২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শীতকালে মানসিক সমস্যা, কারণ ও সমাধান

শীতকালে মানসিক সমস্যা, কারণ ও সমাধান - ফাইল ছবি

শীতকাল অনেকের পছন্দের ঋতু। শীত এলেই পরিবেশে আর্দ্রতা বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই আর্দ্রতায় ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের মতো অণুজীবগুলো বৃদ্ধির ভালো সুযোগ পায়। ফলে এই সব জীবাণু মানুষের মধ্যে অনেক রোগের জন্ম দেয়। আবার এর পাশাপাশিই শীতের আগমনে শরীরেও অনেক পরিবর্তন ঘটে। শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোকে উষ্ণ রাখতে আরো শক্তির প্রয়োজন হয়। এর জন্য অনেক ধরনের ঘাটতি ও রোগ হতে থাকে এবং আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই শীতে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলেন চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশে প্রতি আটজনে একজন মানসিক রোগী। প্রাপ্তবয়স্কদের ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং শিশুদের ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসাসেবায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগা ৯১ শতাংশই চিকিৎসা পায় না। নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে অনেক কুসংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম। এছাড়া প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় ৮০ লাখ মৃত্যু (১৪.৩ শতাংশ) মানসিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্বজুড়ে ৯৭ কোটি মানুষ মানসিক অসুস্থতা বা মাদক ব্যবহারজনিত সমস্যায় ভুগছেন। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। তবে গত কয়েক বছরে এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আগের চেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, পাবনা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রচেষ্টায় দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি হয়েছে। পাবনা মানসিক হাসপাতালকে বিশ্বমানের করে গড়ে তোলা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্যমতে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশার দিক চিহ্নিত করে তারা বলেন, দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। জনশুমারিতে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

মানসিক সমস্যার কারণ
১. জেনেটিক (বাবা-মা অথবা পূর্ব-পুরুষদের মধ্যে কারো মস্তিষ্ক বিকৃতি থাকলে) কারণে অনেক সময় সন্তানেরও মানসিক রোগ প্রকাশ পায়। ২. শরীরে কোনো কঠিন ব্যাধি ৩. অতিরিক্ত নেশা ৪. মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে ৫. হঠাৎ ভয় পেলে ৬. মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অত্যধিক আনন্দ, দুঃখ, নৈরাশ্য। ৭. পরিবেশগতভাবে ৮. নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি।

লক্ষণ
মানসিক রোগ বা সমস্যা সবসময় খুব সহজে বোঝা যায় না। মৃদু রকমের অনেক মানসিক রোগ আছে যেগুলো খুব সহজে ধরা পড়ে না, যেমন-অ্যাংজাইটি, হালকা বিষণœতা ইত্যাদি। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপ, আচার-আচরণে ক্রমশ পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এতে সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্যেরও ক্ষতির কারণ হয়। এই পরিবর্তন নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি দিন থাকছে। তখন মানসিক রোগ হয়েছে ধরে নেয়া যায়। যেমন-একটি লোক হয়তো বেশি কথা বলছে, রাগ বেশি করছে, বেশি টাকা খরচ করছে, অন্যের সঙ্গে বেশি খারাপ আচরণ করছে। এটা দুই-তিন দিন হয়তো অন্যরা মেনে নেবে, কিন্তু যদি ক্রমাগতভাবে দুই মাস ধরে অব্যাহত থাকে, তখন তা মানসিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।

মানসিক রোগীকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- মৃদু ও মাঝারি এবং তীব্র আকারের মানসিক রোগ। মৃদু রোগী হলো-অ্যাংজাইটি, মন খারাপ, নিদ্রার সমস্যা ও কিছুটা বিষণ্নতা। এতে রোগীর খুব বেশি অসুবিধা হয় না। সমস্যা তীব্র হয়ে উঠেছে এমন রোগীরা অজ্ঞান হয়ে পড়তে, আচরণে অত্যন্ত রূঢ় হওয়া কিংবা কখনো ভাঙচুরপ্রবণ হতে পারে। এ সময় অনেক অভিভাবক রোগীকে চিকিৎসার জন্য না এনে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। এটি ঠিক নয়। মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে : হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা, অনেক দিন ধরে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে গুটিয়ে রাখা, টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ থাকা, অন্যদের সঙ্গে একেবারে কথা বলতে না চাওয়া, সবার সাথে ঝগড়া করা, গায়েবি আওয়াজ বা কথা শুনতে পাওয়া, অন্যদের অকারণে সন্দেহ করতে শুরু করা, গোসল বা দাঁত মাজার মতো নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজ বন্ধ করে নিজের প্রতি যত্ন না নেয়া, আনন্দদায়ক কাজে নিরানন্দ বোধ করা ও আগ্রহ কমে যাওয়া, সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া, সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা পরিকল্পনা ও চেষ্টা করা, অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে ওঠা, ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বেড়ে যাওয়া, খাবারে অরুচি বা রুচি বেড়ে যাওয়া, বাসা, অফিস বা পেশাগত কাজে অনীহা ইত্যাদি।

এই সমস্যাগুলোর মানেই যে তার মানসিক রোগ হবে তা নয়। তবে এসব উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেলে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা উচিত। তারা সেটা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন যে, এখানে আসলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া উচিত কিনা।

মানসিক রোগ মোটা দাগে দুই প্রকার : ১. নিউরোসিস ২. সাইকোসিস।
নিউরোসিস রোগটি মৃদু ধরনের মানসিক রোগ, অনেক মানুষের মধ্যে বেশি মাত্রায় থাকতে পারে। রোগীর ব্যবহার ও আচরণ পরিবার বা সমাজের জন্য হুমকির কারণ হয় না। সামান্য ওষুধ চিকিৎসা ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে প্রতিকার করা যায়। তবে এ রোগ বারবার হওয়ার প্রবণতা বেশি।

সাইকোসিস রোগটি জটিল ধরনের মানসিক রোগ, কমসংখ্যক লোক এ রোগে ভুগে থাকেন। চিকিৎসা মোটামুটিভাবে ফলদায়ক। সাইকোসিস রোগটি বারবার ফিরে আসার প্রবণতা নিউরোসিস রোগের চেয়ে কম। দুশ্চিন্তা, টেনশন, ফোবিয়া, অবসেশন, হিস্টিরিয়া ইত্যাদি নিউরোসিস রোগের উদাহরণ, অপরদিকে বিষণ্নতা ও সিজোফ্রেনিয়া সাইকোসিস রোগের উদাহরণ।

শীত ও মানসিক সমস্যা
শারীরিক অসুখ ছাড়াও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। একে সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা সংক্ষেপে এসএডি বলা হয়।

সাধারণত শীতকালে এসএডি রোগ দেখা দেয়। এই রোগের কারণে মানুষ হতাশ বোধ করতে শুরু করে এবং স্বাভাবিকভাবেই তার হাত ধরে আসতে থাকে বিষণœতা। ঋতুগত এই বিষণœতার কারণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকলেও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, ঋতু পরিবর্তনের (ঝবধংড়হ ঈযধহমব) সাথে সাথে মানুষের শরীরে কিছু হরমোনের তীব্র পরিবর্তন ঘটে যা মেজাজকে প্রভাবিত করে। ফলে সময় বিশেষে মানুষ না চাইলেও বিষণœ বোধ করেন, হতাশায় ভোগেন। আবার কিছু কিছু জায়গায় এমনটাও মনে করা হয়, শীতকালে সূর্যের আলো না থাকায় মস্তিষ্কে সেরোটোনিন রাসায়নিক কম হয়ে যায়, যার কারণে মেজাজ ক্ষিপ্ত বা বিষণœ হতে শুরু করে।


ঋতুকালীন অবসাদ মোকাবেলার উপায়
শরীরে আলোর অভাব ঋতুগত বিষণ্নতার কারণ বলে মনে করা হয়। এ জন্য চিকিৎসকরা হালকা থেরাপির পরামর্শ দেন।

মেঘ কেটে রোদ বের হলে অবশ্যই হাঁটতে বের হবেন। তেমন বৃষ্টি না হলে বা আকাশ অংশত মেঘলা থাকলেও হাঁটতে বেরোনো উচিত।

অন্ততপক্ষে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রোদে বসুন রোজ। নিয়ম করে। এরপর ধীরে ধীরে সেই সময় বাড়িয়ে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট করার চেষ্টা করুন।

নিয়মিত অন্তত আধ ঘণ্টা করে যেকোনো রকম ব্যায়াম করুন।
নিজেকে যতটা বেশি সম্ভব কাজে মগ্ন রাখুন।

মানসিক সমস্যার হোমিও সমাধানও আছে। হ্যানিম্যান প্রমাণ করে গেছেন যে, শারীরিক কোনো রোগের কুচিকিৎসাই হলো অধিকাংশ মানসিক রোগের মূল কারণ। মানসিক রোগের লক্ষণের ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথিতে প্রাথমিকভাবে অনেক মেডিসিন আছে। তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

শেষ কথা এই যে, যেকোনো অসুস্থতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। মানসিক অসুস্থতাও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের উচিত মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সবধরনের সমর্থন দেয়া। তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করে সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।

লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও কলাম লেখক। চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
মির্জাপুরে মুসলমান হলেন একই পরিবারের ৪ সদস্য আ’লীগ নেতাকে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে প্রশাসনের সভা এএফপির ২ গাজা যুদ্ধের সংবাদদাতা পুরস্কৃত ইসকনের শুরু যেভাবে, বিতর্কিত যে কারণে ‘জুলাই বিপ্লবে চট্টগ্রামের শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেবে চসিক’ জয় দিয়ে এশিয়া কাপ মিশন শুরু বাংলাদেশের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে ভারত : জয়শঙ্কর আইনজীবী আলিফ হত্যার বিচার ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে ঝিনাইদহে হেফাজতের বিক্ষোভ খাগড়াছড়িতে কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার চট্টগ্রাম আবাহনীকে হারাল কিংস আওয়ামী লীগের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে : আব্দুল হাই শিকদার

সকল