৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাজনীতির খেলারামরা সক্রিয়, কোথায় গড়াচ্ছে পানি

- ছবি : সংগৃহীত

চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা থিতিয়ে গেছে। এর মধ্যেই ঢাকায় শতরকম আশঙ্কা, বিপত্তি কাটিয়ে অবশেষে ১০ ডিসেম্বর সমাপ্ত হলো বিএনপির গণসমাবেশ। শেষমেশ গোলাপবাগ মাঠে এ গণসমাবেশ হলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ ভয়-ভীতি, শঙ্কা, আতঙ্ক ও নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেও গণসমাবেশে হাজির হয়েছে। অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট না হলে জনসমাগম আরো বেশি হতো বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।

অবশ্য ১০ তারিখের আগে থেকেই গণসমাবেশের স্থান নিয়ে পেকে গিয়েছিল পল্টনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তালগোল। লাশ পড়ল। মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাসসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে তছনছ, সমানে ধরপাকড়, ঢাকা আসার পথে পথে তল্লাশিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তারিকাটি ছিল বেশ দীর্ঘ। এর মধ্যে ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে’, ‘মহাসমাবেশে যোগ দেবেন খালেদা জিয়া’, ‘ঢাকা অচল করে দেয়া হবে’, ‘সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত গণ-অবস্থানের ঘোষণা আসতে পারে’, ‘সতর্কতার জন্য রাজপথ, জনপদ, শহর, জেলা, থানা, ওয়ার্ডসহ অলিগলিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান, প্রয়োজনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা’, ‘খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে আবারো জেলে পাঠানো সরকারের হুঁশিয়ারি’, ‘শ্রীলঙ্কার মতো বঙ্গভবন, সচিবালয়ে লাখ লাখ মানুষ ঢুকে পড়তে পারে’সহ এমন অনেক গুজব, আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল এই ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে।


অবশেষ কিছুই হলো না। শান্তিপূর্ণভাবে গণসমাবেশ হলো। সমাবেশ শেষে যে যার মতো বাড়ি চলে গেল। তবে থেকে গেল অপরাজনীতির সংস্কৃতি আর বিতর্কিত কথাবার্তার সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। প্রশ্ন হলো, আপাতত জাতি কি এ থেকে রক্ষা পেল?

যে যা পারছেন করে ফেলছেন। কয়েক দিন একটু সমালোচনা, চর্চা বা গসিপ হচ্ছে তারপর ভুলে যাওয়া। প্রায় নিয়মিত গোলটেবিল-লম্বাটেবিল আলোচনায় সরকারের সমালোচনা হচ্ছে। শাসনব্যবস্থা, নির্বাচন, ভোট, সরকারের লেজিটেমিসি নিয়ে হেন কোনো কথা নেই, বলা হচ্ছে না। এর বিপরীতে কেবল ক্ষমতাসীন দল নয়, পুলিশ, মিলিটারি, বিচারালয়, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সুধীজন সরকারের হেন বন্দনা নেই যা না করছেন। অনেকের মুখের জোর কেবলই বাড়ছে। সাথে একটু চাতুরী থাকলে তো আর কথাই নেই। মুখের জোরে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে দেয়া যাচ্ছে নিমেষে।

মেধা-শিক্ষা, নীতিনৈতিকতা, সততার কোনো প্রশ্ন আসছে সেখানে? মুখে জোরওয়ালা নেতারা কিছু না বললে গণমাধ্যমকর্মীরা নিউজ ক্রাইসিসে ভোগেন। ওবায়দুল কাদের, মির্জা ফখরুল, হাছান মাহমুদ বা রিজভীর কেউ একজন দুয়েক দিন ফিল্ডে না থাকলে রাজনৈতিক নিউজের ছেদ পড়ে যায়। নিয়মিত কথাশিল্প মুখপাণ্ডিত্য চালাতে হয়েছে তাদের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুখজোরকে থোঁতাবাজি, চোপাবাজি, গলাবাজি ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। থোঁতার জোরের এ সংস্কৃতি রাজনীতির মাঠ গড়িয়ে এখন অন্যদেরও পেয়ে বসেছে। মিথ্যা বলেন না কেউই। ফুটপাথের ফেরিওয়ালা-দোকানদার থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক কেউই না। সত্যাচারের সাথে যে যা পারছেন করে ছাড়ছেন। কারণ সত্য-মিথ্যা, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ সবই এখন আপেক্ষিকতায় ঠাসা। মুখের সাথে তাদের শরীরী ভাষাও সেই বার্তাই দিচ্ছে। তারা সমাদৃত। এতে বোধ-বুদ্ধি ভোঁতা করে রাখা ছাড়া উপায় কী?

পরস্পরকে মিথ্যুক প্রমাণের পাশাপাশি কেউ কাউকে সামান্যতম বিশ্বাসের কোনো বালাই নেই। নিম্নমানের ভাষায় কে কাকে কত খাটো করবেন সেই চেষ্টাও বিস্তর। একজন কিছু একটা বললে আরেকজনের প্রথম দায়িত্ব হয়ে পড়ে ‘মানি না, মানি না’ আওয়াজ প্রতিষ্ঠা করা। কোনটা মানেন বা মানবেন- সেটিও কেউ জিজ্ঞাসা করেন না তাদের। বিএনপির সমাবেশে বিশাল গণজমায়েত আওয়ামী লীগের কাছে আমল পাচ্ছে না। তাদের কাছে বিএনপির সমাবেশের মানুষ জব্বারের বলীখেলার চেয়েও কম। একদলের কর্মসূচিকে আরেক দল নাটক বলতে বলতে এখন ঘটনাকেও নাটক বলতে মুখে বাধে না।

আবার সবজান্তার ভাবও আছে। চলমান খেলায় সব কিছুর জন্য সরকারকে দায়ী করে শর্টকাটে খেলা শেষ করার একটি আচানক খেলা চলছে। খেলারাম এখন সবখানে। এর সংক্রমণে সব শ্রেণিপেশার মানুষই আক্রান্ত। যোগফলে মূল্যবোধের চরমতম অবক্ষয়। সততা ও ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বন্ধ। মেধা-যোগ্যতার চেয়ে ফ্যাক্টর অন্য কিছু।

গত কিছু দিনের আলামত বলছে, ক্রিকেটের মতো লম্বা সময়ের খেলায় আর অভ্যস্ত নন রাজনীতিকরাও। বড়জোর ওয়ানডে ম্যাচে ফল ঘরে তোলার একটি তাড়না স্পষ্ট। ফুটবল, ক্রিকেট মাড়িয়ে রাজনীতিতে এখন রাগবি, রেসলিং, কাবাডি, লুডু, কানামাছি অনেক খেলার ধুম। খেলার রকমফেরও এখন নানাদিকে। হা-ডু-ডুতে কেবল ঘিরে ধরে টেনে নামানো হচ্ছে না। না ধরে ফ্রি রেখে শক্তি ক্ষয় করে কাহিল অবস্থায় নিয়ে এক চাপে ঘাড় মটকে দেয়ার কৌশল আছে। সাপ-লুডুতে দম মেরে থেকে পিক আওয়ারে সাপের নীল বিষে শুইয়ে দেয়ার বিষয় থাকে। আর দাবা রাজনীতির মতোই অত্যন্ত জটিল এক খেলা।

সঠিক সময়ে সঠিক চালটি না দিতে পারলে সব থাকার পরও সামান্য এক সৈন্য কিংবা এক ঘোড়ার কাছেও রাজাকে হেরে যেতে হয় শোচনীয়ভাবে। ক্যারমের তো এক ঘুঁটিতে পাঁচ-সাত ঘুঁটিকে টোকাটুকিতে শেষমেশ গর্তে ঢুকিয়ে দেয়ার কৌশল। বাকি ঘুঁটিবাজদের কখনো কখনো তা ধারণায় আসে না।

ক্রিকেট-ফুটবল-হ্যান্ডবল বা হা-ডু-ডুর বাইরেও কিছু খেলা আছে। এতে মাঠ লাগে না। ফিজিক্যাল ফিটনেসও দরকার পড়ে না। কখনো কখনো মানসিক বিকৃতমনারাও ঘরে বসে সাপ-লুডু, দাবা টাইপের খেলায় বেশি ভালো করেন। এ সাপ-লুডু, দাবা খেলা ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’ ডাকছে। এ খেলা বড়ই ভয়ঙ্কর। খেলোয়াড়রা আরো ভয়ঙ্কর। তারা অঙ্কের সাপ-লুডুতে নীল তিমি ডাকেন।

রাজনীতিতে সাপ-লুডু, কাবাডি, ক্যারম, দাবা ধরনের খেলা বরাবরই চলে। এসব খেলায় উপরে উঠতে থাকা পক্ষ নিজেদের শক্তি-মহাশক্তি ভাবতে থাকে। দাপটের শিখরে আজীবন থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতেও উঠেপড়ে লাগেন। হাল চিত্র আরো ভিন্ন। বৈশ্বিক পরাশক্তির দ্বন্দ্ব ও স্থানিক সাপ-লুডু, হা-ডু-ডু, দাবায় দেশে দেশে সরকার পরিবর্তনের ঢেউ বইছে। আফগানিস্তান, হাইতি, কিউবার মতো দেশগুলোতে অস্থিরতা চলছে। এর তাপ-চাপ ছড়ছে আশপাশে। ছোট ছোট বিভিন্ন দেশে পছন্দের সরকার বসানোর খেলায় নেমে পড়ছে পরাশক্তিভুক্ত দেশগুলো। আলামত বলছে, খেলাটিকে তারা ভিডিও গেমসের দশায় এনে ঠেকাচ্ছে। খেলার এ চাল কোথাও লাল সাপের পায়ে পড়ছে। কোথাও পড়ছে কালো সাপের ফাঁদে। কালো সাপের মুখে পড়লে নিচে নামতে হবে আর লাল সাপ তাকে উন্নত জায়গায় উঠিয়ে দেবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেলারামরা না দমলে বা তাদের দমানো না গেলে শঙ্কামুক্ত থাকছে না বাংলাদেশও।

এর আড়ালে যে কত খেলা হয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি কাতারেও যে কেবল ফুটবল খেলা হলো মোটেই তা নয়। বলের সাথে সেখানে তেলের খেলাও ছিল তুঙ্গে। বিশ্বদুর্যোগের এ সময়ে কাতারের সাথে ২৭ বছরের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার চুক্তি করে জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে গেল চীন। এ দিকে রাশিয়ার জ্বালানিতে পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিলেও চীন তার থোড়াই কেয়ার করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের খবর বলছে, চলতি বছর চীনে রাশিয়ার জ্বালানি রফতানি ৬৪ শতাংশ বেড়েছে।

এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নোভাক। এতে মস্কোরও রফতানি বেড়েছে, আবার চীনেরও লাভ, কারণ তারা রাশিয়ার কাছ থেকে বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে জ্বালানি পাচ্ছে। এর পাশাপাশি ইকোনমিক টাইমসের সংবাদ হচ্ছে- রাশিয়া থেকে আমদানি করা জ্বালানি তেল পরিশোধন করে বাংলাদেশে রফতানির চিন্তা করছে ভারত। মহাজনী শক্তির আয়োজিত-প্রযোজিত এসব খেলাধুলায় জয়-পরাজয় সাজ-সজ্জা, প্রচার, আবেগ-হুজুগ, ভেতরে ভেতরে গড়াচ্ছে অনেক দূর। গড়ের অঙ্কে এর সব যেন হরিবল না হয়, সে দিকে নজর দেয়া আমাদের জন্য সময়ের দাবি। ডিসেম্বরে ফাইনাল খেলায় মত্ত হওয়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক এ খেলায় আমাদের অবস্থান কোথায় গড়াবে, তা ভাবা জরুরি।

সময়টা এমনিতেই খারাপ। বৈশ্বিক মহামারী করোনার পর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বমন্দার তাপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। আমাদের রিজার্ভ কমেছে। এসব কারণে ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দেশে গুজবের ধুম। একটির মধ্যেই আরেকটিকে আছড়ে ফেলা হয়। এ অপখেলার মধ্য দিয়ে রাজনীতি আরো খেলাময় হয়ে উঠছে।

কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে? পানি কোন দিক থেকে কোন দিকে গড়াচ্ছে? এক জনমে কত খেলা হজম করা যায়? গল্প নয়, কারো কাছে শোনাও নয়। দিব্যি দেখছে মানুষ। অথচ উন্নত বা ধনী দেশগুলোও অর্থনৈতিকভাবে হিমশিম খাচ্ছে। তারা বিদ্যুৎ, জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেখানে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে, রিজার্ভ কমছে। সেই অবস্থায় বাংলাদেশকে এখনো স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে পারার সক্ষমতা চ্যালেঞ্জিং...

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement