এবনে গোলাম সামাদের বাংলাদেশ কথা
- এস এম ইসলাম
- ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:২৯
‘বাংলাদেশ কথা’ এবনে গোলাম সামাদের জীবদ্দশায় লেখা সর্বশেষ গ্রন্থ। গ্রন্থটি কলেবরে বড় নয়। মাত্র ১৮৪ পৃষ্ঠার। তবে এর পাঠ্যসূচি দেখলে মনে হবে ছোট ক্যানভাসে অনেক বড় আর তাৎপর্যপূর্ণ এক ছবির নাম ‘বাংলাদেশ কথা’। ১৮৪ পৃষ্ঠার বইটিতে পরিশিষ্ট, পুনশ্চ মিলে আছে ৪৭টি পরিচ্ছেদ। সূচির বিষয়বস্তু আর পরিসর দেখলে মনে হবে, তিনি মৃত্যুর আগে অনেক কথাই বলতে চেয়েছেন এক সাথে যেন বলতেই হবে তাকে। এই গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘বাংলাদেশে ইসলাম’। এবনে গোলাম সামাদ প্রায় প্রতিটি গ্রন্থে এই শিরোনামে জোর দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে বারবার কেন জোর দিয়েছেন তা আরো স্পষ্ট করেছেন এই গ্রন্থে। এর আগে গ্রন্থকার একটি বই লিখেন ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ শিরোনামে। সেখানে তিনি জোর দিয়েছেন বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্তি¡ক পরিচয়ের দিকে। ‘আমার স্বদেশ ভাবনা’ গ্রন্থেও তিনি জোর দিয়েছেন একই বিষয়ে। আর ‘বাংলাদেশ কথা’তে এসে তিনি জোর দিলেন ঐতিহাসিক বিবেচনাকে। তবে এটি ঠিক, এ লেখাতে তার উদ্দেশ্য ইসলামের মাহাত্ম্য নয়, তিনি বলতে চেয়েছেন বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস। কারণ তিনি চিরদিনই বলে এসেছেন- ‘আমি তো ইসলাম বাঁচানোর জন্য লিখিনি, মুসলমানকে বাঁচানোর জন্য লিখছি। দুটো তো এক নয়।’ এর পরের পরিচ্ছেদের শিরোনাম- ‘দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান আন্দোলন’। এরপরই বলছেন, ‘হাজার বছরের বাঙালি’র কথা। তার পরে ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’। এরপর ‘আমাদের জাতিসত্তা গঠনে রবীন্দ্রনাথ’, কাজী নজরুল ইসলাম, আমাদের রাজনীতিতে হিন্দুত্ব, বাংলাভাষী অঞ্চলে অনার্য সভ্যতা। ঠিক এর পরের পরিচ্ছেদেই বলছেন, ‘আমরা শান্তির পক্ষে’। শিরোনাম অনুযায়ী গ্রন্থের এগিয়ে চলা দেখে আমাদের বুঝতে অসুবিধা থাকে না, তিনি আসলে কী বলতে চাচ্ছেন তার এই গ্রন্থে। তিনি আসলে আমাদের বলতে চেয়েছেন, আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়। দিতে চেয়েছেন আমাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান।
‘বাংলাদেশ কথা’ গ্রন্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচ্ছেদ হলো- ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’। পরিচ্ছেদটুকু খুবই ছোট। এত স্বল্প পরিসরে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে বিশ্লেষণ করা যায়, তা দেখে অবাক লাগে। তিনি জগৎখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে এবং নিজের যুক্তি দিয়ে কিছু বিষয়ের এমন সব মীমাংসা দিয়েছেন, যা দেখে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে বিস্মিত না হয়ে পারি না। বৈদিক আর্য আর সংস্কৃত ভাষাভাষী আর্যদের যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ছোট্ট পরিসরের এই বিশ্লেষণ পাঠে মনে হয়নি তা তত্তে¡র ঠাসবুনটের জঞ্জাল। সবচেয়ে বড় কথা, এবনে গোলাম সামাদ একজন ভাষাবিজ্ঞানী নন। এমনকি ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্রও নন। তিনি যে, একজন সর্বজ্ঞানে জ্ঞানবৃক্ষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর পরের পরিচ্ছেদগুলো আরো গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখক, বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী, হুমায়ুন কবির, বাংলার সাধনা, মুসলিম বিশ্বে নন্দন-চর্চা, বাংলাদেশে ভাস্কর্য চর্চা, স্পেনে মুর মুসলিম সভ্যতা, বায়ত আল-হিকমা, আমাদের সংস্কৃতিসহ আরো কয়েকটি পরিচ্ছেদ। এগুলো পড়তে পড়তে এবনে গোলাম সামাদকে কখনো মনে হয় শিল্পকলার ছাত্র আবার কখনো মনে হয় ইতিহাসের। কখনো অর্র্থনীতির আবার কখনো তুলমামূলক ধর্মতত্তে¡র ছাত্র। যোগ্য শিক্ষাবিদ। ‘বাংলাদেশ কথা’ সম্পর্কে যদি এক কথায় বলি, তা হলে বলতে হয়, একজন জিজ্ঞাসু পাঠকের জন্য এটি একটি আকর গ্রন্থ। আছে অতীত, আছে বর্তমান, আর সেই সাথে আছে ভবিষ্যৎও। আছে ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানে আমাদের করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা। তবে তার বিশ্লেষণ কোনো ছকে বাঁধা নয়। একটু আলাদা। গতানুগতিক থেকে আলাদা। নেই কোনো একঘেয়েমিও। ঝরঝরে ভাষার বুনন পাঠককে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।
বর্তমান সময়ের বিবেচনায় ‘বাংলাদেশ কথা’ গ্রন্থটি অধিকহারে পঠিত হওয়া আবশ্যক। ইতিহাস পাঠে পাঠককে এবনে গোলাম সামাদ একজন বিচারকের আসনে বসাতেই পারেন। কারণ ইতিহাস বিচার করার ক্ষমতা একজন পাঠকের আছে। আর অবশ্যই তা সঠিক তথ্যের আলোকে। এবনে গোলাম সামাদ আসলে একজন অভিজ্ঞতাবাদী মানুষ। তার এই দীর্ঘ জীবনে দেখেছেন অনেক কিছু। ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তান শাসন; আবার এখন দেখলেন বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির কড়চা। দেখেছেন ভাষা আন্দোলন, দেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা করেছেন সম্পাদনা। করেছেন অধ্যাপনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ সময় অধ্যয়ন করেছেন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত পুয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গ্রন্থ রচনা করেছেন শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে, জীবাণুতত্ত্ব ও রোগতত্ত্ব নিয়ে। রচনা করেছেন নৃতত্ত্বের আকর গ্রন্থ। আবার দীর্ঘদিন তিনি লিখেছেন পত্রিকার স্তম্ভ। তার লেখার বৈচিত্র্য দেখে মনে হয়, তিনি এক জীবন্ত জ্ঞানকোষ। আমরা ‘বাংলাদেশ কথা’ গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি। আর আমরা এও চাই; এর মধ্য দিয়ে পাঠকের মধ্যে শুরু হোক তুলনামূলক ইতিহাস চর্চা। ভাঙুক সত্য-মিথ্যার ইতিহাস চর্চার আগল। ‘বাংলাদেশ কথা’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে রাজশাহীর পরিলেখ প্রকাশনী। এর গায়ের মূল্য ৩৬০ টাকা।
এবনে গোলাম সামাদ তার এক লেখায় বলেছেন, যে সব কালজয়ী প্রতিভাবান ব্যক্তি আমাকে প্রভাবিত করেছেন তাদের মধ্যে একজন কার্ল ফন লিনে (১৭০৭-১৭৭৮)। ইনি ছিলেন সুইডিস। কিন্তু সুইডিস ভাষায় বই না লিখে, তার সময়ের পণ্ডিতদের মতো বই লিখেছেন লাতিন ভাষায় (আত্মদর্শন বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি)। লিনিয়াস পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। চিকিৎসক হিসেবে তিনি ছিলেন বেশ খ্যাতিমান। কিন্তু শ্রেণিবদ্ধ করে আলোচনা করার চেষ্টা করেছেন উদ্ভিদ, প্রাণী ও আকরিক বস্তুদের। আর সে জন্যই পেতে পেরেছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বৈচিত্র্যগত দিক দিয়ে এবনে গোলাম সামাদকে বর্তমান সময়ের লিনিয়াস বা লিনিয়াসের উত্তরসূরি বলতেই পারি। আমরা জানি, এবনে গোলাম সামাদ পড়াশোনা করেছেন কৃষিবিদ্যা নিয়ে। পরে ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব নিয়ে। এর আরো পরে ১৯৬০ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যান পড়াশোনা করার জন্য। সেখানে বিখ্যাত পুয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন জীবাণুতত্ত্বে। সেখান থেকে ফিরে ১৯৬৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে। ছাত্রদের পড়ান উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ও জীবাণুতত্ত্ব বিষয়ে। কিন্তু এবনে গোলাম সামাদকে মানুষ যতটা না চেনেন উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র বা উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর হিসেবে, তার হাজারগুণ বেশি করে চেনেন একজন সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে।
এবনে গোলাম সামাদ ‘বাংলাদেশ কথা’র সমাপ্তি কথনে বলেছেন, ‘আমরা এখনো একটি আদর্শ রাজনৈতিক বিশ্ব গড়ে তুলতে পারিনি। এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিশ্ব গণতন্ত্র। এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র কথা বলছে শক্তির ভাষায়। যুদ্ধ এখনো হয়ে আছে একটি ভয়াবহ ঘটনা। যুদ্ধের কথা বিশেষভাবে মনে রেখেই রচনা করতে হবে বাংলাদেশের জাতীয় নীতি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, বাংলাদেশ না চাইলেও যুদ্ধ এসে পড়তে পারে তার ওপর। ‘শান্তি কামনা করলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়’ (Si vis pacem para bellum)। আমাদেরও থাকতে হবে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর সাবেক পাঞ্জাব প্রদেশে ঘটে পাঞ্জাবি মুসলমানদের সাথে পাঞ্জাবি হিন্দু ও শিখদের ভয়াবহ দাঙ্গা। একটি হিসাব অনুসারে, এতে নিহত হয় প্রায় তিন লাখ মানুষ। আর গৃহহীন হয় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এ রকম ভয়াবহ ঘটনা মানব ইতিহাসে ইতঃপূর্বে আর কখনো ঘটেনি। ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতে রিফিউজি হয়ে যায় প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে নিহত হয়েছে ৩০ লাখ মানুষ। এই পরিসংখ্যানটি নিয়ে বিতর্ক আছে কিছুটা। আমরা তার মধ্যে যাব না। কিন্তু বলব, ১৯৭১-এ যা ঘটেছে, তা ঘটা উচিত ছিল না। যুদ্ধকে যতদূর সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করতেই হবে।’
এরপরই তিনি উল্লেখ করেছেন ১৯৬৪ সালে চীনের পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের কথা। বলেছেন ভারত ও পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের কথা। এই ধারাবাহিক বর্ণনার মাধ্যমে তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, ‘এখন পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে তাতে হতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার। তা ছাড়া চীনও জড়িয়ে পড়তে পারে যুদ্ধে। এসব কথা মনে রেখেই স্থির করতে হবে বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতি। কারণ আমাদের জাতীয় জীবনে আবারো ঘটতে পারে অতীত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ব্রিটিশ শাসনামলে আজ যেখানে বাংলাদেশ, সেখানকার দু’টি বড় সমস্যা ছিল দুর্ভিক্ষ ও মহামারী। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বিরাট দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতে খাদ্য চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এরপর বাংলাদেশে আর কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে যেতে পারছি। আর পারছি দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করতে।’ এই গ্রন্থের প্রতিটি পরিচ্ছেদ নিয়ে একেক করে আলোচনা করা যেতে পারে। কারণ বর্তমান সময়ের বিবেচনায় এর প্রত্যেকটির গুরুত্ব অনেক বেশি। একে এবনে গোলাম সামাদের শেষ জীবনের একটি নির্দেশনা গ্রন্থও বলা যেতে পারে। বিশেষ করে চিন্তকের জন্য কিংবা তরুণের জন্য। কোনো কোনো বিষয়ে দ্বিমত তৈরি হতেই পারে কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের বিশ্বাস, ‘বাংলাদেশে কথা’ টিকে থাকবে অনেক দিন সাধারণ ব্যস্ত পাঠকের মনে। হয়তো চিন্তকেরও।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা