আধামরা গণতন্ত্র জাগবে কবে
- সুরঞ্জন ঘোষ
- ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩২
লেখাটি গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। বিএনপিসহ এর জোট সাথীরা নির্বাচন বর্জন করেছে। বিএনপির এবারের আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু সরকারি দল সে দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখল, এতে কি গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে? আমরা আন্দোলন করে এরশাদের পতন ঘটিয়েছিলাম, এখন এরশাদের জাতীয় পার্টি নিয়ে সরকার ভাগাভাগির নির্বাচন করল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যারা আত্মদান হয়েছেন তাদের আত্মার অবমাননা করা হলো। দেশবাসীর প্রশ্ন- আধামরা গণতন্ত্র জাগবে কবে?
বাংলাদেশের গণতন্ত্র যেন সোনার হরিণ। এ দেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্র প্রায় অধরাই রয়ে গেছে। অনেক সাধ্য-সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষায় ক্ষণিকের জন্য ধরা দিলেও আবার মিলিয়ে গেছে। সে কারণেই স্বাধীনতার এত বছর পরও সেই গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে নতুন করে লড়াই করতে হয়। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে নানা প্রকার নসিহত শুনতে হয়। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ করতে হয়। অথচ এই গণতন্ত্রের জন্যই এ দেশের মানুষ পাকিস্তান আমলের পুরো সময়জুড়ে একের পর এক সংগ্রাম করেছে। শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্রকে যখন আবার হত্যা করা হয়েছে, তখনো সেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এ দেশের মানুষ দিনের পর দিন সংগ্রাম করেছে। গণঅভ্যুত্থানের নতুন ইতিহাস রচনা করে আবার গণতান্ত্রিক এ ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে। কিন্তু তারপরও সেই গণতন্ত্র এ দেশের মাটিতে কার্যকর ভিত্তি নিতে পারেনি। নির্বাচন ও গণতন্ত্র অচিরেই সোনার হরিণ হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে শোষণ বঞ্চনার হাতিয়ার। অবশ্য বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ওপরতলার ৫ শতাংশ লোকই গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করে, বাদবাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ ওই ‘গণতন্ত্র’ দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয় মাত্র। কিন্তু তারপরও বুর্জোয়া গণতন্ত্র নিজের কারণেই মানুষকে এমন কিছু অধিকার দেয় যার স্বপ্ন দিয়ে ওই বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সে নিজেকে সংগঠিত করতে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, ওই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আবাসন ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও অংশগ্রহণ করতে পারে। এ কারণেই বুর্জোয়া ব্যবস্থার ওই সীমিত গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য এ দেশের মানুষ বারবার লড়াই করে। কিন্তু সেই লড়াইও কোনো পরিণতি লাভ করতে পারেনি, পারছে না। এ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অধঃপতিত হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ, পরিবারতন্ত্রের সামন্তযুগীয় ব্যবস্থায়, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের নিষ্ঠুর পঙ্ক চক্র।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তাকে স্থিতি দিতে নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি অধরা থেকে যাবার কারণগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে এবং তার পথ নির্দিষ্ট করতে হবে। তা হলেই কেবল এ দেশে গণতন্ত্র যে সঙ্কটের আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে তার থেকে উদ্ধারের পথ পাওয়া যাবে। সংসদীয় ব্যবস্থার সার্থকতার ভিত্তিমূলে রয়েছে সংসদীয় সংস্কৃতি (Parliamentary Culture)। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে অগ্রসর হয়। পারস্পরিক আস্থা ও কর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই এক জীবন প্রাণবন্ত থাকে। রাজনৈতিক দল এই ‘পারস্পরিক আস্থা’ এবং কর্মবিশ্বাস প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রতীক। দলের মতো ক্ষুদ্রতর সামাজিক এককে আস্থা এবং বিশ্বাসের যে কুঁড়ি প্রচ্ছন্ন থাকে, তাই কালে প্রস্ফুটিত হয়ে পুরো সমাজে বিশ্বাসের এক অনাবিল সৌরভ ছড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সমাজে রাজনৈতিক কৃষ্টির বেশ কয়েকটি উপাদান সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ব্যাপক উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে অন্যদের সন্দেহের চোখে দেখা, ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য অপরের প্রতি ঈর্ষা, সমষ্টিগত প্রজ্ঞার পরিবর্তে ব্যক্তিগত বুদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ, ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সমষ্টিগত পর্যায়ে টেনে আনা এ দেশের রাজনৈতিক কৃষ্টির প্রধান প্রধান উপাদান। উন্নত বিশ্বে রাজনীতি হলো সমস্যা সমাধানের মাধ্যম, কিন্তু এ দেশে রাজনীতিকে দেখা হয় ব্যক্তিগত প্রবৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে, প্রভাব-প্রতিপত্তি-বৈভব অর্জনের পন্থা হিসেবে। ক্ষমতায় এসে নেতারা কোনো সময় এ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাজনৈতিক নেতা হলেন প্রতিনিয়ত জনসেবায় রত একজন যোগাযোগকারী। এ দেশে রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পরম পরাক্রমশালী আদেশ দানকারী, নয় তো ক্ষমতা দখলে প্রয়াসী ভিন্ন কলাকৌশলে পারদর্শী ব্যক্তি। গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হলো সার্বিক কল্যাণের জন্য ব্যাপক দায়িত্ব। এ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যক্তিগত প্রকৃতির সিংহদ্বারে প্রবেশের সরল রাজপথ। এ দেশের রাজনৈতিক কৃষ্টি তাই রাজনৈতিক দলের বিকাশের পথ যেমন করেছে রুদ্ধ, অপরিণত দলের নেতৃত্বের রাজনীতিও হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক, সঙ্ঘাতময়, ক্ষমতানির্ভর এক অভিলাষ দায়িত্বহীন এ দেশে কোনো নেতা ভুল করে ভুলের জন্য অনুতপ্ত হন না, স্বাধিকার স্বীকার করে না। জনগণের সাথে তাই অকৃত্রিম দরদ ভরা সম্পর্ক তারা কোনো দিন গড়তে পারে না। ফলে নির্বাচনে যে ফল হয় তার যতটুকু ইতিবাচক তার চেয়ে অধিক নেতিবাচক। কাকে ভোট দেয়া ভালো, কাকে দেয়া ভালো নয় তা প্রাধান্য লাভ করে নির্বাচনে।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে স্থিতিশীল করতে তাই প্রয়োজন ক্ষমতাসীন দলের এমন দৃষ্টিভঙ্গি যা বর্তমানকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার শত দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে। আমার মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল পালন করতে পারে হৃদয়বান এক মালির ভূমিকা। শত ফুল ফোটাতে মালি যেমন ক্ষেত্রটিকে উত্তমরূপে কর্ষণ করেন, উর্বর করার জন্য দেহ-মন ঢেলে দেন, ছোট্ট চারাগুলোকে অন্তরের সব উষ্ণতা দিয়ে লালন করেন এবং অপ্রয়োজনীয় আগাছা নির্মূল করে দিন গুনতে থাকেন কখন ফুলে ফুলে সুন্দর বাগানটি হেসে উঠবে, ক্ষমতাসীন দলকে তেমনি বর্তমানকে ছাপিয়ে রঙিন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির প্রয়াসেও উদ্যোগী হতে হবে, উদার এবং সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
ক্ষেত্র শব্দটি অনেকের কাছে সুপরিচিত হলেও তার প্রকৃত অর্থ অনেকেই বুঝতে পারেন না। বিভিন্ন দেশে দেখা স্বৈরাচারী প্রশাসন একনায়কের সরকার, অথবা সামরিক সরকার দাবি করেছে তাদের পেছনেও জনসমর্থন আছে এবং তারা গণতান্ত্রিক লেবাস পরেছে। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র কী সেই বিষয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদরা তাদের মত প্রকাশ করেছেন। প্রাচীন এথেন্সের পেরিক্লিস থেকে শুরু করে বর্তমান চেকোস্লোভাকিয়ার ভাকলাভ হাভেল পর্যন্ত এবং ১৭৭৬-এ টমাস জেফারসনের আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে শুরু করে ১৯৮৯-এ রাশিয়ান বিজ্ঞানী আন্দ্রে সাখারভ পর্যন্ত সবাই প্রকৃত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইংরেজি ডিকশনারিতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে : গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের দ্বারা গঠিত একটি সরকার যেখানে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছে জনগণের ওপর এবং সে ক্ষমতা প্রয়োগ করছে সরাসরিভাবে জনগণ অথবা প্রত্যক্ষভাবে জনগণের প্রতিনিধিরা, যারা নির্বাচিত হয়েছেন একটি অবাধ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষায়, গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের সরকার, জনগণ দ্বারা গঠিত এবং জনগণের জন্য (Democracy is a government of the people, by the people and for people)
মুক্তি এবং গণতন্ত্র-এ শব্দ দু’টি প্রায়ই পাশাপাশি ব্যবহৃত হলেও দু’টি এবং কয়েকটি নীতির অর্থ এক নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তি বিষয়ে কিছু চিন্তাধারার সমষ্টি। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে আরো বেশি কিছু বোঝায়। গণতন্ত্রে রয়েছে সর্বত্র বাস্তব কিছু কর্মপদ্ধতি যেগুলো রূপ নিয়েছে যুগে যুগে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সংক্ষেপে বলা যায়, গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ অর্থাৎ মুক্ত থাকার জন্য দরকার একটি গণতন্ত্র। এই কারণেই যেকোনো সমাজে প্রকৃত গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি সাংবিধানিক সরকার, মানবাধিকার এবং আইনের চোখে সবার সমতা।
গণতন্ত্রকে দু’টি মূলভাগে বিভক্ত করা যায় : প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এর প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র।
গণতন্ত্রের স্তম্ভ এগুলো-
* জনগণের সার্বভৌমত্ব
* যারা শাসিত হবেন তাদের অনুমতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারের ভিত্তি
* সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন
* সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকার
* মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার গ্যারান্টি
* অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
* আইনের চোখে সমতা
* আইনের শাসন
* সরকারের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা
* সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বহুমত
* সহিষ্ণুতা, বাস্তবমুখিতা, সহযোগিতা এবং সমঝোতা একটি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচিত অথবা
নিযুক্ত কোনো মধ্যস্থতা ছাড়া জনগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারে। কিন্তু লোকসংখ্যা কম হলে, যেমন একটি ছোট দেশে অথবা একটি ইউনিয়নে, যেখানে একটি হলে বা একটি রুমে সবাই বসে আলোচনা করতে পারে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন প্রাচীন বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্রে নাগরিকরা একটি অ্যাসেম্বলিতে মিলিয়ে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারতেন।
তবে এটি মনে রাখতে হবে, একটি গণতান্ত্রিক সরকার একটি গণতন্ত্রের একাংশ মাত্র। একটি গণতন্ত্রে তার সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক চর্চা চলার কথা। রাজনৈতিক পার্টি, সাংস্কৃতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক রীতি থাকতে হবে। এদের অস্তিত্ব, বৈধতা ও কর্তৃত্ব নির্ভর করবে এদের গণতান্ত্রিক মানের ওপর-সরকারের ওপর নয়। গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস ও নিষ্ঠার পরও এত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর সেই গণতন্ত্র কেন অধরা রয়ে যাবে এ দেশের মানুষের জন্য? কেনই বা ওই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এ দেশের মাটিতে ভিত্তি নিতে পারছে না। এর সমস্যা ও সঙ্কটটি কোন জায়গায়? বস্তুত এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে এখন সে কথা বলা হচ্ছে অর্থাৎ শাসনব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করার নামে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে অর্থনীতিতে ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার নামে গণতন্ত্রকে নতুন নতুন নামে অভিহিত করে এমন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হবে যাতে এ মানুষকে গণতন্ত্রের জন্য আবারো দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট, নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা
সভাপতি : সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা