যুদ্ধ বিগ্রহ, ধর্মের আলোকে
- প্রফেসর কর্নেল ডা: জেহাদ খান (অব:)
- ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৩৭
গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল না এমন সময় খুব কমই অতিবাহিত হয়েছে। যুদ্ধ বিগ্রহ কেন হয় এবং জীবন, স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব কি আমাদের জানা দরকার। এ ব্যাপারে ইসলামের ভূমিকা কি তাও আমরা জানতে চেষ্টা করব।
বিভিন্ন ধর্মে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও সমরনীতি
ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের দৃষ্টিতে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও সমরনীতি পর্যালোচনা করা দরকার। পৃথিবীর বড় ধর্মের মধ্যে খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধধর্ম যেকোনো পরিস্থিতিতেই যুদ্ধের বিপক্ষে। ইহুদি, হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়।
হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ বেদে যুদ্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক শ্লোক রয়েছে। যেমন ‘মহা শক্তিমান ইন্দ্র রাজা নিজের গৌরবর্ণের (আর্য) বন্ধুদের সহযোগে ভূমি জয় করলেন, সূর্যের কিরণ এবং সাগর জয় করলেন। হে ইন্দ্র, আমাদের সহায় থাক যেন আমরা নির্ভয়ে সম্পদ লুটতে পারি। (ঋগ্বেদ ১৩০:৪৮)
‘হে সোমরসপায়ী! জতুধনদের সন্তান-সন্ততিদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসো এবং ধ্বংস করে দাও। স্বীকারোক্তিকারী পাপীর দুই চোখ বের করে নাও।’ (অথর্ববেদ ৩২:১-৩)
এভাবে চারটি বেদে অনেক শ্লোক রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিন দেশের জমি, সম্পদ, জীবজন্তু ইত্যাদি দখল করা এবং যুদ্ধে অমানবিক পন্থা অবলম্বনে কোনো বাধা নেই।
ইহুদি ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাওরাত পাঠ করলে জানা যায়, যুদ্ধের উদ্দেশ্য রাজ্য জয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সমরনীতি হলো : ‘আমরা প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশুকে প্রত্যেক শহরে হাসুবুনের রাজা সাইহুন ও তার জাতির লোকদের মতোই হত্যা করলাম।’ (তাওরাত ৩:১-৭)
‘যেসব ভূখণ্ড খোদা তোমাদের অধিকারভুক্ত ঘোষণা করেছেন সেখানে কোনো প্রাণীকে জীবন্ত ছেড়ে দিও না, হত্যা করো।’ (তাওরাত ২০:১৬-১৭)
বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনিদের সাথে ইহুদিদের আচরণে এ মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধের উদ্দেশ্য উল্লেখ রয়েছে কুরআন ও হাদিসে। যেমন, ‘আর তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না, অথচ দুর্বল পুরুষ-নারী ও শিশুরা বলছে, হে আমার রব, আমাদের বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।’ (আল-কুরআন ৪:৭৫)
‘তাদের অনুমতি দেয়া হলো যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, কেননা তারা নির্যাতিত। আল্লাহ নিশ্চিতই তাদের সাহায্য করতে সক্ষম।’ (আল-কুরআন ২২:৩৯)
এভাবে কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যায় প্রতিহত করা, অন্যের স¤পদ দখল নয়।
যুদ্ধে যাওয়ার গুরুত্ব
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের সেবা ও তত্ত্বাবধান করাকে ওই ব্যক্তির কাজের সমান মনে করে নিয়েছ, যে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং প্রাণপাত করল আল্লাহর পথে।’ (আল-কুরআন ৯:১৯)
একটি মুসলিম দেশের স্বাধীনতা যখন বিপদাপন্ন হয় বা এর নিরাপত্তা হুমকির মুখে তখন তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা আল্লাহর দৃষ্টিতে অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর নির্ভরশীল।
ইসলামে ন্যায়যুদ্ধের জন্য পুরস্কার
ইসলামে ন্যায়যুদ্ধের পুরস্কার মূলত পরকালে, দুনিয়ার সম্পদ নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মুমিনের থেকে তাদের জান ও মাল, এর বিনিময়ে যে অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।’ (আল-কুরআন ৯:১১১)
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়াই করবে ও নিহত হবে কিংবা বিজয়ী হবে, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট প্রতিফল দান করব।’ (আল-কুরআন ৮:৯৮)
রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহর কোনো বান্দা এমতাবস্থায় মারা যায় যে, আল্লাহর কাছে তার সাওয়াব রয়েছে তাকে দুনিয়ার সব কিছু দিলেও দুনিয়ায় ফিরে আসতে আগ্রহী হবে না, একমাত্র শহীদ ছাড়া। সে শাহাদাতের ফজিলত দেখার কারণে আবার দুনিয়ায় ফিরে এসে শহীদ হওয়ার প্রতি আগ্রহী হবে। (বুখারি : ২৬১১)
ইসলামের যুদ্ধনীতি
এ ব্যাপারে কুরআন হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে গণহত্যার কোনো নজির নেই। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা ফেলে একদিনে এক লাখ ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিক হত্যা করা হয়। তার দুই দিন পর একইভাবে অ্যাটম বোমা ফেলে নাগাসাকিতে বেসামরিক লোক হত্যা করা হয়। তা ছাড়া ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘ অনেক বছর এর ফল ভোগ করে।
আলজেরিয়া দখলে রাখাকালে ফ্রান্স এক কোটি বেসামরিক লোক হত্যা করেছে, ১৭টি নিউক্লিয়ার টেস্ট করেছে যাতে ২৭ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্ত লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে, যার ফল এখনো ভোগ করছে। জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করেছিল এবং ডাক্তাররা জীবন্ত মানুষের ওপর নানারকম অনৈতিক ও বর্বরোচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল।
ব্রিটিশদের আগমনের আগে মুসলিম শাসনে যেমন এ দেশ ছিল সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা। আমাদের দেশ দখলের পর তারা দু’টি দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েছে, যাতে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। জাপানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ ইত্যাদিতে নজিরবিহীন বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। জাপানি অনেক ডাক্তার জীবন্ত মানুষের অঙ্গ কাটা বা নানারকম জীবাণু দিয়ে পরীক্ষা করেছে। জাপানি বিমান থেকে প্লেগ রোগের জীবাণু ছড়ানো হতো।
সৈনিকরা ফ্লাস্কে করে কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগের জীবাণু বহন করত এবং শত্রুদের পানিতে মিশিয়ে দিতো। জাপানি সৈনিকরা সিঙ্গাপুরের আলেকজান্দ্রা হাসপাতালে ঢুকে রোগী, ডাক্তার, নার্স সবাইকে হত্যা করে। বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আচরণ প্রায় একই রকম। সম্প্রতি সম্পদ ও আধিপত্যের জন্য ২৫-৩০ লাখ ইরাকি ও আফগান নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। প্যালেস্টাইন, উইঘুর, কাশ্মির, আরাকান, চেচনিয়ায় একই চিত্র। অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো জাতির কাছে অন্য জাতির জীবন ও স্বাস্থ্য নিরাপদ নয়। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে মুসলিম জাতি।
মুসলিমদের অধীনে ভারতে ও স্পেনে অমুসলিমরা ৭০০ বছর বসবাস করেছে শান্তি ও নিরাপত্তা সহকারে। প্রফেসর কে এস রামকৃষ্ণ রাও বলেছেন : ‘মোহাম্মদ সা: যুদ্ধক্ষেত্রকেও মানবিক করেছেন। তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন কারো তহবিল হস্তগত করা, ধোঁকা দেয়া, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, নির্যাতনপূর্বক হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ করা, শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ হত্যা, লুটতরাজ করা, সম্পদ নষ্ট করা, ফলবান বৃক্ষ কাটা ও উপাসনাকারী কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা।’
‘যখনই তাদের বলা হয় যে, পৃথিবীর বুকে দাঙ্গা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না তখন তারা এটাই বলে যে, আমরা তো মীমাংসাকারী ও সংস্কারক।’ (আল-কুরআন ২:১১)
কোথাও সমাজতন্ত্র বা সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লাখ লাখ লোক হত্যা করা হয়েছে। কোথাও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ, সন্ত্রাস দমন, ডগউ WMD (Weapon of mass destruction) ইত্যাদি নামে লাখ লাখ লোক হত্যা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘যখন তারা ক্ষমতার অধিকারী হয় তখন চেষ্টা করে যাতে সেখানে অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে। আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না। (আল-কুরআন ২:২৫৫)
ইতোমধ্যে আমি উল্লেখ করেছি যে, যেকোনো অমুসলিম জাতি যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হলে ভিন্ন জাতির প্রতি কিভাবে বর্বরোচিত আচরণ করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যদি এক দলকে অপর দল দ্বারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা করতে না থাকতেন, তাহলে যে খানকা, আশ্রম, গির্জা, উপাসনালয় এবং মসজিদে আল্লাহর নাম বিপুলভাবে জিকির করা হয়, সেসবই চুরমার করে দেয়া হতো।’ (আল-কুরআন ২২:৪০)
এ শিক্ষার আলোকেই যুগে যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী ও মুসলিমরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে মানবিক আচরণ করেছে ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী যে, রাসূল সা:-এর মক্কা বিজয়, পরবর্তীতে জেরুসালেম ও স্পেন বিজয়ের সময় মুসলিম সেনাবাহিনীর আচরণ কত মানবিক ছিল। অথচ ক্রুসেডারদের জেরুসালেম দখলের সময় বা খ্রিষ্টান সেনাবাহিনীর স্পেন দখলের সময় তাদের আচরণ কত বর্বরোচিত ছিল।
বর্তমান সময়েও বিভিন্ন মুসলিম দেশে অনেক অমুসলিম বাস করেন। কোথাও তাদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে নিপীড়নের কোনো নজির নেই। অথচ অধিকাংশ অমুসলিম দেশে মুসলিমরা নানারকম নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার। যেমন- হিন্দু ভারতে গুজরাট হত্যাকাণ্ড, বাবরি মসজিদ ও অন্যান্য মসজিদ ধ্বংস করা, বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের বাড়িঘর ধ্বংস করা এবং বিভিন্নভাবে হত্যা, দাঙ্গা, নিপীড়ন ও বৈষম্য চলছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, অনেক দেশে সংখ্যালঘুদের জীবন, জীবিকা বা মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য সুস্বাস্থ্যের আশা করা অকল্পনীয়। ইসলামই এ ব্যাপারে নজিরবিহীন সফলতার পরিচয় দিয়েছে।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা