২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যে দেশে ঘোড়ায় ডিম পাড়ে

যে দেশে ঘোড়ায় ডিম পাড়ে - নয়া দিগন্ত

দুই বন্ধুর গল্প দিয়েই আজকের লেখাটি শুরু করছি। দুই বন্ধু রাস্তায় ঘুরতে বের হয়েছে। একসময় এক বন্ধু অপর বন্ধুকে বলল, জানিস সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, না কোনো দিনই না। এ নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে তর্ক শুরু হলো। এমন সময় তারা দেখল দূরে বেশ কিছু মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে। তখন প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে বলল, চল ওখানে গিয়ে দেখি ওরা কী দেখছে। তারা কাছে গিয়ে দেখল, সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একটি ঘোড়া দেখছে। তখন প্রথম বন্ধু একজনকে বলল, ভাই এখানে কী হচ্ছে? তখন লোকটি বলল, আরে ভাই দেখেন, দেখেন এই ঘোড়ায় একটি ডিম পাড়ছে! তখন দুই বন্ধু কাছে গিয়ে দেখল সত্যি সত্যি ঘোড়াটি একটি ছোটখাটো ফুটবল সাইজের ডিম পেড়েছে। তখন প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বেশ গর্বের সাথে বলল, কিরে তোকে বলেছিলাম না, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ! দেখলি এখানে ঘোড়ায়ও ডিম পাড়ে!

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘোড়ায় ডিম না পাড়লেও নির্বাচন কমিশন যে ডিম পেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ‘সকাল ৮টায় সারা দেশে ভোটগ্রহণ শুরুর তিন ঘণ্টা পরও ভোট দেয়ার হার কোথাও ছিল ৩ শতাংশ, কোথাও ৫ কিংবা কোথাও ৮ শতাংশ।’ (নয়া দিগন্ত, ৮ জানুয়ারি ২০২৪) সরকারের আমন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক জেজ কৌলসন বলেন, ‘সারাদিন যতগুলো কেন্দ্র আমি ঘুরেছি তাতে আমার ধারণা ৬ থেকে ৮ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়ে থাকতে পারে। এর বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। সেই পরিমাণ ভোটারদের অংশগ্রহণ আমি পাইনি।’ (আমার সংবাদ, ই-পেপার, ৭ জানুয়ারি ২০২৪) তিনি আরো বলেছেন, ‘আই ফাউন্ড দ্য নর্থ কোরিয়া মডেল হিয়ার।’ বাস্তবতার নিরিখে আমার লেখা একটি নিবন্ধ গত ৬ জানুয়ারি নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ছিল, ‘উত্তর কোরিয়ার মডেলে হচ্ছে ডামি নির্বাচন।’ সত্যিকার অর্থেই এটি উত্তর কোরিয়ার মডেলে ডামি নির্বাচন। আন্তর্জাতিক মিডিয়াসহ দেশীয় প্রথম সারির প্রিন্ট মিডিয়া ও টেলিভিশন মিডিয়ার সাংবাদিকরা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোটার উপস্থিতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, ১৫-১৬ শতাংশের ওপর কোথাও ভোট কাস্ট হয়নি। প্রথম আলো ‘নিরুত্তাপ ভোট, উপস্থিতি কম’ শিরোনামের লেখায় উল্লেখ করেছে, ভোট শেষের এক ঘণ্টা আগে ২৬.৩৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানিয়েছিল ইসি। ভোট গ্রহণ শেষে ইসি জানান, ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। তাতে দেখা যায়, শেষের এক ঘণ্টায় ১৩ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে। এবারের নির্বাচনের মাঠে যারা প্রত্যক্ষভাবে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেছেন, তাদের ভাষ্য হলো, এটি অবাস্তব। নির্বাচন কমিশন অবশ্য ৪০ শতাংশের উপর সন্তুষ্ট না হয়ে পরের দিন সেটিকে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশে বাড়িয়েছে। (কালবেলা, ৮ জানুয়ারি ২০২৪, অনলাইন পেপার)

সিইসি ডিম পাড়ছেন কিন্তু কতটা পাড়ছেন সেটি নিজে বলতে পারছেন না। ডিম পাড়ার জায়গাটি অনেক মোটা হয়ে যাওয়াতে ২৮ এর পরিবর্তে যে কখন একসাথে ৪০টি বের হয়েছে সেটি অবশ্য সিইসির পাশে থাকা সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সিইসি ও অন্যদের এই মিথ্যাচারের রিপোর্ট পড়ে মানবজমিনের একজন পাঠক কমেন্ট বক্সে লিখেছেন, ‘আমি আমার সন্তানদের আর স্কুলে পাঠাব না। পড়ালেখা করে বড় হয়ে ওরা চোর হবে। সারা দেশের মানুষ যেখানে ভোটের পরিস্থিতি ও ভোটারের উপস্থিতির দিকে তীব্র নজর রেখেছে এবং ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় সাথে সাথে জানান দিয়েছে, সেখানে নির্বাচন কমিশন কিভাবে একটি আজগুবি সংখ্যা ঘোষণা করে? কেন দেশের জনগণের সাথে এই প্রতারণা-শঠতা-ভণ্ডামি? এই যদি হয় আমাদের সমাজের শিক্ষিত লোকদের চরিত্র তাহলে এই প্রতারকদের দেখে নিজের সন্তানও প্রতারক হবে, দেশ জাতির সাথে বেঈমানি করবে, সেই ভয়ে কেউ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে না চাইলে তাকে দোষ দেয়া যায় না।
এই নির্বাচনের সবচেয়ে মজার দিক হলো, যিনি আওয়ামী লীগ তিনিই ডামি। মাঝখানে জাতীয় পার্টিকে এমনভাবে কানমলা দিয়েছে যে, চিরজনমের জন্য বাপ-দাদার নাম ভুলে যাবে। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম নামক দোকানমালিকরা তো একেকজন বিরোধী দলের নেতা হতে চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা তাদের এমন শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো দিন আর নির্বাচনের নাম মুখে নেবে না। শেখ হাসিনার এই শিক্ষার কথা মনে থাকা পর্যন্ত তাদের চৌদ্দ পুরুষের কেউ কোনো দিন এমপি হতেও চাইবে না।

‘২৯৯ আসনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৩ টি আসন, ৬৩টি আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। জাতীয় পার্টি সমঝোতার ২৬ আসনে পেয়েছে ১১টি। অন্যরা পেয়েছেন দু’টি আসন।’ (যুগান্তর, ৮ জানুয়ারি ২০২৪) জাতীয় পার্টির বিজিত ১১ জনও নির্বাচনকালীন সময়ে আওয়ামী লীগই হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের পোস্টার, প্রচারণায় শেখ হাসিনার গীত বন্দনাই ছিল। অনেকের মতে, নৌকা, ঈগল, ট্রাক, লাঙ্গল সবাই একজনার আশীর্বাদপুষ্ট। নির্বাচনের ফলাফল এবং একজনের ইচ্ছায় জয়-পরাজয় নির্ধারণের চিত্রই বলে দেয়, এই নির্বাচন দ্বিতীয় বাকশাল কায়েমের চূড়ান্ত রূপের আগের ধাপ। এই নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, মোট ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন ভোটারের মধ্যে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের ভোট কোন মার্কায় গণনা করা হবে তা একজনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ শেখ হাসিনা কাকে বিজয়ী করবেন আর কাকে পরাজিত করবেন সেই মোতাবেক ভোটের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। বাকশাল আইনের দশম ধারার ৭ উপধারার বিধানমতে, ‘বাকশাল চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত এক উপকমিটি দ্বারা মনোনীত না হলে কেউ মনোনীত হতে পারত না।’ অর্থাৎ বাকশাল চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এবারের নির্বাচনে কারা কারা নির্বাচিত হবেন সেই সিদ্ধান্তও ভোটারদের ওপর নয়; বরং এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। সেই অর্থে এটি দ্বিতীয় বাকশাল বললে ভুল হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলে সুখের ঢেঁকুর তুলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নির্বাচনে তো বিকল্প কোনো প্রার্থী ছিল না, ভোটাররা যাকে আলাদাভাবে পছন্দ করতে পারত। মূলত, এটি তো ছিল, অব দ্য ডামি, বাই দ্য ডামি, ফর দ্য ডামি মার্কা ইলেকশন। পর্যবেক্ষক হিসেবে যাদেরকে হায়ার করেছে তারাও ডামি। কে নির্বাচিত হবেন তাও আগে থেকে নির্ধারিত। সুতরাং এই জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু তকমা দিয়ে বাহবা নিতে চাইলেও প্রকৃত অর্থে জনগণ এই নির্বাচন বর্জন করেছে সেটি প্রশ্নাতীতভাবেই বলা যায়। জনগণ বুঝতে পেরেছে তার ভোটের কোনো মূল্য নেই। সে কারণে জনগণ ভোট বর্জন করেছে। এখানে, নির্দ্বিধায় বলা যায়, সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জনগণকে ভোটবিমুখ করে একনায়কতান্ত্রিকতাকেই চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।

দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় এটি ছিল একপাক্ষিক পাতানো ডামি নির্বাচন, যার ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারো জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত করা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের পাকাপাকি ব্যবস্থা। জাতিসঙ্ঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো এই নির্বাচনকে কোনোমতেই অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা সুস্থ গণতন্ত্র নিশ্চিত করা, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শক্তিশালীকরণের প্রতি বহু আগে থেকেই জোর তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত না করে বিরোধী দল দমনে নির্বিচারে গ্রেফতার, জেল-জুলুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য জঘন্যতম কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের এই একগুঁয়ে স্বৈরাচারী আচরণের বিপরীতে পশ্চিমা বিশ^ বিভিন্ন ধরনের স্যাংশনসহ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করলে দেশে ভয়ঙ্কর পরিণতি নেমে আসতে পারে। তখন সরকার নির্বাচন কমিশনকে ঘোড়া বানিয়ে দিয়ে একসাথে যত ডিমই পাড়াক সেই ডিম দিয়ে জাতিকে দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারবে না।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement