২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়াতে হবে

- ছবি : সংগৃহীত

গ্যাস বর্তমান সভ্যতার প্রধান জ্বালানি। গ্যাসের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে আধুনিক অর্থনীতি ও শিল্প কারখানা। পরিবারের ছোট্ট পরিসর থেকে শুরু করে, যানবাহন এবং কলকারখানার বৃহৎ পরিসর- সর্বত্রই গ্যাস ব্যবহার হয়। গ্যাসের সহজলভ্যতা একটি দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে, আবার গ্যাসের স্বল্পতা দেশের অর্থনীতিকে গতিহীন করে। তাই অর্থনীতির বিকাশে গ্যাসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়াতে হবে।

পোশাক শিল্প, ডাইয়িং ফিনিশিং টেক্সটাইল মিল, স্পিনিং মিল, টাইলস ও সিরামিক মিল, রাইস মিল, কেমিক্যাল, স্টিল মিল, অয়েল রিফাইনারি, খাদ্য প্রস্তুতকারী বেকারি ফ্যাক্টরিসহ প্রায় সব ধরনের মিল-কারখানায় গ্যাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যবহার বিদ্যমান। এসব মিল-কারখানায় বেশ কিছু মেশিনারি ও ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে যেগুলো সরাসরি গ্যাসচালিত। এসব মেশিন বন্ধ থাকলে পুরো কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। যেমন- পোশাক শিল্প ও ডাইয়িং ফিনিশিং টেক্সটাইল মিলে প্রয়োজনীয় স্টিম উৎপাদনের জন্য বয়লার চালাতে হয়। আর বর্তমানে প্রচলিত বেশির ভাগ বয়লারই গ্যাসভিত্তিক। সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিং মিলগুলো প্রত্যক্ষভাবেই গ্যাসনির্ভর। স্পিনিং মিল সাধারণত ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে এবং এসব মিল চালাতে কয়েক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। আর এই বিদ্যুৎ গ্যাস জেনারেটরের মাধ্যমে কারখানাতেই উৎপাদিত হয়, যাকে আমরা ক্যাপটিভ পাওয়ার বলি।

আমাদের দেশে স্পিনিং মিলের সংখ্যা চার শতাধিক। প্রায় সব স্পিনিং মিলই ক্যাপটিভ পাওয়ারে চলে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে স্পিনিং মিলগুলো সমস্যায় পড়েছে। গ্যাসের প্রেসার কম হলেও জেনারেটর চালানো যায় না। ফলে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। আর সুতা যেহেতু রফতানিযোগ্য পোশাকের প্রধান কাঁচামাল, তাই স্পিনিং মিলের সমস্যায় পুরো পোশাক খাতই সমস্যায় পড়বে, পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ডলার কম আসবে। এভাবে গ্যাস সঙ্কটে প্রায় সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানই সমস্যায় পড়বে এবং সব ক্ষেত্রেই উৎপাদন ব্যাহত হবে।

এটি আমাদের বিকাশমান অর্থনীতির গতি রোধ করবে। কল-কারখানার পাশাপাশি বাংলাদেশে যানবাহনের বিরাট একটি অংশ গ্যাসে চলে। সিএনজিচালিত ট্যাক্সি এবং গ্যাস বেইজড কার, মাইক্রো জ্বালানি হিসেবে সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) ব্যবহার করে। আবাসিকের বড় একটি অংশও রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহার করে। সরকার দীর্ঘদিন ধরেই আবাসিক ও হোটেল রেস্তোরাঁয় গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে। বাসায় চুলায় প্রায়ই গ্যাস থাকে না। আবার গ্যাস থাকলেও প্রেসার কম থাকে। ফলে বাসায় গ্যাস ব্যবহারকারীরা সমস্যায় পড়েছেন। বাসাভাড়ি ও হোটেল রেস্তোরাঁয় লাইনের গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে সিলিন্ডার বেইজড এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে এবং এই এলপি গ্যাস রান্নায় গ্যাসের চাহিদা পূরণ করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৫টি কোম্পানি সিলিন্ডারে করে এলপি গ্যাস বাজারজাত করছে এবং আরো চারটি কোম্পানি বাজারে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা বছরে প্রায় ১০ লাখ টন। সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল লাগাদ দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা বছরে ২৫ লাখ টনে দাঁড়াবে।

এলপি গ্যাসের ৯৫ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, বাকি ৫ শতাংশ দেশীয় উৎস থেকে জোগান দেয়া হয়। দেশে এলপি গ্যাস বাজারজাতকারী অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান থাকায় বাসাবাড়ি ও হোটেল রেস্তোরাঁয় আর লাইনের গ্যাস সংযোগ দিতে হবে না। রান্নার কাজ এলপি গ্যাস দিয়ে হচ্ছে এবং মানুষও এলপি গ্যাস ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

তবে কল-কারখানার গ্যাসের চাহিদা কিন্তু লাইনের গ্যাস ছাড়া পূরণ হবে না। এর সমাধানে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট, কিন্তু দেশে উত্তোলিত হয় ২৩০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় জোগান দৈনিক ১৫০ কোটি ঘনফুট কম।

গ্যাসের এই ঘাটতি মেটাতে আমরা বিদেশ দিকে এলএনজি (লিকুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানি করছি। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে কোনো সমাধান নয়। দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস সঙ্কটের সমাধান করতে হলে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে ও গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। উত্তোলিত গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। এ জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বাপেক্সকে আরো গতিশীল করতে হবে। গ্যাস সেক্টরে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে এবং সময়ে সময়ে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। বিভিন্ন সময়ের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে বাংলাদেশের মাটির নিচে এবং এ দেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল গ্যাস মজুদের আভাস পাওয়া গেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ একটি ভাটির দেশ হওয়ায় এ দেশের মাটির নিচে দীর্ঘমেয়াদে অধিক গ্যাস মজুদের সম্ভাবনা বেশি। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে দেশের সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় আর ২০২১ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে সর্বশেষ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। মাঝে ধারাবাহিকভাবেই দেশে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে, যা দেশে বিপুল গ্যাস মজুদের সম্ভাবনার প্রমাণ। সুতরাং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।

গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বসে থাকলে চলবে না। দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা জাতীয় পাইপলাইনে সংযুক্ত করতে হবে। যেমন- ভোলায় একাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলেও সবগুলো থেকে কাক্সিক্ষত পরিমাণে গ্যাস তোলা হচ্ছে না। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ থাকলেও উত্তোলন করা হচ্ছে দৈনিক সাড়ে ছয় কোটি ঘনফুট। ভোলায় পিডিবির ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা সাড়ে তিন কোটি ঘনফুট। কিন্তু পাইপলাইনে সমস্যার কারণে চাহিদার অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে।

২০১৭ সালে ভোলায় আরো একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এতে মজুদকৃত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখনো গ্যাস উত্তোলন শুরু করা যায়নি। এদিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের টগবি-১ কূপে ২৩৯ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই কূপ থেকে দৈনিক দুই কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।

একইভাবে গত ১০ নভেম্বর সিলেটের বিয়ানীবাজার গ্যাসফিল্ডের পরিত্যক্ত ১ নম্বর কূপ পুনর্খনন করে আবারো গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই কূপ থেকে দৈনিক প্রায় আট মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়। গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় পরে এটি থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করা হয়। ২০১৬ সালে এটি আবারো উৎপাদনে গেলেও, উৎপাদন কম হওয়ায় কয়েক মাস পর ২০১৭ সালে এটি আবারো পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু গত ১০ সেপ্টেম্বর পুনর্খনন করে এটিতে আবারো গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়।

এদিকে ২০২১ সালে সর্বশেষ আবিষ্কৃত সিলেটের জকিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকেও এখনো গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়নি। এ সব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করা জরুরি।

ভোলায় বিপুল গ্যাস থাকায় সেখানকার কল-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন চালানো যাবে। ভোলায় কল-কারখানা স্থাপন করলে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানও হবে। ফলে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ভোলার মানুষের চাপ কমবে। এ জন্য ভোলায় ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

মাটির নিচে প্রদত্ত এই গ্যাস মানুষের কল্যাণে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দান। এই সম্পদের সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে ও এই চাহিদা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তাই নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস সারা দেশে সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। এ জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে এবং এ খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল বাস্তবায়ন করে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে হলে এর বিকল্প নেই।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
মির্জাপুরে মুসলমান হলেন একই পরিবারের ৪ সদস্য আ’লীগ নেতাকে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে প্রশাসনের সভা এএফপির ২ গাজা যুদ্ধের সংবাদদাতা পুরস্কৃত ইসকনের শুরু যেভাবে, বিতর্কিত যে কারণে ‘জুলাই বিপ্লবে চট্টগ্রামের শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেবে চসিক’ জয় দিয়ে এশিয়া কাপ মিশন শুরু বাংলাদেশের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে ভারত : জয়শঙ্কর আইনজীবী আলিফ হত্যার বিচার ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে ঝিনাইদহে হেফাজতের বিক্ষোভ খাগড়াছড়িতে কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার চট্টগ্রাম আবাহনীকে হারাল কিংস আওয়ামী লীগের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে : আব্দুল হাই শিকদার

সকল