২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

টেকসই কৃষিতে জৈবসার

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। জিডিপি আয়ের ১৪ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। তবে চাহিদার সাথে তাল মিলাতে দিন দিন এর উৎপাদন পরিধি বাড়ছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে টেকসই ও স্বনির্ভর কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য প্রতিবছর বাংলাদেশের জাতীয়বাজেটের ২ থেকে ৩ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয় কৃষির জন্য। ভবিষ্যৎ চাহিদা ও টেকসই কৃষি উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এ বছর এর শতকরা হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট জাতীয় বাজেটের ৬ শতাংশ। কৃষিকাজের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২৪ হাজার ২২০ কোটি, যা কিনা বিগত বছরে ছিল মাত্র ১৬ হাজার ১৯৭ কোটি।

এ দেশের প্রেক্ষাপটে কৃষিকে বাদ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন অকল্পনীয়। সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমেই কেবল কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব। এই সর্বোত্তম পদ্ধতিটিই হতে পারে কৃষিতে জৈবসারের তুলনামূলক অধিক উপকারী ব্যবহার। মাটির উর্বরতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পানি স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। ক্রমাগত মাটির উর্বরতা হ্রাস, ক্ষয়, মাটিতে জৈব পদার্থের স্বল্পতা, পানি ও মাটি দূষণ, অম্লতা বৃদ্ধির কারণে জমির গুণগতমান কমে যায়। কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর প্রধান কারণ। এটি শুধু কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্যই দায়ী নয়; বরং মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষিসুলভ পরিবেশের জন্য বড় ধরনের হুমকির শামিল। বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের কৃষি বাজেটে জৈবসার ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলার জন্য কৃষকদের রাসায়নিক স্যারের মতো জৈবসার ব্যবহারেও বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। জৈবসারের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো- এটি রাসায়নিক সার অপেক্ষা অধিক সময়ের জন্য মাটিতে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান সরবরাহের মাধ্যমে পুষ্টিগুণ বাড়ায় এবং মাটির গঠন, বুননশৈলী ও মিশ্রণকে সূ² ও সুচারু করে মাটিতে বায়ুপ্রবাহ ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং মূলের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। পক্ষান্তরে, জৈবসারের প্রয়োগ কোনো প্রকার দূষণ ছাড়াই স্বল্প ব্যয়ে আশানুরূপ ও গুণগতমানসম্পন্ন কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা মেটাতে উপযোগী।

জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে যখন উন্নত দেশগুলো টেকসই উন্নয়নের দিকে ঝুঁকছে, তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেরও সময়ের দাবি, তার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি কৃষির টেকসই উন্নয়নের দিকে সুপরিকল্পিত দৃষ্টিপাত করা। সহজ ভাষায় কৃষিব্যবস্থার টেকসই উন্নতি বলতে আমরা বুঝি, চারপাশের পরিবেশ, সমাজ ও নাগরিকদের সার্বিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্যদ্রব্যের যথাযথ সহজলভ্যতার কথা চিন্তা করে বর্তমান সময়ের খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা মেটানো। অর্থাৎ কৃষিপণ্যের গুণগতমান বজায় রেখে বর্তমান ও ভবিষ্যতের খাদ্যদ্রব্যের যথাযথ চাহিদা পূরণ করা তথা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। নিঃসন্দেহে ১৫০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্যের জোগান দেয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণে আধুনিক কৃষিকে জমির জীববৈচিত্র্য রক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং টেকসই কৃষির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। টেকসই কৃষিকাজের প্রযুক্তিগত পন্থাগুলো হলো- জৈব কৃষি, জৈব চাষ, জমিতে জৈবসার প্রয়োগ, শস্য আবর্তন, মিশ্রশস্য ফলন ইত্যাদি। টেকসই কৃষিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সব পদ্ধতির সমন্বয় সাধন অতীব প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মাটির জীববৈচিত্র্য ও গুণাগুণ ধ্বংসকারী রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জমিতে জৈবসার ব্যবহার হতে পারে অধিক উৎপাদনশীল ও গুণগতমানসম্পন্ন জৈব কৃষিচর্চার সর্বপ্রথম ও যুগোপযোগী পদ্ধতি।

জৈব সার হলো এক ধরনের কার্বনসমৃদ্ধ সার যা প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক পচনশীল এবং জৈব উপাদান যেমন- গবাদিপশুর উচ্ছিষ্ট, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা, ঘরবাড়ির পচনশীল ময়লা আবর্জনা ইত্যাদি থেকে যে প্রাকৃতিক সার তৈরি হয় সেটি হলো জৈবসার। মূলত যেসব সার কোনো জীবের দেহ থেকে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ উদ্ভিদ বা প্রাণীর ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায়, যেমন- গোবর সার, সবুজ সার, খৈল ইত্যাদি। গাছের প্রায় সব খাদ্য উপাদানই জৈবসারে থাকে। প্রাকৃতিক উপাদান থেকে জৈবসারের উৎপত্তি। এই প্রাকৃতিক পচনশীল আবর্জনাগুলো হলো গাছের পাতা, ফলের খোসা, পচাবাসি খাবার, কাগজ, গবাদিপশু ও হাঁস মুরগির উচ্ছিষ্ট, ইত্যাদি। বিশ্লেষিত ও পচনকৃত আর্দ্র পদার্থে যে খনিজ পদার্থ ও পুষ্টি উপাদান অবশিষ্ট থাকে সেটিই প্রাকৃতিক ফলন বৃদ্ধি কারক পদার্থ হিসেবে জৈবসারে সংরক্ষিত থাকে। জৈবসার তৈরি করার প্রধান শর্তাবলি হলো- প্রথমত, কমপক্ষে ২০ শতাংশ জৈবপদার্থ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আর্দ্রতা থাকতে হবে ও তৃতীয়ত, জৈবসারে নিকেল, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদি সহনশীল মাত্রার অতিরিক্ত থাকা যাবে না। বিভিন্ন ধরনের জৈবসার আছে, যেমন- ম্যানুর (manure)-গবাদিপশুর গোবর ও উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি; অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন বহনকারী, * কম্পোস্ট (compost)-আবদ্ধ জায়গায় ঘরবাড়ির পচনশীল ময়লা আবর্জনা ও ফলমূলের খোসা ইত্যাদি পচানোর মাধ্যমে তৈরি, * রক ফসফেট * হাঁস মুরগির উচ্ছিষ্ট, * ভার্মি কম্পোস্ট (vermi-compost) : নানাধর্মী খাদ্য আবর্জনাকে প্রাকৃতিক কেঁচো দ্বারা পচিয়ে তৈরিকৃত সার ও অন্যান্য। এ ছাড়াও প্রধান জৈবসারগুলো সার হলো- পিট, প্রাণিজ উৎস এবং কৃষিকার্য থেকে প্রাপ্ত উদ্ভিদবর্জ্য ও পরিশোধিত নর্দমার কাদা। এ ধরনের সারের বিশেষত্ব হলো- খাদ্যশস্যের বৃদ্ধির ও পরিপক্বতার জন্য যে উপকারী পুষ্টি ও খনিজ উপাদান প্রয়োজন (প্রধানত এনপিকে; নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম) তা নির্দিষ্ট পরিমাণে দীর্ঘ সময়ব্যাপী জোগান দিয়ে থাকে এবং মাটি ও পানি দূষণ রোধ করে টেকসইভাবে যথাযথ চাহিদা পূরণের মাধ্যমে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ আশানুরূপ ফলন নিশ্চিত করে। আরো বিশদভাবে চিন্তা করতে গেলে- এটি মাটি, পানি ও খাদ্যশৃঙ্খলে ক্ষতিকর ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদানের প্রবেশকে রোধ করে, মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে, অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতিকর রোগ প্রতিরোধ করে জীববৈচিত্র্য ধারাকে অব্যাহত রাখে তথাপি গ্রিন হাউজ গ্যাস নিষ্কাশন তথা জলবায়ু পরিবর্তন রোধেও সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

জৈবপদার্থ হলো মাটির প্রাণবন্ততা। জৈবসার ব্যবহারের ফলে মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমাণ বাড়ে। এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি রয়েছে যা ফসলের প্রধান খাদ্য এবং একইভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির উপাদানগুলোর ঘাটতিও পূরণ করে। মাটির কাঠামো ও গুণমান উন্নত করে। বালুকাময় মাটি সরস হয়ে যায়, জলের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, তাছাড়া কাদামাটি কিছুটা দোলা তৈরি করে মাটির দিকে আরো উর্বর করে। মাটিতে জৈবসার প্রয়োগ করার পরে, গাছটি ধীরে ধীরে এটিকে প্রয়োজনীয়তার হিসেবে অনেক দিন ধরে শুষে নিতে পারে। জমিতে দেয়ার পরে এটি প্রায় ৬-১৮ মাস পরে প্রভাব ফেলতে পারে। এটি পরবর্তী ফসলেও উপকারী। জৈবসার ব্যবহারের ফলে মাটিতে উপকারী জীবাণুগুলোর ক্রিয়াকলা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের প্রজননে সহায়তা হয়। এই পদ্ধতিতে মাটি থেকে সহজ উপায়ে খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে গাছটি দ্রুত বাড়তে পারে। জৈবসার গাছের শিকড় ও অঙ্গ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কেঁচো, পিঁপড়া, মাটিতে গর্ত তৈরি করে যেখানে জৈবপদার্থ প্রয়োগ করা হয়। এটি শিকড়গুলোতে কারো অক্সিজেন দেয় এবং মাটিতে বায়ু সঞ্চালনে সহায়তা করে। ফলে গাছটি সতেজ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের মাটির তাপমাত্রা হ্রাস করে এবং শীতে উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে। এটি পুরো মৌসুমে গাছের শিকড় বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। জৈবসার রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং জৈবসার ব্যবহার একটি আনুপাতিক হারে রাসায়নিক সারের মাত্রা হ্রাস করতে পারে। জৈবসার মাটিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের আধিক্যজনিত কারণে যেকোনো বিষের বিষ কমাতে সহায়তা করে। এমনকি যদি আরো জৈবসার ব্যবহার করা হয় তবে মাটির কোনো ক্ষতি হয় না। সর্বোপরি এটি ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে এবং গুণগতমান বৃদ্ধি করে ও সঞ্চিত শস্যের সঞ্চয়ের ক্ষমতা বাড়ায়।

জৈবসারের এত সব সুবিধার পাশাপাশি এর কিছু ক্ষতিকর বা অসন্তোষজনক বৈশিষ্ট্য হলো- সব জৈবসারের পুষ্টিগুণ সমান হওয়া সম্ভব নয় এবং এর দ্বারা সর্ব প্রকার পুষ্টি উপাদান সরবরাহ সম্ভব নাও হতে পারে। প্রাকৃতিক পচনক্রিয়ার মাধ্যমে এবং মাটিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের উপস্থিতিতে জৈবসার অধিক পুষ্টিসম্পন্ন হলেও সব উপাদান সীমিত পরিমাণে থাকে যা একটি লম্বা সময় ধরে খাদ্যশস্যের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া বাসাবাড়িতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কম্পোস্ট বা জৈবসার প্রস্তুত প্রণালী কিছুটা অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের উদ্ভব ঘটিয়ে থাকে এবং দুর্গন্ধের কারণ হয়ে থাকে। এ ছাড়া জৈবসারের আরো কিছু উপকারিতা হলো- এটি মাটিতে কোনো শক্ত আবরণ তৈরি করে না যা মাঝে মধ্যে অজৈব সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। আর তাই এটি পানি চলাচলের পথ সুগম করে এবং মাটির কাঙ্ক্ষিত কাঠামোকে বজায় রাখে ও মাটিতে বসবাসকারী উপকারী মাইক্রোবিয়াল জীবের শ্বসন তথা বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং জমিকে চাষের জন্য অধিক উপযোগী করে তৈরি করে। আর এসব কারণেই জৈবসারকে অন্যান্য সব সারের চেয়ে কৃষকদের জন্য অধিক কৃষি উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়াও টেকসই কৃষির জন্য এটি অন্যান্য অজৈব সার অপেক্ষা বেশি টেকসই ও স্থায়ী বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করে থাকেন। কেননা, টেকসই কৃষির তিনটি স্তম্ভ- সৃজনশীল বিকাশ, টেকসই বৃদ্ধি ও সমন্বয় এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সাধন, প্রত্যেকটির মধ্যেই আন্তঃসম্পর্ক ও ভারসাম্য রক্ষার প্রধান কারিগর হিসেবে কাজ করে প্রাকৃতিকভাবে প্রস্তুত করা এই জৈবসার।

রাসায়নিক সার উৎপাদিত হয় রাসায়নিক কারখানায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে; যেখানে জৈবসার প্রস্তুত হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন জৈববর্জ্য পচনের মাধ্যমে ঘরবাড়ি কিংবা খামার বাড়িতে। বাংলাদেশে প্রতি বছর চার মিলিয়ন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়ে এবং কৃষিজ জমিকেও এ মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগের জন্য ক্ষতিকর মাশুল দিতে হয় এবং প্রকটভাবে বিভিন্ন এলাকার জমির প্রয়োজনীয় জৈব উপাদান হ্রাস পাওয়া জমিকে অনুর্বর ও পুনরায় একই ধরনের শস্য চাষে অনুপযোগী করে তোলে তথা মাটিদূষণ ঘটায়। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো এলাকার জমির স্ট্যান্ডার্ড জৈব উপাদান থাকা প্রয়োজন ৩.৪ শতাংশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধিক পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে এর পরিমাণ বাংলাদেশে ১-১.৭ শতাংশ এবং কোনো কোনো জায়গায় ১ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। কৃষিজমির এই পরিবর্তিত দৃশ্য আবার স্বাভাবিক করতে এবং কৃষিজমির উর্বরতা ও জৈব উপাদানের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে প্রাকৃতিক জৈবসার হলো একমাত্র আস্থা। এটি মাটির যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভারসাম্য রক্ষা করে এবং অধিক সময়ের জন্য জমিকে উর্বর রাখে। এটি যেহেতু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত, এর দ্বারা কোনো ক্ষতিকর বর্জ্য বা পদার্থ ভূগর্ভস্থ পানিস্তরে প্রবেশ করে না; কিংবা নদী-নালার পানিকে দূষিতও করে না।

একজন সফল কৃষকের কাছে জৈবসারের অর্থনৈতিক মূল্য হলো, এটি কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বাড়ায়, মান ধরে রাখে ও আশানুরূপ ফলন নিশ্চিত করে। খাদ্যশস্যের অধিক ফলনের চাহিদা মিটিয়ে এটি কৃষিজমির সময়োপযোগী শারীরিক, রাসায়নিক ও জৈব পরিবর্তন ঘটাতেও ভূমিকা রাখে। ফলে মাটির দানার গঠন-কাঠামো, মিশ্রণ ঠিক থাকে, যথাযথ অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক হয় এবং মাটি নরম হয়ে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সারা বছর শস্যচক্রায়নের মাধ্যমে জমিতে শস্য বপন ও কর্তন চলতে থাকে যা মাটিকে ক্রমাগত পুষ্টিশূন্য করে এবং প্রয়োজনীয় পিএইচকে বিঘ্নিত করে। অপর দিকে, জৈবসারের কাজই হলো পিএইচকে সাম্যাবস্থায় এনে খাদ্যশস্যের সুষম বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা। জৈবসার প্রয়োগে উৎপাদিত খাদ্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে ভোক্তাদের কোনোরূপ অসুখ-বিসুখ যেমন- ক্যান্সার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ত্বক সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না; যা খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকারক খনিজের উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। এ সব অনাকাঙ্ক্ষিত খনিজ পদার্থ রাসায়নিক সার প্রয়োগে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে থাকে।

বড় বড় রাসায়নিক কারখানায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বছরে মিলিয়ন টন পরিমাণ রাসায়নিক সার উৎপাদিত হয়। অন্য দিকে, অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এলাকাভিত্তিক জৈবসার প্রস্তুত করা হয়। টেকসই ও গুণগত কৃষিজ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক হারে জৈবসার উৎপাদন হবে বেকারদের জন্য কাজের নতুন ক্ষেত্র।

বিশেষভাবে সে সব গ্রামীণ পরিবেশে যেখানে বেকারত্ব ঘোচানোর মতো কাজের ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি, সেখানে অর্থনৈতিক লাভের কথা চিন্তা করে ব্যবসায়িক পরিসরে জৈবসার উৎপাদন করার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। কেননা, শুধু শহরাঞ্চলেই প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার ৩৩২ টন পচনশীল আবর্জনা উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং সরকার কর্তৃক জাতীয় ৩ আর (3R= reduce, reuse and recycle) পদ্ধতিতে ও পচনশীল বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার করে জৈবসার উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। এটি কেবল দেশের টেকসই কৃষিকেই নয়; বরং টেকসই উন্নয়নের দিক টিকেও নিশ্চিত করে।

সাধারণভাবে, জৈবসারের পুষ্টিগুণ বেশি মিশ্রিত থাকে, যা উদ্ভিদের জন্য খুব কম সহজলভ্য। তবে এটি অদ্রবণীয় নাইট্রোজেন ধারণকারী ধীর-নিঃসরণীয় সার হিসেবে পছন্দনীয় হতে পারে। জৈবসারের স্বভাব হলো- জৈবসার মাটিতে ভৌত ও জৈবিক পুষ্টি সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ায়, অতিরিক্ত সার প্রয়োগের দ্বারা সংঘটিত ঝুঁকি হ্রাস করে। জৈবসারের পুষ্টি উপাদান, দ্রবণীয়তা ও পুষ্টি উপাদান নিঃসরণের হার সাধারণত খনিজ সারের তুলনায় অনেক কম। নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে মাটিতে সম্ভাব্য খনিজযোগ্য নাইট্রোজেন (PMN) কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণের তুলনায় জৈব মালচড সিস্টেমে ১৮২-২৮৫ শতাংশ বেশি। জৈবসার জীববৈচিত্র্য ও মাটির দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনক্ষমতা উন্নত করতে পারে এবং অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড ধারণ করতে পারে। জৈব পুষ্টিসমূহ, জৈবপদার্থ ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সরবরাহের মাধ্যমে মাটিস্থ অণুজীবগুলোর (যেমন- মাইকোরাইজা ছত্রাক) কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর মাইকোরাইজা ছত্রাক উদ্ভিদকে পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে। জৈবপুষ্টি কীটনাশক, শক্তি ও সারের খরচ অতিমাত্রায় হ্রাস করতে পারে। কম্পোস্ট ও অন্যান্য উৎস থেকে জৈবসারগুলোর পুষ্টি উপাদান এক চালান থেকে অন্য চালানে বেশ পরিবর্তন হতে পারে। তাই নির্দিষ্ট চালান (ব্যাচ) পরীক্ষা ছাড়া, প্রয়োগকৃত পুষ্টির পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যাবে না। তবুও, এক বা একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, জৈবসার দীর্ঘ সময়ব্যাপী ব্যবহার করা হলে এটি রাসায়নিক সারের মতো কার্যকর।

টেকসই উনয়নের এই দিনে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ কৃষিতে জৈবসারের ব্যাপক উপকারী ভূমিকা থাকা অনিবার্য। গ্রামীণ থেকে অত্যাধুনিক, কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি সদস্যেরই জৈবসার সম্পর্কে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ জ্ঞান থাকা এখন যুগের চাহিদা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গাছপালার অবশিষ্টাংশ, পশুপাখির উচ্ছিষ্ট, পচনশীল ফলমূলের খোসা থেকে জৈবসার প্রস্তুত হওয়ায় রাসায়নিক সারের মতো এর কোনো ক্ষতিকারক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। জৈবসারের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সহজলভ্যতা আগামী দিনে সমাজ ও পরিবেশবান্ধব জৈবচাষের ধারণাটিকেও সফল করে তুলবে। অধিক ফলন ও গুণগতমানসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ওপর নির্ভর না করে জৈবসার হবে কৃষকদের ভরসার জায়গা। আর এ কারণে বলা বাহুল্য যে, আগামী দিনে কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে ও গুণগতমান বজায় রেখে টেকসই কৃষিব্যবস্থায় কৃত্রিম সার অপেক্ষা জৈবসারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল