৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
২০২৩ ছিল হতাশার বছর

প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার

প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার - নয়া দিগন্ত

আমাদের জীবন থেকে চলে গেল আরো একটি বছর। বিদায়ী বছরের ঘটনাবলির দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাবো- দুঃখ-সুখ ও হাসি-কান্নার নানা চিত্র। এসব কিছুর মধ্যে যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো অর্থ। অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের জীবনবোধ, জীবনের গতি চিত্রিত হয়। বিগত দু’টি বছর ২০২১-২২ গোটা বিশ^ কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রভাবিত অর্থনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত প্রত্যক্ষ করেছে। ২০২৩ সালেও জীবনঘনিষ্ঠ বেশ কিছু পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করেছি। ২০২৩ সালে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সঙ্কট, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও তারল্য সঙ্কটের নানা খবর।
নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অগ্রগতি রয়েছে। ২০২৩ সালে বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষে হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হয়েছে, চালু হয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রামে চালু হয়েছে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল ও ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন। তবে শিল্প খাতে কোনো অগ্রগতি লক্ষণীয় নয়। বিশেষ করে ইস্পাত, সিমেন্ট, কারখানার কোনো সুখবর নেই। প্রকল্পগুলোর কাজে অনেক ধীর গতি লক্ষণীয়।

সরকারের রাজস্ব বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়ছে না। দেশে টিআইএনধারী করদাতা আছে ৯৩ লাখের মতো। অথচ ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৩ লাখ ৫০ হাজার ব্যক্তি ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিয়েছে। যার মাধ্যমে আদায় হয়েছে চার হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের রাজস্ব আশানুরূপ না বাড়ায় সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ে ভীষণ টান পড়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে খরচ হয়েছে মাত্র ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

দ্রব্যমূল্য
মূল্যস্ফীতির নিরিখে বলা যায়, ২০২৩ সাল খুব একটা ভালো যায়নি। বছরের শুরুতে নিত্যপণ্যে দাম যেমন ছিল তা দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে শেষেও ঊর্ধ্বমুখীই থেকেই যায়। শাক-সবজি, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, পেঁপে, কপি, কাঁচামরিচ, করলা, লাউ, বেগুনসহ সব নিত্যপণ্যের দাম এতই বেড়েছে যে, ভোক্তা সাধারণ অসহনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
২০২৩ সাল ছিল হতাশার বছর- ঋণের বছর, বড় কষ্টের বছর। অন্তত নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের জন্য পুরো বছরটি ভালো যায়নি। এ বছর মূল্যস্ফীতি রেকর্ড গড়েছে। গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘর স্পর্শ করে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের তিন মাস মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে অক্টোবরে ছিল ১২.৫৬ শতাংশ, যা ছিল গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাজার নিয়ন্ত্রণের জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাঝে মধ্যে লোকদেখানো তদারকিতে সামান্যই সুফল এসেছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো জিনিসের দাম বাড়িয়েছেন। টিসিবির নিত্যপণ্যের দামের তালিকা দেখলে বোঝা যায়, ৫২টি পণ্যের মধ্যে ৩৫টি পণ্যের দাম বেড়েছে।

ব্যাংক খাত
বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময় হার নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা ছিল। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাব বলছে, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল-জুন ২০২৩ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। জানুয়ারি-জুন ২০২৩ ছয় মাসে বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপি গ্রাহকদের আইনের আওতায় আনার জন্য বিশেষজ্ঞরা ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছেন। ট্রাইব্যুনালে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের বিচার করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো খেলাপি গ্রাহকদের মাল ক্রোক করাসহ তাদের জেলে পাঠাতে হবে। বিচারে কোনো আপিলের সুযোগ রাখা যাবে না। অর্থঋণ আদালতের কাজ দ্রুত ও যুগোপযোগী করতে হবে। খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া।

আবার ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয় ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। খেলাপিসহ ব্যাংক খাতের চাপে থাকা সম্পদ রয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ও শরিয়াহ-ভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বছরজুড়ে। সুশাসন ও আর্থিক পরিস্থতির চরম অবনতি ঘটায় সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরো কয়েকটি ব্যাংক ধারদেনা করে চলছে। গত জুলাই ২০২৩ থেকে ১৮২ দিন ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সাথে একটি মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে সুদহার ছিল ১১.৪৭ শতাংশ। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন ২০২৩ পর্যন্ত সুদের সর্বোচ্চ হার ছিল ৯ শতাংশ।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলমানিতে সুদের হার ছিল ৯.১৪ শতাংশ যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১২ সালের পর এবারই কলমানিতে সর্বোচ্চ সুদ হয়। ওই বছর ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ উঠেছিল সুদ হার।

ডলার সঙ্কট
বছরজুড়ে আলোচনা ছিল ডলারের দর নিয়ে। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারিত থাকলেও ব্যাংকগুলো ডলার কিনছে ১২০-১২২ টাকায়। ডলারের রিজার্ভ অনেক দিন ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ডলারের দাম ২০২৩ সালে টাকার বিপরীতে অনেক বেড়েছিল। টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ২৫-৩০ শতাংশ। এ প্রেক্ষাপটে আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে আমরা দুই কিস্তি ঋণের ডলার পেয়েছি।

আমদানি-রফতানি ও রেমিট্যান্স
ডলার সঙ্কটের কারণে একদিকে যেমন রিজার্ভ কমতে শুরু করে পাশাপাশি কড়াকড়ির কারণে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে রফতানি খাতে। আমাদের যে পরিমাণ রফতানি হয় সে অনুযায়ী ডলার দেশে না এসে পাচার হয়ে যায়। সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের রাজস্ব আদায়ের নিম্নহার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আয় বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থাসহ সব সূচকই নেতিবাচক হয়ে পড়ছে।

তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির পাশাপাশি বাজারের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০২২ সালে যেখানে মাসে প্রায় ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসত, সেখানে ২০২৩ সালে প্রথম তিন প্রান্তিকে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার এসেছে। বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে। এই চার খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী।

বৈশি^ক মন্দায় রফতানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি জুলাই-আগস্ট (২০২৩) কমেছে ২৮ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্ধ-বছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এ বছর জুনে রেমিট্যান্স এসেছে ২২০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা কমে ১৬৭ কোটি ডলার, আগস্টে তা আরো কমে এসেছে ১৬০ কোটি ডলার। তিন মাসের হিসাবে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫.১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এসেছিল ১২.২৭ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদানের গতিও নিম্নমুখী ছিল।

সর্বোপরি বলা যায়, ২০২৩ সাল ছিল অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ অনিশ্চয়তার বছর। অস্থিতিশীলতা ছিল সর্বত্র। অর্থনীতির মূল কাঠামো থেকে বিচ্যুতি দেখা গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়ে চলেছে। নতুন বছরে সরকার নতুন করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলের জন্য সঠিক নীতি না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, শ্রম মন্ত্রণালয়, বেপজা, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। আয় ও সম্পদের বণ্টন অসম হওয়ায় বৈষম্য বেড়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া কম দায়ী নয়।

২০২৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আয় ও সম্পদ বণ্টনে সুসম ব্যবস্থা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে হবে।

ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement