উত্তর কোরিয়ার মডেলেই হচ্ছে ডামি নির্বাচন
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:১৪
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নির্বাচন। সবাই জানে, নির্বাচন হচ্ছে, হবে; কিন্তু কোন ধরনের নির্বাচন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাবৎ দুনিয়ার মানুষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন, স্বৈরতান্ত্রিক নির্বাচন, একনায়কতান্ত্রিক নির্বাচন সম্পর্কে অবহিত থাকলেও ডামি নির্বাচন, পাতানো নির্বাচন সম্পর্কে হয়তো এবারই মানুষ বেশি পরিমাণে জানতে পারছে। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল, তার মূলে ছিল গণতান্ত্রিক স্পিরিট। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত পূর্বপাকিস্তানের জনগণ ওই সময় গণতন্ত্রের স্পিরিট বলতে অনুধাবন করেছিল, জনগণের সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীন ক্ষমতা, জনগণের সিদ্ধান্তের প্রতি রাষ্ট্রশক্তির শ্রদ্ধা, রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের প্রতি বৈষম্যহীন আইনগত আচরণ ও সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের সব বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকলেও ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জনগণ বাধাহীনভাবে তাদের ভোটের ক্ষমতা প্রয়োগ করে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করতে পেরেছিল। যদিও জনগণের সেই সিদ্ধান্তের প্রতি রাষ্ট্রশক্তি শ্রদ্ধা দেখাতে পারেনি। কার্যত জনগণের সিদ্ধান্তের প্রতি অশ্রদ্ধার কারণেই জনগণ আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল।
দেশ স্বাধীনের পরও জনগণ তার গণতান্ত্রিক ন্যায্যতা পায়নি, ৫২ বছর পরে এসে এখনো পাচ্ছে না। জনগণ যে গণতান্ত্রিক স্পিরিটের জন্য যুদ্ধ করেছিল তার বিপরীতে গিয়ে জনগণকে আইয়ুবি স্বৈরশাসনের চেয়েও ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত করে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্পিরিটের বিপরীত সূত্র দিয়ে গণতন্ত্র শেখানো হচ্ছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলতে জনগণকে এখন শিখতে হচ্ছে, ডামি নির্বাচন, পাতানো নির্বাচন আর ভাগবাটোয়ারার নির্বাচনের কৌশল। অনেকে এটিকে পাতানো খেলা বলে মন্তব্য করছেন। আর এই পাতানো খেলায় গরিব রাষ্ট্রের দৃশ্যত প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার অপচয় করা হবে। পাতানো খেলায় এই গরিব দেশের দুই হাজার কোটি টাকা যেমন অপচয় হবে তেমনি জনগণ হেরে যাবে একটি অনৈতিক ডামি নির্বাচনের কাছে। পাতানো খেলার ফলাফল একটি তারিখে ঘোষণা করার জন্য এত টাকা খরচ করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে এই দেশের জনগণ মনে করে না। কারণ, জনগণ আগে থেকেই জানতে পারছে এই খেলায় কারা জিতবে আর কারা হারবে। তবে, মোটা দাগে এটি বলা যাচ্ছে যে, জিতবে সরকার, হারবে জনগণ।
বিগত ১৫ বছরে দেশে যে গণতন্ত্রের সঙ্কট ছিল, এই ডামি নির্বাচনের পরে সেই সঙ্কট এতটাই তীব্র হবে যে, সেখানে গণতন্ত্রের পরিবর্তে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরতন্ত্র পুরো মাত্রায় দেশ দখল করবে। উত্তর কোরিয়াতেও নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনের চেহারা আর বাংলাদেশের বিগত ১৫ বছরের নির্বাচন ও আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের চেহারার মধ্যে কোনো অমিল নেই। উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনে ফলাফল পূর্ব-নির্ধারিত। বাংলাদেশের আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলও আগে থেকেই নির্ধারিত। ৭ জানুয়ারি শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের চারটি মূল আদর্শের কথা বলেছেন, জনগণের সার্বভৌমত্ব, জনগণের প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবে, গণতন্ত্র কতগুলো আদর্শিক নীতিই নয়; বরং এটি শাসনের একটি পদ্ধতিও। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারকে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হতে হয়। এখানে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বটাই মুখ্য। প্রতিনিধিরা অবশ্যই জনগণের ভোটে প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ের মাধ্যমে জয়-পরাজয়ের মুখোমুখি হবেন, যেখানে পূর্বানুমানের অনিশ্চয়তা থাকবে, ফলাফল প্রাপ্তির পর অপরিবর্তনযোগ্যতা এবং পুনরাবৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে। নাগরিকদের অধিকারের কথা বলার, মতপ্রকাশের, সমাবেশের ও সর্বোপরি এই সবের কারণে আইনি এবং বিচারবহির্ভূতভাবে লাঞ্ছিত না হওয়ার নিশ্চয়তা হচ্ছে গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। আমরা আজকে যে নির্বাচনের কথা বলছি সেখানে এর কোনোটিই বিদ্যমান নেই। কোনো প্রকার ভোট ব্যবস্থায় না গিয়েই আমরা বলে দিতে পারছি, কারা ক্ষমতার স্টিয়ারিং চেয়ারে বসছেন। কে কোন আসন থেকে নির্বাচিত হবেন, সেটি জনগণের সিদ্ধান্তের ওপর নয়; বরং রাষ্ট্রের বর্তমান নির্বাহী প্রধানের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সংসদের বিরোধী দল কে হবে সেটিও নির্ভর করছে ওই এক ব্যক্তির দয়া দাক্ষিণ্যের ওপর। অর্থাৎ আমরা যে ভোট ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি সেটি একেবারেই উত্তর কোরিয়ার মডেল। কোনো অবস্থাতেই এটিকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যাবে না।
দেশের জনগণ আজকে একটি কথার সাথে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন, আর সেটি হলো- সংবিধানের ধারাবাহিকতা। সংবিধানের ধারাবাহিকতা গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক সব পন্থাতেই রক্ষা করা হয়। কারণ, একটি নিদির্ষ্ট সময় পরপর উত্তর কোরিয়াসহ আধুনিককালের সব স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নির্বাচন হয়ে থাকে। সেই নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ থাকে কিনা সেটি মুখ্য নয়, ক্ষমতাসীন দলই মেজরিটি ভোটের মাধ্যমে জয়ী হয়, এটি নিশ্চিত। এ ধরনের একপাক্ষিক ভোটব্যবস্থার নামে ক্ষমতাসীনরা আরো বেশি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। সুতরাং সংবিধানের ‘ধারাবাহিকতা’ এটি একটি রক্ষাকবচ শব্দ মাত্র। এমন একটি ব্যবস্থায় নির্বাচন হচ্ছে যেখানে প্রত্যক্ষভাবেই দেশের ৬৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ সেই নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় নেই। এ ধরনের নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাকে আরো বেশি স্বৈরতান্ত্রিক করার একটি উপায় মাত্র। আজকে আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে, বেশির ভাগ জনগণকে অংশীদারিত্বের মধ্যে না রেখে যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে সেই নির্বাচন দেশকে দীর্ঘ সময়ের জন্য গণতন্ত্রের সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত করবে। এসব নির্বাচন গণতন্ত্রকে সংহত করার বদলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা আরো বেশি সুসংহত করবে, এটি পরিষ্কার।
জনগণ তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও চর্চা করতে পারছে না। কারণ, রাষ্ট্রের সব অঙ্গ বর্তমান সরকারের দাসে পরিণত হয়েছে। পুলিশ বন্দুক তাক করে আছে প্রতিবাদীর বুকে গুলি করার জন্য। স্বৈরতন্ত্রের সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রেখে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন নয়। এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট, নির্বাচনে জালিয়াতির বিভিন্ন ধরনের উপায়ও তারা বের করে রেখেছে, যেগুলোর কিছু প্রত্যক্ষ আর কিছু হচ্ছে পরোক্ষ।
এটিও মনে রাখা দরকার যে, নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়, ভোটাররা এক দিন ভোট দেন, কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নেয়া হয় আরো অনেক আগে থেকেই। আমরা আগে থেকেই প্রত্যক্ষ করছি, ফল প্রভাবিত করার ব্যবস্থা কিভাবে করা হচ্ছে। সুতরাং নির্বাচনের দিন কী হবে, জনগণ সেই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। ভোটারদের জোর করে ভোটকেন্দ্রে আনার প্রক্রিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, এটি হলে তো আরো ভয়ঙ্কর। তবে, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট যে হয়ে যাবে সেই ব্যাপারেও নিশ্চিত থাকা যায়।
একটি পাতানো ডামি নির্বাচন করলেও ক্ষমতাসীন সরকার একটি ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বিএনপিকে ভাঙার জন্য কতগুলো কিংস পার্টি তৈরি করে টাকার বস্তা নিয়ে বসেছিল। বহুজনকে বহুভাবেই বাগিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কৃষিমন্ত্রীর কথায় এক রাতে ২০ হাজার নেতাকর্মীকে মুক্তি দেয়ার শর্তেও বিএনপি এই পাতানো খেলার অংশী হয়নি। এটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির বিরাট বড় অর্জন এবং আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে, রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তাদের হাতের মুঠোয় বন্দী। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কথায় উঠবোস করছে। সেখানে জাতীয় পার্টির নেতারা অনেক বড় বড় কথা বললেও মাত্র ২৬টি আসনের ভাগাভাগিতে রাজি হয়ে ১৭ কোটি জনগণের সার্বভৌমত্বকে অবমূল্যায়ন করেছে। পিঠা ভাগাভাগির এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণকে দীর্ঘকালীন দাসত্বের শিকলে বন্দী করে ফেলার এই ষড়যন্ত্রের দায় থেকে জাতীয় পার্টি কোনো দিন মুক্তি পাবে না।
পরিশেষে বলতে চাই, একটি রাজনৈতিক দলের দেশপ্রেম একটি নির্বাচনে জোর করে জেতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় না। নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে, দুর্নীতিযুক্ত উন্নয়নের ছাপ দিয়ে দেশপ্রেম হয় না। জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের কবর যারা রচিত করছেন এবং যারা এর সহায়ক তাদের প্রত্যেককেই জনতার আদালতে দাঁড়াতে হবে। সেদিন গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক জেগে উঠবে এবং দুঃশাসনকারীর বিচার বাংলার জমিনেই হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা