দেশকে এগিয়ে নেবে কারা
- মুহাম্মদ মেহেদী হাসান
- ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩৫
আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫২ বছর। এ সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশ শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, অবকাঠামো, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর গবেষণায় অনেক দূর এগিয়েছে। সেই বিবেচনায় আমরা কোথায়? জরিপ বলছে, বর্তমান প্রজন্মের প্রায় ৪৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী দেশের বাইরে চলে যেতে চান। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এত বড় একটি অংশ দেশে থাকতে চান না। তাহলে খুব সহজে অনুমেয়, এ সমাজের ও দেশের মৌলিক জায়গাগুলোতে অসঙ্গতি রয়েছে। যারা আগামী দিনে দেশের ভবিষ্যৎ আমরা তাদের জন্য দেশে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারিনি ৫২ বছরেও।
দেশে যে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিজস্ব প্রযুক্তিতে অনুসন্ধান করতে পারছি না, এজন্য বিদেশীদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। ফলে খনিজসম্পদ উত্তোলন-পরবর্তী লভ্যাংশের অধিকাংশ বিদেশীরা নিয়ে যায়। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা খুব দুর্বল। প্রতিনিয়ত বড় দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থানে রাজনীতির মাঠ প্রায় সময় থাকে অশান্ত। নাগরিকদের রাজনীতি চর্চার অধিকারে বাধা দেয়া যেন এক নিয়মিত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে সন্তোষজনক সেবা অনিশ্চিত, এখানেও চরম দুর্নীতি লক্ষণীয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। অথচ এ খাতে সরকারের বরাদ্দ কম নয়। দেশের সব নাগরিকের প্রয়োজনীয় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সহনীয় ও সাশ্রয়ীমূল্যে নিশ্চিত করা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। উন্নত দেশের স্বাস্থ্য খাতের সাথে আমাদের স্বাস্থ্য খাত তুলনা করলে দেখা যাবে, আমাদের এই খাত কতটা ভঙ্গুর।
এ কথা সত্য, দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে, পরিধি ও আকার বেড়েছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো- পরিধি ও মান কি এক বিষয়? যত টাকার বাজেট হচ্ছে; সে অনুযায়ী কতটুকু কাজ হচ্ছে? শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু মান গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। দেশ ও জাতি গঠনে ব্যক্তিজীবনে শিক্ষার প্রভাব কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি আমরা? সমাজের বাস্তব চেহারা এখন এমন- ‘মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা, দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়ে মানবিক সঙ্কট আজ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশের জনসংখ্যা পর্যাপ্ত, সে জনসংখ্যা কি জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছি? তা না হলে এ বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ কী?
যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আজ পৃথিবীতে উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার সময় দরিদ্র সিঙ্গাপুর এখন বিশ্ব অর্থনীতির রোলমডেল, সবচেয়ে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন দেশ হিসেবে পৃথিবীতে স্বীকৃত। দেশটির শাসক তথা কর্তাব্যক্তিরা যে শুধু নিজেদের দেশকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে গেছেন এমন নয়। তাদের জনমানস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা পরিবর্তিত হবেন, সভ্য হবেন, উন্নত হবেন। সে বিবেচনায় আমরা মানসিকভাবে কতটুকু প্রস্তুত স্বপ্নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে? দেখা যায়, জনকল্যাণে দেশে কোনো আইন প্রবর্তন করা হলে আমরা দলবেঁধে সে আইন ভঙ্গ করি।
একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের সবল চর্চা। সময়ের পরিক্রমায় আমরা দেখে আসছি দেশে গণতন্ত্রের বেহাল দশা। স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আমরা একটি স্বাধীন শক্তিশালী নির্বাচনব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দেশ উত্তাল হয়। বিদেশীরা এসে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামান যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। এ দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। অথচ স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর অন্য সব দেশের কাছে আমার উন্নয়ন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সুশাসন, নির্বাচনসহ সব কিছু আদর্শস্থানীয় হওয়ার কথা ছিল।
দেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট যত গভীর হবে নিকট ভবিষ্যতে রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিদেশী বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও পোশাক রফতানিতে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে আমরা নিজেদের প্রকৃত শত্রু চিনতে ভুলে গেছি। আমাদের শত্রু দুর্নীতি, দারিদ্র্য, সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং যারা এগুলোর মূলে ভূমিকা রাখেন। বৃহৎ পুঁজি ও বাজারের সিন্ডিকেট আমাদের শত্রু, ভূরাজনৈতিক কূটচাল আমাদের শত্রু, সাম্প্রদায়িকতা ও অসৎ নেতৃত্ব আমাদের শত্রু। এসব শত্রুর সমূলোৎপাটন করতে পারলে সত্যিকার অর্থে এ দেশ উন্নয়নের আদর্শ হতে সময় লাগবে না। অথচ আমরা শত্রু মনে করি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে।
আমাদের সৃজনশীলতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করায়। এই সৃজনশীলতা ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করে বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে সদা জাগ্রত থাকি। এ সুযোগে প্রকৃত শত্রু আরো শক্তিশালী হচ্ছে। দেশের অপার সম্ভাবনাগুলো ধ্বংস করে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে।
দেশের মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছি না আমরা, তাই শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশ দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। পড়াশোনা শেষে দেশে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে না পারার শঙ্কায় বিদেশে থেকে যাচ্ছে। তরুণদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি না। মেধা অনুসারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছি না। ব্যাপকভাবে তাদের দেশত্যাগের চলমান যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের জন্য সুখকর নয়। মেধা, মনন ও শ্রমের যথাযোগ্য ব্যবহার করে যারা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছাবেন, দেশ ও জাতিকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবেন; তাদের এভাবে দেশত্যাগ জাতির জন্য অশনিসঙ্কেত। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে অনেকাংশে। দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিনিয়ত কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একাংশ বিদেশে যায়। কিন্তু পদে পদে তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ভারত নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় যেখানে হাজার পঞ্চাশেক টাকায় বিদেশ যাওয়া যায়, সেখানে আমাদের দেশে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ যেতে হয়। অনেকে আবার দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হন। অন্যরা অল্প টাকায় বিদেশে পাঠাতে পারলে আমরা কেন পারছি না? যারা বিদেশ থেকে ফিরে আসছেন তাদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব সরকার পালন করছে কি?
নানা চড়াই উতরাই প্রতিকূলতার পরও বাংলাদেশ এগিয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক বিবেচনায় ৫২ বছরের হিসাবে এই আগানো কতটুকু সন্তোষজনক? আমরা একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বুনি। সঙ্গত কারণে এমন এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যত ঘাটতি বা প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতে হবে।
মোটাদাগে যদি আমরা মৌলিক ঘাটতি বা প্রতিবন্ধকতা উল্লেখ করি তাহলে প্রথমে সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অভাব দেখতে পাই। অর্থাৎ কর্তাব্যক্তিদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও চরম অপরাধপ্রবণতা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। পর্যায়ক্রমে নাগরিক হিসেবে আমরাও দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। এর মানে হলো- দেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার বড় অভাব।
অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সাথে অনেক বেশি সংযুক্ত। সুতরাং বৈশ্বিক মূল্যবোধের সাথে আমাদের সমন্বয় থাকতে হবে। কাজ করতে হবে দেশে গণতন্ত্রের যথার্থ বাস্তবায়ন নিয়ে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে, স্বাস্থ্যসেবার সর্বজনীন মান নিশ্চিত করতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থাকে নৈতিক ও কর্মমুখী করতে হবে, কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে, উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে; বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলায় বাস্তবমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে, সে ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য ও রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের গুরুত্ব দিতে হবে, পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ নির্মাণে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সম্ভব বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত উন্নতি ও সমৃদ্ধি।
লেখক : সাবেক সভাপতি (ডিবেট বাংলাদেশ)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা