২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শুধু মসজিদের সার্ভে কেন

জ্ঞানবাপী মসজিদ - ফাইল ছবি

বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের বৈজ্ঞানিক সার্ভে করানো সম্পর্কিত সংবাদের মধ্যেই ইউপির সিনিয়র রাজনীতিবিদ স্বামী প্রসাদ মৌরিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি সার্ভে হয়ই, তাহলে শুধু জ্ঞানবাপী কেন, দেশের সব হিন্দু মন্দিরেরও সার্ভে হওয়া উচিত।’ তিনি দাবি করেন, দেশের বেশির ভাগ হিন্দু মন্দির বৌদ্ধ মঠ ভেঙে তৈরি করা হয়েছে। মৌরিয়া বদ্রিনাথ ধামের (মন্দির) ব্যাপারেও এমনই দাবি করেছেন। এবিপি নিউজের সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত বদ্রিনাথ ধামও বৌদ্ধমতের একটি মঠ ছিল। আদি শঙ্কর আচার্য এটিকে মন্দির বানান। এমন পরিস্থিতিতে যদি গোড়া উপড়াতেই হয়, তাহলে বিষয়টি শুধু মসজিদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’ সবাই জানেন, বেনারসের ঐতিহাসিক জ্ঞানবাপী মসজিদের সার্ভে মামলা বর্তমানে এলাহাবাদ হাইকোর্টে শুনানিধীন রয়েছে। একটি স্থানীয় আদালত মসজিদের নিচে মন্দিরের অবশিষ্টাংশ আছে কিনা জানার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে বৈজ্ঞানিক সার্ভে করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সার্ভে শুরু করাও হয়েছিল। কিন্তু এ সময় মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং এলাহাবাদ কোর্টে এ মামলার শুনানি করতে বলেন। মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বক্তব্য, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সার্ভে দ্বারা মসজিদের ভিতসমূহের ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং এর অনুমতি দেয়া সঙ্গত হবে না। হাইকোর্ট এ মামলায় তার রায় স্থগিত করেছেন।

সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো আজকাল দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক মসজিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারা চালু করেছে। মসজিদগুলোর ক্ষতি করার জন্য নিত্যনতুন পন্থা তৈরি করা হচ্ছে। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, যে সরকারের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে দেশের মধ্যে শান্তি-নিরাপত্তা ও আইন প্রতিষ্ঠা করা, সে সরকার সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতে খেলছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এমনই কয়েকটি দুশ্চিন্তাজনক সংবাদ পাওয়া যায়, যার দ্বারা মসজিদগুলোর বিরুদ্ধে চালু হওয়া সংগঠিত আন্দোলনের গন্ধ পাওয়া যায়। অযোধ্যায় আঠার শতাব্দীর একটি মসজিদের ওপর ধ্বংসের খড়গ ঝুলছে। তার একটি মিনার শহীদ করে দেয়া হয়েছে। আর অবশিষ্টাংশটুকুও রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য ধ্বংস করা হবে। উত্তরপ্রদেশের পিডব্লিউডি অধিদফতর এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। দিল্লিতে কনট প্লেসে অবস্থিত দু’টি মসজিদকে রেলওয়ে তার ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা অভিহিত করে খালি করে দেয়ার জন্য দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়ে নোটিশ দিয়েছে। সেখানে আদালত বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কুতুব মিনারের সন্নিকটে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদে নামাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টিও আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছে। বিগত কিছু সময় ধরে প্রতিটি দিন সংবাদপত্রে এ ধরনের সংবাদ নজরে পড়ছে যে, অমুক মসজিদ বা অমুক মাজারকে অবৈধ স্থাপনার আওতায় নিয়ে এসে ধ্বংস করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বা শহীদ করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে শত শত বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর নিচে মন্দির অনুসন্ধানের কাজ কোনো বাধা ছাড়াই চলমান রয়েছে। বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদই শুধু নয়; বরং মথুরার শাহী ঈদগাহ ও বাদায়ুনের ঐতিহাসিক জামে মসজিদের বিরুদ্ধেও আইনি উপায় বের করার চেষ্টা চলছে। ক্রমাগত এ ধরনের খবর আসছেই।

আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, যেখানে উপাসনা স্থান আইন ১৯৯১ বিদ্যমান রয়েছে, সেখানে এসব বিশৃঙ্খলার কী বৈধতা রয়েছে? আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এ আইনকে সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা আগেই সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে রেখেছে। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের অবস্থান জানতে চেয়েছেন। বিগত শুনানিকালে এ বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, কেন্দ্র এ আইনের বিরুদ্ধে রায় দিতে পারে। সবাই জানেন, উল্লিখিত আইন নরসিমা রাও সরকারের আমলে এ কারণে বানানো হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে অযোধ্যার মতো জঘন্য ও ভয়ানক বিবাদ যেন সৃষ্টি না হয়। অযোধ্যা বিবাদকে এ আইনের আওতা থেকে এ কারণে বাইরে রাখা হয়েছিল যে, সেটি ওই সময় আদালতে শুনানিধীন ছিল। অযোধ্যা বিবাদের কারণে দেশকে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা কারো কাছে গোপনীয় নয়। এ ধরনের বিবাদ দেশের ঐক্য ও শান্তি-নিরাপত্তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এটিও এক বাস্তবতা যে, এ বিবাদ থেকে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার যে রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে, তার উদাহরণ তারা নিজেরাই। সুতরাং যখনই তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল অনুভব করে, তখনই তারা এমন ধরনের নতুন কোনো বিবাদকে সামনে তুলে ধরে।

সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয় হচ্ছে, স্থানীয় আদালতগুলো এ ব্যাপারে উপাসনা স্থান সংরক্ষণ আইনকেও পরোয়া করছেন না। আপনারা দেখেছেন, কীভাবে বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের ফোয়ারাকে শিবলিঙ্গ অভিহিত করে সেখানে চূড়ান্ত পর্যায়ের চক্রান্ত করা হয়েছে। স্থানীয় আদালতের বিচারক এ মামলায় যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা সবার সামনে রয়েছে। উপর্যুপরি ঘটনাবলি এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেয় যে, সব কিছুই একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে এবং পুরো প্রশাসন এতে শামিল রয়েছে। এখন এখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মাধ্যমে এর সার্ভে করানোর নির্দেশও স্থানীয় আদালতই জারি করেছেন, যার ওপর সুপ্রিম কোর্ট সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। মথুরা শাহী ঈদগাহের বিরুদ্ধেও এ ধরনেরই অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে এবং সেটিকেও বিতর্কিত বানানোর অপচেষ্টা চলছে। অতীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও মন্দির কমিটির মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, সেটিকেও আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।

মসজিদগুলোকে বিতর্কিত ও অবৈধ স্থাপনা ঘোষণা দেয়ার জন্য কী পরিমাণ অপতৎপরতা চলছে, রাজধানী দিল্লির দু’টি মসজিদকে রেলওয়ে দফতরের পক্ষ থেকে জারিকৃত নোটিশ থেকে তার অনুমান পাওয়া যায়। ওই নোটিশে বলা হয়েছে, এ মসজিদগুলো যেহেতু রেলওয়ের জমির ওপর নির্মিত, তাই মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটি নিজেরাই তা দুই সপ্তাহের মধ্যে ভেঙে দেবে। যদি এমনটি করা না হয়, তাহলে রেলওয়ে তার ব্যবস্থা নেবে। নর্দার্ন রেলওয়ের একজন মুখপাত্রের বক্তব্য, মসজিদগুলো নতুন দিল্লি-গাজিআবাদের মধ্যে অবস্থিত রুটের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। আর এটি রেলওয়ের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ কারণে ওই দু’টি মসজিদকে এখান থেকে সরানো জরুরি। নোটিশের ভাষা দেখুন- ‘রেলওয়ের জমি অবৈধ দখল করা হয়েছে। আপনাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, স্বউদ্যোগে এটিকে ভেঙে ফেলবেন। যদি এমনটি করা না হয়, তাহলে রেলওয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ যখন এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করা হলো, তখন জানা গেল- রেলওয়ের দাবি ভুল। এ দু’টি মসজিদ ওয়াক্ফ বোর্ডে রেজিস্ট্রিকৃত; বরং স্বয়ং রেলওয়ে নিজেই ওয়াক্ফের জমি দখল করে রেখেছে এবং এ ব্যাপারে আইনি ফাঁকফোকর তালাশ করা হচ্ছে।

দিল্লির প্রসিদ্ধ কনট প্লেসে অবস্থিত মসজিদ, বাঙালি মার্কেট ও তিলক ব্রিজের সন্নিকটে অবস্থিত তাকিয়া বাবরশাহ মসজিদের সম্পূর্ণ রেকর্ড দিল্লি ওয়াক্ফ বোর্ডের কাছে সংরক্ষিত আছে। এ দু’টি মসজিদ দিল্লির সেই ১২৩টি ওয়াক্ফ সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত, যার মামলা আদালতে শুনানিধীন রয়েছে। মূলত সরকার মূল্যবান এলাকাগুলোতে অবস্থিত যে ১২৩টি সম্পত্তি গ্রাস করতে চাচ্ছে, তন্মধ্যে কয়েকটি মসজিদ ও দামি প্লট রয়েছে, যেগুলোর ওপর ভূমিদস্যুদেরও বহুদিন ধরে কুনজর পড়ে রয়েছে। মূলত উল্লিখিত দু’টি মসজিদ সেই ৪২টি ধর্মীয় স্থানের অন্তর্ভুক্ত, যা ব্রিটিশ আমলে একটি চুক্তি মোতাবেক মুসলমানদের প্রত্যার্পণ করা হয়েছিল। ওই চুক্তিতে দিল্লির জামে মসজিদের তৎকালীন ইমাম, সুন্নি মজলিসে আওকাফের চেয়ারম্যান নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খাঁ এবং ব্রিটিশ সরকারের কমিশনারের দস্তখত রয়েছে। চুক্তির মূল কপি দিল্লি ওয়াক্ফ বোর্ডের রেকর্ডে সংরক্ষিত রয়েছে।

এ ব্যাপারে দিল্লি ওয়াক্ফ বোর্ডের বক্তব্য- তাকিয়া বাবরশাহ মসজিদে রেলওয়েকে সেতু চওড়া করার জন্য ৯৪ গজ জমি দিয়েছিল যার কাগজপত্র সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া সেই প্লানও সংরক্ষিত রয়েছে, যার আওতায় ৯৪ গজ জমি প্রদান করে ৯০ গজ জমি ফেরত নেয়া হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে উত্তর রেলওয়ে বাঙালি মার্কেটে অবস্থিত মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে একটি লিখিত আবেদন করেছিল, যদি আপনারা আমাদের সামান্য জমি দেন, তাহলে আমাদের সাড়ে তিন হাজার কোটি রুপির প্রকল্প নস্যাৎ হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। এ জমিটি মূলত রেললাইন সোজা করার উদ্দেশে চাওয়া হয়েছিল। মসজিদ কমিটি রেলওয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গণস্বার্থের প্রতি খেয়াল রেখে রেলওয়েকে এ জমি দেয়। কিন্তু এখন রেলওয়ে সম্পূর্ণরূপে জালিয়াতি শুরু করেছে। মসজিদ প্রায় চার শ’ বছরের পুরোনো। পক্ষান্তরে রেললাইন অনেক পরে বসানো হয়েছে।

বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, যে জমিতে পাটাতন বিছানো হয়েছে সেটি মসজিদের মালিকানাধীন। রেলওয়ে এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে মসজিদগুলোর জমিকেই গ্রাস করতে চাচ্ছে। উল্লেখ্য, দেশে অগণিত রেললাইন ও স্টেশন এমন রয়েছে, যেখানে রেলওয়ের জমিতে অবৈধ মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রশাসনের দৃষ্টিতে শুধু মসজিদ আর মাজারকেই অসঙ্গত মনে হচ্ছে, যার অস্তিত্ব মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বামী প্রসাদ মৌরিয়ার বক্তব্য যদি বাস্তবায়িত হতো!

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement

সকল