পাণ্ডুলিপি গবেষণা ও পাঠোদ্ধারে ফার্সি ও ইতিহাস বিভাগের ৩ দশক
- সুজন পারভেজ
- ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:৪৪
আমরা সবাই কমবেশি জানি যে ফার্সি ভাষা প্রায় সাড়ে ছয় শ’ বছর (৬৩৩ বছর) ভারতীয় উপমহাদেশের রাজভাষা হিসেবে সর্বত্র প্রচলিত ছিল। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ফারসি রাষ্ট্রভাষা থাকার কারণে রাষ্ট্রের সকল দাফতরিক কাজকর্মে, দলিল-দস্তাবেজ লেখায় ও ওই সময়ের বইপুস্তকও ফারসি ভাষায় লেখা হয়। ফলে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ফারসি ভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ফার্সি ও উর্দু বিভাগ একত্রে ছিলো। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে ফার্সি ও উর্দু বিভাগ আলাদা হয়ে যায়। আমার ধারণা- প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগ হিসেবে ফার্সি বিভাগ চালুর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাণ্ডুলিপির গুরুত্বের কথা বিবেচনা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে থাকা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো তালপাতা, পশুর চামড়া ও কাগজের ওপর লেখা। যদিও পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধার খুবই দুরূহ ও ধৈর্যের কাজ তবুও সব সময় কিছু শিক্ষক ও গবেষক থাকেন যাদের কাছে প্রাচীন এই অমূল্য সম্পদগুলো নিয়ে কাজ করার বিষয়টা কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
১৯৯০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের তিনজন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ফার্সি পাণ্ডুলিপি বিষয়ে ইরান থেকে তাদের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ১৯৯৮ সালে ড. মো: শামীম খান বাংলাদেশের উর্দু-ফার্সি কবি মওলানা ওবায়দুল্লাহ উবায়দি সোহরাওয়ার্দির ফার্সি ভাষায় রচিত ‘দাস্তানে এবরাতে বার’ শীর্ষক পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও টীকাভাষ্য সংযোজন সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০০২ সালে ড. কে.এম সাইফুল ইসলাম খান তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘তাসহিহ ভা ভিরায়েশে দিওয়ানে আব্দুল করিম খাকী : শায়েরে বাঙ্গালা জাবান দার বাংলাদেশ’ এই শিরোনামে তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে এখনো প্রকাশিত হয়নি। তারপর ২০০৯ সালে মাশহাদের ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. মুহসিন উদ্দিন মিয়া ‘দিওয়ানে সিরাজ উদ্দিন ফরিদপুরী ভা পিরামুনে অন’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে যেটি ২০১৩ সালে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ড. মুমিত আল রশিদ ইরানের তারবিয়্যাত মোদাররেস (শিক্ষক প্রশিক্ষণ) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গুলদাস্তে গুলশান মানি গ্রন্থের ব্যাখা, বিশ্লেষণ ও শুদ্ধিকরণ’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এটি এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক ভিজিটিং প্রফেসর ড. মুহাম্মদ কাজেম কাহদূয়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি শাখা নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন যা ১৯৯৯ সালে 'নামে পার্সি' নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো: কামাল হোসেন খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যেসব ফারসি পাণ্ডুলিপি রয়েছে সেসব পাণ্ডুলিপির ওপর গবেষণা করে ২০১০ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ফারসি পাণ্ডুলিপির তথ্যানুসন্ধান’ শিরোনামে এম.ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. মুহসিন উদ্দিন মিয়া ২০১১ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ফারসি পাণ্ডুলিপি অনুসন্ধান’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেন। যা ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।
ড. মো: আবুল কালাম সরকারের ‘মোয়াররাফিয়ে নোসখেহায়ে খাততিয়ে কাসায়েদে উরফি শিরাজী দার কেতাবখানেয়ে মারকাযিয়ে দানেশগাহে ঢাকায়ে বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ ২০১৫ সালে ভারতের লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘যেন্দেগী ভা আসারে উরফী শিরাজী’ আন্তর্জাতিক সেমিনারের সুভেনিরে প্রকাশিত হয়।
এরপর তিনি ২০১৮ সালের ২৪ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি লাইফগেট হিউম্যান সোসাইটি লখনৌ, ইন্ডিয়া কর্তৃক আয়োজিত ‘আমিরখসরু এ মাল্টিফেসেটেড ইন্ডিয়ান পার্সোনালিটি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে ‘মোয়াররাফিয়ে নোসখেহায়ে খাততিয়ে ফারসিয়ে আমিরখসরু দার কিতাবখানেয়ে দানেশগাহে ঢাকা দার বাংলাদেশ’ বিষয়ে আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সবচেয়ে আশার বিষয় হচ্ছে- সম্প্রতি ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ও কঠোর অধ্যবসায়ী গবেষক ড. মো: আবুল কালাম সরকার ও ইরানের ইয়াযদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক ভিজিটিং প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ কাজেম কাহদূয়ি যৌথভাবে দুটি পাণ্ডুলিপির সংশোধন ও পাঠোদ্ধার করেন। তারা প্রথমে ‘দিওয়ানে উবায়দি’ নামে মাওলানা উবায়দুল্লাহ উবায়দি সোহরাওয়ার্দির পাণ্ডুলিপিটির পাঠোদ্ধার করেন। যেটি ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয়। যেটি কিনা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ফার্সি ভাষার কোনো পাণ্ডুলিপি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ। এটি একটি ফার্সি কাব্যগ্রন্থ।
এরপর আবুল বারাকাত মুনির লাহোরির ‘মাসনাভি দার সিফাতে বাঙ্গালে’ পাণ্ডুলিপিটির পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেন, যা ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয়। লেখক আবুল বারাকাত মুনির লাহোরি গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের অপরুপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চিত্র কাব্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়াও বিভাগে স্নাতকোত্তরে পাণ্ডুলিপি পঠন ও পাঠোদ্ধার বিষয়ে পড়ানো হয়ে থাকে।
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- ফার্সি বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক না হয়েও ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শহিদুল হাসান তার অসীম উৎসাহ ও কৌতূহল নিয়ে পাণ্ডুলিপি গবেষণা ও পাঠোদ্ধারের কাজটি করছেন। তিনি প্রথম কবি শেরবাজ খানের ‘ফাতেমার সুরতনামা’ নামক পাণ্ডুলিপিটি পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেন, যেটি ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয়। ‘ফাতেমার সুরতনামা’ পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু হলো- আলী কর্তৃক আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর কন্যার বাতেনি সুরত অর্থাৎ চেহারা দেখতে গিয়ে যে ঘটনাবলী ঘটেছে, সেগুলোর কাব্যাকারে প্রকাশ।
তার পাঠোদ্ধার করা দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি ‘সখিনা-বিলাপ’ এটিরও লেখক কবি শেরবাজ খান। যা গ্রন্থাকারে এখনো প্রকাশিত হয়নি। গ্রন্থটিতে লেখক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার খণ্ডচিত্র কাব্যাকারে বাঙালি পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন, যা আরবি-ফার্সি হরফে বাংলা অনুলিপিকৃত, যার মূল বাংলা কপিটির সন্ধান পাওয়া যায়নি, কাহিনিটি নববধূ সখিনার আর্তনাদের একটি কাব্যিক চিত্রায়ণ। কারবালার শহীদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নবীর দুহিতা কাশেম, যার সাথে পূর্ব ওয়াদা অনুযায়ী সখিনার বিয়ে হয় কিন্তু দাম্পত্য ও সংসারজীবন শুরু করার পূর্বেই যুদ্ধে গিয়ে কাশেম শাহাদাত বরণ করেন, শাহাদাত বরণকারী স্বামীর প্রতি সখীনার দুঃখ ভারাক্রান্ত মনোভাবকে কবি কাব্যাকারে তুলে ধরেছেন।
তৃতীয় পাণ্ডুলিপি ‘ফক্করনামা’ যেটির লেখকও কবি শেরবাজ খান। এ পাণ্ডুলিপিটিও বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। ‘ফক্করনামার’ কাহিনীটি হলো- স্বয়ম্বর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে রোম রাজকন্যার বর নির্বাচন যা সওয়াল-জবাবের ঢং-এ সামনে আগাতে থাকে। এভাবেই তারা শিক্ষকতার পাশাপাশি নিরলসভাবে পাণ্ডুলিপি গবেষণা ও পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে জাতির অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানের মহৎ কাজটি করে যাচ্ছেন। পরিশেষে, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি যে শতবর্ষী ফার্সি ও ইতিহাস বিভাগ আগামীতে আরো বেশি গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা