৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা ফুটবল উন্মাদনা খুলবে নতুন দিগন্ত!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মঙ্গলবার আর্জেন্টিনা-সৌদি আরব ম্যাচ দেখছে দর্শকরা। - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বকাপ ২০২২ আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স ফাইনাল টাইব্রেকারে ৪-২ গোলের ব্যবধানে ফ্রান্স পরাজিত। তৃতীয় বার বিশ্বকাপ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পরাশক্তি আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার এই দাপুটে বিজয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা দূরত্ব ১৭ হাজার কিলোমিটার। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সরাসরি বিমান যোগাযোগ নেই। ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, কোনো কিছুতেই কোনো মিল নেই। মিল আছে শুধু আর্জেন্টিনার নান্দনিক ফুটবল খেলায় বাংলাদেশের ১০ কোটি মানুষের ম্যারাডোনা ও মেসির প্রতি ভালোবাসা। বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে দূতাবাস নেই। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় আর্জেন্টিনা দূতাবাস বন্ধ হয়ে যায়। দুই দেশই দূতাবাস খোলেনি। তবে সীমিত আকারে ব্যবসায়-বাণিজ্য আছে। দুই দেশের মধ্যে ফুটবল র‌্যাংকিং আকাশ পাতাল ব্যবধান। বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা ফুটবলপ্রেমীদের বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন নির্মাণ করেছে ম্যারাডোনা এবং মেসির প্রতি ভালোবাসা।

দুটো দেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতি ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি যোগাযোগ ছাড়াই ফুটবল উন্মাদনা ম্যারাডোনা এবং মেসির প্রতি ভালোবাসা দু’টি দেশকে কত কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশীদের মুখে মুখে যেমন আর্জেন্টিনা, তেমনি আর্জেন্টাইনদের মুখে মুখে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় যেমন আর্জেন্টিনার পতাকা, তেমনি আর্জেন্টিনার রাস্তায় রাস্তায় বাংলাদেশের পতাকা। কাতারে তো দেখেছি আমাদের পতাকা হাতে মাথায়, গলায় নিয়ে ওদের উল্লাস। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উন্মাদনায় মুগ্ধ আর্জেন্টাইন কোচ স্কালোনি, জানিয়েছেন ধন্যবাদও! ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়, ১৯৯০ সালে রেফারির একপেশে নীতি, ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনাকে বহিষ্কার। ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটারের একপেশে নীতি, ম্যারাডোনার প্রতি অবিচারে বাংলাদেশের নাগরিকদের আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসা, সমর্থক বেড়েছে।

১৯৯০ ফাইনালে বিতর্কিত এক পেনাল্টিতে হেরে ম্যারাডোনার কান্নার সাথে বিশ্বে আর্জেন্টিনার ভক্তরা কাঁদলে। বাংলাদেশের কোটি কোটি ফুটবল ভক্ত কেঁদেছে। এভাবেই আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার চেয়েও বেশি সমর্থক বেড়েছে বাংলাদেশে। ২০১৪ ফাইনালে সেই জার্মানির ন্যায়ার হিগুয়েনকে করা সেই ফাউলে আর্জেন্টিনাকে পেনাল্টি বঞ্চিত করা, সাথে ১১৩ মিনিটের যুদ্ধে হেরে মেসিদের কান্না আর্জেন্টিনা সমর্থকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ইউরোপের দাপট থামিয়ে ল্যাটিনদের আবারো চ্যাম্পিয়ন করল। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন। বিশ্ববাসী ও বাংলাদেশের নাগরিকরা ২০২৬ বিশ্বকাপেও মেসির পায়ের জাদু দেখার অপেক্ষায়।

বাংলাদেশের নাগরিকদের ম্যারাডোনার প্রতি সমর্থনের কারণে আমাদের ছাদে, হাতে, গায়ে আর্জেন্টিনার পতাকা। আর্জেন্টাইন ভক্তরা ফুটবল জাদুকর মেসির দলকে সংবর্ধনা দিচ্ছে, তেমনি আর্জেন্টিতেও অনেকের হাতে ওদের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকাও শোভা পাচ্ছে। ওরা চিৎকার করে বলছে, আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমরাও বলছি, আমরাও আর্জেন্টাইনকে ভালোবাসি, ম্যারাডোনা ও মেসিকে ভালোবাসি।

এটি শুধু ফুটবলের পক্ষেই সম্ভব। ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনা ও মেসির প্রতি ভালোবাসা কূটনীতিতে বাংলাদেশ এবং আর্জেন্টাইনদের এগিয়ে নিয়েছে। আগামী চার বছর পরও এই সমর্থন বিন্দুমাত্র কমবে না।

১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বিশ্বকাপে যে ট্রফিটি দেয়া হতো সেটি ছিল জুলেরিমে। আর ১৯৭৪ থেকে বর্তমানে যে ট্রফিটি দেয়া হয় এটি হলো বিশ্বকাপ। জুলেরিমে আর বিশ্বকাপের মধ্যে তফাৎ আছে। বিশ্বকাপে ৩২টি দল অংশগ্রহণ করে। জুলেরিমেতে ১৬টি দল অংশগ্রহণ করত। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই হয়। অনেক জুলেরিমেয় কোয়ালিফাই হয়নি। বর্তমান বিশ্বকাপ যেই সেই দল অংশগ্রহণ করতে পারে না, কিন্তু জুলেরিমেয় ভারতও খেলার সুযোগ পেয়েছিল। ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান যা ১৯৭৪ থেকে শুরু হয়েছে; মোট আসর হয়েছে ১৩টি। আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলেছে পাঁচটিতে- ১৯৭৮, ১৯৮৬, ১৯৯০, ২০১৪ ও ২০২২। ব্রাজিল ফাইনাল খেলেছে তিনটিতে- ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করেছে তিনটি ১৯৭৮, ১৯৮৬ ও ২০২২ সালে।

ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয় করেছে দু’টি- ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে। আর্জেন্টিনা রানার্সআপ হয়েছে দু’টিতে- ১৯৯০ ও ২০১৪ সালে। ব্রাজিল রানার্সআপ হয়েছে একটিতে- ১৯৯৮ সালে। আর্জেন্টিনার ফাইনালে হার সর্বোচ্চ এক-শূন্য গোলে ১৯৯০ ও ২০১৪। ব্রাজিলের ফাইনালে হার সর্বোচ্চ তিন-শূন্য গোলে- ১৯৯৮ সালে।

পেলের যুগে বিশ্ব ফুটবলের এত জনপ্রিয়তা ছিল না। ম্যারাডোনা ও মেসির যুগে ফুটবল উন্মাদনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মেসি ফুটবল জাদুকর ও ম্যারাডোনা ফুটবল ঈশ্বর হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে আইকন। আর্জেন্টিনা নান্দনিক ফুটবল জাদুকর হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছে, যখন ফুটবল সব খেলার চেয়ে ঊর্ধ্বে এবং ফুটবলের জনপ্রিয়তাও যখন তুঙ্গে। জুলেরিমে কাপ জয় করা আর বিশ্বকাপ জয় করা কোনো দিনই এক নয়। বাংলাদেশের আর্জেন্টিনার ভক্তরা গর্ব করে বলতে পারবে- যোগ্যতায় অপ্রতিরোধ্য মেসি বিশ্বকাপ জিতেছে। বিগত ৩০ বছরের ফুটবল উন্মাদনায় ম্যারাডোনা ও মেসির বিকল্প কোনো দেশ তৈরি করতে পারেনি। ল্যাটিন আমেরিকার নান্দনিক ফুটবল খেলার জন্য ম্যারাডোনা, মেসি, বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা একাকার হয়ে আছে। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল জিতেছে বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা। বিশ্ববাসী দুটো প্রজন্ম দুবার জাদুকর ম্যারাডোনা ও মেসিকে বিশ্বকাপ জিততে দেখেছে।

বাংলাদেশের জন্য বিশাল সুযোগ আর্জেন্টিনার বাজারে পোশাক শিল্পের বাজার তৈরি করা। দক্ষ ও অদক্ষ অভিবাসীদের কাজের সুযোগ তৈরি করা। ফুটবলের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা। তেল গম সয়াবিন আমদানি করা। শিক্ষা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়ানো। লক্ষাধিক কৃষিশ্রমিক রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা। মেসির জন্য নাগরিক অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করা। ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা। দূতাবাস ও বিমান যোগাযোগ চালু করা।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ


আরো সংবাদ



premium cement