২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য : প্রসঙ্গ গাইড বই

- ছবি : সংগৃহীত

শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টিধর্মী চিন্তার উন্মেষ ঘটানো, যা ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিধৃত হয়েছে। গাইড এবং নোট বই এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল পাঠ্যবই পড়ার ক্ষেত্রে নিস্পৃহ করে তোলে, অপর দিকে শিক্ষকদেরও শ্রেণিকক্ষে সৃষ্টিধর্মী চেতনার পাঠদানে নিরুৎসাহিত করে। গাইড ও নোট বই নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নির্বিশেষে শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য পূরণের পথে অন্যতম প্রধান বাধা, যার বিষময় ফলাফল আমাদের শিক্ষাঙ্গনে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে আপিল বিভাগ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে গাইড এবং নোটবই নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকারকে হাইকোর্ট কর্তৃক এক নির্দেশনা প্রদান সম্পর্কিত আদেশকে নতুন করে উচ্চকিত করে রায় দেন। নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, নোটবই আমদানি, প্রকাশ, বিপণন, বিতরণ নিষিদ্ধ করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, ক্ষেত্রবিশেষে উভয় শাস্তি প্রদানের বিধান করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জেলা প্রশাসকদের যেকোনো ধরনের গাইড বই, নোট বইয়ের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। এই নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত গাইড বা নোট বই প্রকাশক ও বিক্রেতার ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা নেই।

৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিস শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৫৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শিক্ষকদের উৎকোচ প্রদানের ব্যাপারে সতর্কপত্র দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিপণন এবং বিক্রয়ের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করে শিক্ষক এবং ছাত্রদের প্রলুব্ধ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা নেই। বর্তমানে বাজারে বছরে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসার ক্ষেত্র গাইড ও নোট বইয়ের প্রকাশনা ও বিপণন। প্রকাশকদের অনেকে আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই চালিয়ে যাচ্ছেন এই ব্যবসা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো উদাহরণ না থাকায় তারা আরো সাহসী এবং উৎসাহী হচ্ছেন নিঃসন্দেহে।

শিক্ষকরাও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে। অভিভাবকরাও ভালো ফলাফলের জন্য এসব গাইড বই এবং নোট বই শিক্ষার্থীদের কিনে দিচ্ছে, যাতে শিক্ষার্থীদের শেখার স্পৃহা এবং সৃষ্টিধর্মী তৎপরতা ব্যাহত হয় নিঃসন্দেহে। এসব আইন এবং হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একধরনের প্রকাশক অব্যাহতভাবে গাইড বই এবং নোট বই প্রকাশ করেই যাচ্ছেন। একই সাথে কিছু শিক্ষকও এসব বই পড়তে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে থাকেন। আর এসবই হচ্ছে শিক্ষা অধিদফতর এবং শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের চোখের সামনে।

অসংখ্য ভুলে ভরা এসব বই শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিমুখী চিন্তাচেতনার অনুকূলে নয়। এটা অনুধাবন করে সরকার সবধরনের গাইড এবং নোট বই প্রকাশনা ও বিপণন শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করেছে। সরকারের এই ঘোষণায় বাজারে গাইড ও নোট বই প্রকাশ, প্রচার ও বিপণন কমার কথা। অথচ সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অপ্রতিহত গতিতে প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গাইড ও নোট বই। বরং বিভিন্ন আকর্ষণীয় নামে রঙ-বেরঙের এসব বইয়ে বাজার সয়লাব। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে গাইড ছাড়াও চাকরিসংক্রান্ত গাইড বইয়ের এখন ছড়াছড়ি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর চাকরি, বিসিএস, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্যাডেট কলেজে ভর্তি, ব্যাংকের চাকরিসংক্রান্ত গাইডের ব্যবসা এখন রমরমা। দিন দিন এর ব্যাপ্তি বাড়ছেই। অথচ একসময় গাইড বইয়ের এ ধরনের প্রচলন ছিল না। স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার পর বাজারে পাওয়া যেত টেস্ট পেপার। বিভিন্ন স্কুলের বা বোর্ডের টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্কলন ছিল এটা। শিক্ষার্থীরা এসব টেস্ট পেপার দেখেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের সাথে পরিচিত হতো এবং প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পেত। তাদের চিন্তা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে এটা সহায়ক ছিল। এখন ঘটেছে উল্টোটা। তৈরি উত্তর মুখস্থ করে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে ঠিকই; কিন্তু মেধার বিকাশ ঘটছে না।

বর্তমান সৃজনশীল ধরনের পাঠ্যক্রমে গাইড বই শিশুদের চিন্তার বিকাশের সহায়ক না হয়ে স্থবির করে তুলছে। ফলে একই প্রশ্ন ভিন্ন মাত্রিকতায় করা হলে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করতে পারে না। অপর দিকে একশ্রেণীর অভিভাবক গাইড বই কেনায় স্বস্তি লাভ করেন। কারণ একটি গাইড বই অনেক পাঠ্যবই কেনা থেকে তাদের আর্থিকভাবে দায়মুক্তি দেয়। শিক্ষকদের অনেকেই গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। এতে তাদের কষ্ট করে পাঠ্যবইয়ের পাতা ঘাঁটতে হয় না। ফলে এসব শিক্ষকও একসময় লেখাপড়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বকীয়তা, সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলেন।

গাইড বই সহজলভ্য হওয়ায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিজস্ব চেষ্টায় কোনো কিছু ভাবতে পারে না। অথচ বারবার চেষ্টা করাই হচ্ছে সৃজনশীলতার প্রথম ধাপ। এভাবেই জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টিশীল কর্মধারা থেকে, চিন্তা থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মজীবনে। কর্মবিমুখতা, চিন্তার দৈন্য গ্রাস করছে সামগ্রিক জাতীয় জীবনকে। উজ্জ্বল সৃষ্টিমুখর কর্মচঞ্চল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অন্বেষায় গাইড ও নোটবইয়ের প্রচার, প্রসার, প্রকাশনা শক্ত হাতে দমন করা দরকার। জাতির ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে এটা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ
Email- [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
মির্জাপুরে মুসলমান হলেন একই পরিবারের ৪ সদস্য আ’লীগ নেতাকে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে প্রশাসনের সভা এএফপির ২ গাজা যুদ্ধের সংবাদদাতা পুরস্কৃত ইসকনের শুরু যেভাবে, বিতর্কিত যে কারণে ‘জুলাই বিপ্লবে চট্টগ্রামের শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেবে চসিক’ জয় দিয়ে এশিয়া কাপ মিশন শুরু বাংলাদেশের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে ভারত : জয়শঙ্কর আইনজীবী আলিফ হত্যার বিচার ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে ঝিনাইদহে হেফাজতের বিক্ষোভ খাগড়াছড়িতে কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার চট্টগ্রাম আবাহনীকে হারাল কিংস আওয়ামী লীগের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে : আব্দুল হাই শিকদার

সকল