রামমন্দির : মুসলমানদের আরো এক অগ্নিপরীক্ষা
- মাসুম মুরাদাবাদী
- ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:৫৯
জানুয়ারির ২২ তারিখ যতই কাছে এগিয়ে আসছে, ততই হৃদকম্পন বেড়ে চলেছে। রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করার জন্য বিজেপি সব শক্তি নিয়োগ করেছে। এ প্রতিক্রিয়া দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, রামমন্দির সব হিন্দুস্তানিদের আস্থার কর্মসূচি। সবাই জানেন যে, এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন মাথায় রেখে করা হচ্ছে। আর এর মৌলিক উদ্দেশ্য ভোট তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ কথাও সবাই জানেন যে, রামমন্দির শুরু থেকেই বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা। এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু দেশের জনগণকে ক্রমাগত ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে যে, এটা হিন্দুস্তানি ঐতিহ্য জীবিত করার প্রচেষ্টা। এর উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, এতে স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় মুসলমানদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের শুধু রামমন্দিরকে সহায়তা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা নয়, বরং তাদের এর ইন্ধন বানানোরও চেষ্টা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে লক্ষেèৗতে এমন দু’টি হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা মুসলমান নাম দিয়ে নকল আইডি বানিয়ে রামমন্দির উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। জুবায়ের খাঁ ও আলম আনসারি নাম দিয়ে ইমেইল আইডি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তের পর জানা গেল যে, মূলত ওম প্রকাশ ও তাহার সিংই ইমেইল প্রেরণ করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের বৃত্তবন্দি করা। বলা হচ্ছে, এ পুরো বিষয়টির মাস্টারমাইন্ড দেবেন্দ্র তেওয়ারি। যিনি কিছু দিন আগে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সরকারের কাছে ইসরাইল যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। রামমন্দির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাথে মুসলমানদের জোরপূর্বক যুক্ত হওয়ার জন্য আরএসএস-এর এক নেতা এ কথাও বলেছেন যে, ২২ জানুয়ারি মুসলমানরা মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব ও দরগাতে ‘জয় শ্রীরাম’ জপ করবে। আরএসএস-এর অঙ্গসংগঠন রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চের আহ্বায়ক ইন্দ্রেশ কুমার এ কথা বলেছেন। অসম্ভব নয়, কিছু বিশ্বাসঘাতক শুধু নামের মুসলমান এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে নিজেদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশও করবে।
২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান সফল করার জন্য সংঘ পরিবারই শুধু নয়, বরং সমগ্র সরকারি দফতরও এতে নিয়োজিত আছে। এটা তো ভিন্ন কথা যে, একজন সেক্যুলার প্রধানমন্ত্রীর এসব করা উচিত কিনা? তবে এও এক বাস্তবতা যে, যখন থেকে সুপ্রিম কোর্ট রামমন্দিরের পথ সুগম করে দিয়েছেন, তখন থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে অস্বাভাবিক খুশি হতে দেখা যাচ্ছে। তিনিই পূজারি ও সাধু-সন্তদের সাথে নিয়ে ৫ আগস্ট ২০২০ সালে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী রামমন্দিরকে ভারতীয় উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ঘোষণা দিতে চাচ্ছেন। এ জন্য অযোধ্যা নগরীকে চিত্তাকর্ষক ও মনোরম বানানোর জন্য কয়েক হাজার কোটি রুপির সরকারি প্রকল্পের কাজ চলমান। সেখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ হয়ে গেছে। দেশের সকল স্থান থেকে অযোধ্যাকে রেলের সাথে যুক্ত করার কাজও পূর্ণোদ্যমে চলছে। ভবিষ্যতে এটিই হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদীদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হবে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যায় রোড শো করে সেখানে কয়েক হাজার কোটি রুপির উপহার বিতরণ করেছিলেন। সে সময় তিনি ২২ জানুয়ারিকে ঘরে ঘরে শ্রীরাম জ্যোতি প্রজ্বলনের আবেদন করে বলেন, বিকাশ ও ঐতিহ্যের যৌথশক্তি হিন্দুস্তানকে বিশ্বে সবার আগে নিয়ে যাবে। তিনি ১৪০ কোটি ভারতীয়ের কাছে আবেদন করেন, ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় যেন সবাই আসার চেষ্টা না করে। আমরা যখন সাড়ে পাঁচ শত বছর অপেক্ষা করেছি, তখন আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে পারব। তিনি বলেন, শৃঙ্খলার প্রতি খেয়াল রেখে অযোধ্যায় আগমনে অস্থির হবেন না। কেননা শ্রীরামের মন্দির সর্বদা থাকবে।
বিজেপি চাচ্ছে, ২২ জানুয়ারি হিন্দুস্তানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন হিসেবে নাম লেখাবে। দেশের বহু রাজনৈতিক দলের নেতাকে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যাতে রামচন্দ্রের প্রতি তাদের বিশ^াসের পরীক্ষা নেয়া যায়। যে ব্যক্তি ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে না, তাকে রামবিরোধী অভিহিত করে নির্বাচনে হারানোর চেষ্টা করা হবে। ভালো কথা, রামের সম্মানকে কে অস্বীকার করবে? ভারতীয় শাসনক্ষমতায় রামচন্দ্রের যে গুরুত্ব রয়েছে, তাকে কেউ অস্বীকার করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মানুষের আপত্তি সেই কর্মপন্থা নিয়ে, যা রামমন্দির বানানোর জন্য অবলম্বন করা হয়েছে।
কে না জানে, আজ যেখানে জৌলুশপূর্ণ রামমন্দির নির্মিত হয়েছে, সেখানে খ্রিষ্টীয় ষোল শতাব্দীতে নির্মিত বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল। ওই মসজিদকে বিতর্কিত বানানোর জন্য এখানে রামচন্দ্রের জন্মস্থান হওয়ার প্রোপাগান্ডা করা হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে গোপনে মূর্তি রাখা হয়েছে। এর পর নব্বই দশকে সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু হয়, যা দেশের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার আগ্নেয়গিরি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২-এর দিনটির কথা কার মনে নেই? সেদিনই বাবরি মসজিদের শাহাদতের হৃদয়বিদারক ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়।
সারা দেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। আদালতে মামলা ছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ৯ নভেম্বর ২০১৯ সালে বাবরি মসজিদের জমি হিন্দুদের সমর্পণ করার বিস্ময়কর রায় প্রদান করেন। তবে তিনটি বিষয় এমন ছিল, এ রায়েও যেটা উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রথমত আদালত এটা মেনে নেন যে, বাবরি মসজিদ কোনো মন্দির ধ্বংস করে নির্মিত হয়নি। দ্বিতীয়ত বাবরি মসজিদে মূর্তি রাখাটা ছিল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তৃতীয়ত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা একটি অপরাধমূলক তৎপরতা ছিল। সম্প্রতি মুসলিম দলগুলো একটি যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামা, জমিয়তে আহলে হাদিস, জমিয়তে আহলে সুন্নাত প্রভৃতিসহ সব বড় মুসলিম দল অযোধ্যায় রামমন্দির সম্পর্কিত প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা অভিহিত করে বলেছেন, ঠিক নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে যেভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে এবং যে বিশাল আকারে এটাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হচ্ছে তা শুধু দেশের সেক্যুলার সংবিধানের পরিপন্থী নয়, বরং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মৌলিক আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। সম্মিলিত দলগুলো দেশের জনগণ ও মুসলমানদের কাছে আবেদন করেছে যে, তারা যেন এ মুহূর্তে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সম্ভাব্য সবধরনের চেষ্টা করে এবং মুসলমানরা নিজেদের উত্তেজিত করার অপচেষ্টা সফল হতে না দেয়।
অপর দিকে রামের রাজনৈতিক ব্যবহারে কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিজ নিজ ভঙ্গিতে আপত্তি জানিয়েছে। শিবসেনার মুখপাত্র ও পার্লামেন্ট সদস্য সঞ্জয় রাউত বলেছেন, ‘এখন শুধু ভগবান রামকে ভোটের প্রার্থী সাব্যস্ত করার ঘোষণাটা বাকি।’ তিনি ‘পুরাণ প্রতিষ্ঠা সমারোহ’ সম্পর্কে বিজেপিকে ভর্ৎসনা করে বলেছেন, বিজেপি পুরো অনুষ্ঠানকে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছে। আরেক দিকে কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর বক্তব্য হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে রামমন্দির নির্মাণের অনুমতি প্রদানের পর ধীরে ধীরে এটা রাজনৈতিক স্ট্যান্ট ও নির্বাচনী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বামপন্থী দলগুলোর নেতা সীতারাম ইয়েচুরি ও বৃন্দা কারাত ওই অনুষ্ঠানে যেতে অস্বীকার করেছেন। ইয়েচুরির বক্তব্য, ধর্ম ব্যক্তিগত পছন্দ ও অপছন্দের বিষয়। এটাকে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের মাধ্যম বানানো যায় না।
সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাত বলেছেন, তার দল অযোধ্যার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে না। এটা একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা, যা কোনোভাবেই সঠিক নয়। উল্লেখ্য, এক দিকে যেখানে বামপন্থী দলগুলোর নেতৃবৃন্দ স্পষ্টভাবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণপত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, অপরদিকে সেক্যুলার দলগুলো এ বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকার। কেননা অংশগ্রহণ না করায় বিজেপি তাদের রামবিরোধী হওয়ার প্রোপাগান্ডা করবে। নির্বাচনের ময়দানে তাদের এর ক্ষতি গুনতে হবে। এটা সেই রাজনৈতিক দুর্বলতা, যা দেশকে এ দিন দেখাচ্ছে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৭ জানুয়ারি,
২০২৪ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা