়ি) স্থলবন্দর; উভয় দেশের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে শিল্প সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। প্রস্তাবিত সড়কটির এ দেশীয় অংশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের মিরেশ্বরাইয়ের বারোইয়ার হাট থেকে শুরু হয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে পৌঁছে শেষ হয়েছে। রামগড় স্থলবন্দরটি, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০৮ কিলোমিটার ও রাজধানী ঢাকা থেকে ২০৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ কারণে প্রাসঙ্গিক প্রকল্পটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও ঢাকার সাথে, রামগড় (খাগড়াছড়ি) স্থলবন্দর, সাব্রোমের (ত্রিপুরা রাজ্য) সংযোগ স্থাপন হবে এবং এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক সমৃদ্ধি বেগবান হবে। ফলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সাথে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলসহ সারা দেশের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপিত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে রামগড় দিয়ে পণ্যাদি ‘আনা-নেয়া’ আরম্ভ হলে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের ব্যবসা ১৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রকল্পটি পুরোপুরি শেষ হতে আরো প্রায় এক বছর সময়ের প্রয়োজন হতে পারে বলে জানার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার আগেই অস্থায়ীভাবে এ স্থলবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্ট কার্যাদি শুরু করার জন্য বাংলাদেশের কাছে অনুরোধ করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আগামী জুন মাস থেকে কার্যক্রম শুরু করার আশ্বাস দেয়া দিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অতি আগ্রহ ও বাংলাদেশের সম্মতিতে ‘রামগড়’ স্থলবন্দরকে নিয়ে যখন এত বেশি কর্মচাঞ্চল্য চলছে, তখন উত্তর-পূর্ব ভারতের অপর রাজ্য মিজোরামের ‘দেমাগ্রি’ পয়েন্টে বাংলাদেশের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী, বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন ‘থেগামুখ এলসি স্টেশন’টিকে, স্থলবন্দরে উন্নীত করা তো দূরের কথা, উল্টো সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, ওই এলসি স্টেশনটিকে ‘নন অপারেটিভ’ ঘোষণা করা হয়েছে। এহেন পটভূমিতে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, রামগড়কে অতি দ্রুত ভারতের সাথে যোগাযোগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করার বিপরীতে থেগামুখ এলসি স্টেশনকে ত্যাগ করা যুক্তিসঙ্গত হবে কি না।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, উভয় দেশের ‘উইন-উইন’ অবস্থা অক্ষুণœ রাখা, ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত সাত রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ তথা মিজোরামের সাথে এ দেশের সরাসরি যোগাযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় থেগামুখ এলসি স্টেশনটিকে যত দ্রুত সম্ভব স্থলবন্দরে উন্নীতকরণ এবং এটিকে অপারেটিভ ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা