৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানবজাতির দ্বিতীয় সূচনা

-

মানবসভ্যতার প্রভাতলগ্ন। আল্লাহর নবী হজরত নূহ আলাইহিস সালামের নবুয়তকাল। প্রবাদতুল্য ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে নিজ জাতিকে সাড়ে ৯০০ বছর আল্লাহর দিকে ডাকার পরও বেশির ভাগই তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে উল্টো অবাধ্যতা, ধৃষ্টতা ও স্পর্ধা প্রদর্শন করতে থাকে। তখন তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আল্লাহ তায়ালা এক প্রলয়ঙ্করী প্লাবনের আয়োজন করেন। প্লাবন পাঠিয়ে কাফেরদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেন।

নূহ আলাইহিস সালামের শেষজীবনে এ আজাবে প্লাবিত হয় পৃথিবী। প্লাবনে তাঁর অনুসারীরা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসক্রিয়ার শিকার হয়। সমূলে উৎখাত হয় দুষ্কৃতিকারীর দল। তাদের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবী আবার ফিরে পায় তার নির্মল রূপ।

হজরত আদম আ: আর নূহ আ:-এর মধ্যে ব্যবধান ১০ শতাব্দীর। তিনি ছিলেন আদম আ:-এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। শেষ দিকে এসে ক্রমবর্ধমান মানবকুলে শিরক ও কুসংস্কারের উৎপত্তি হয় এবং একজন থেকে অন্যজনে দ্রুত সংক্রমিত হতে থাকে। ফলে তাদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তায়ালা নূহ আ:-কে নবী ও রাসূল করে পাঠান। তিনিই দুনিয়ার বুকে প্রেরিত প্রথম রাসূল।

নূহ আ:-এর দাওয়াতে তাঁর কওমের হাতেগোনা কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি সাড়া দেন এবং তারাই প্লাবনকালে কিশতিতে আরোহণ করেন। নিষ্কৃতি লাভ করেন ভয়াবহ আজাব থেকে।

নূহ আ:-এর চার পুত্র ছিল : সাম, হাম, ইয়াফেছ ও কেনআন। (তাফসিরে কুরতুবি) প্রথম তিনজন ঈমান আনেন। আর শেষ জন কাফের হয়ে প্লাবনে ডুবে মারা যায়।

অনাচার-অবাধ্যতা মুক্ত নির্মল পৃথিবীতে নূহ আলাইহিস সালাম স্বীয় অনুসারীদের নিয়ে আবার বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে কেবল নূহ আলাইহিস সালামের তিন পুত্রেরই সন্তান হয়। এ তিন পুত্র থেকে মানবজাতির বংশধারা পুনরায় শুরু হয়। কালের দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মোকাবেলা করে তাদের বংশধারাই টিকে থাকে পৃথিবীতে।

আল্লাহ তায়ালার ইরশাদ করেন- ‘আর আমরা তাঁর (নূহের) বংশধরদেরই টিকিয়ে রেখেছি।’ (সূরা ছাফফাত-৭৭)

অনাবাদী পৃথিবীকে আবাদ করার লক্ষ্যে নূহ আলাইহিস সালাম তাঁর তিন সন্তানকে পৃথিবীর তিন ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দেন- সামের জন্য পৃথিবীর মধ্যভাগ নির্ধারণ করেন। পশ্চিম ভাগ দেন হামের অধীনে। আর পূর্বপ্রান্তের বাকি ভূখণ্ড ইয়াফেসের অধীনে দেয়া হয়।

আমরা যদি তাদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া বাসভূমিগুলোকে বর্তমানের আলোকে বুঝতে চাই, তাহলে এভাবে বলা যায়-
১. সামের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল : প্রস্থে নীলনদের পূর্ব প্রান্ত থেকে সিরদরিয়া, আর দৈর্ঘ্যে দক্ষিণ মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত- বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলজুড়ে এর অবস্থান।
২. হাম এর অধীনে : নীল-নদের পশ্চিম তীর থেকে পশ্চিম দিগন্তের শেষ স্থলসীমা পর্যন্ত এটি আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশরূপে পরিচিত। তখন আমেরিকা আবিষ্কার হয়নি বিধায় আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ পর্যন্তই ছিল স্থলভাগের সীমানা।
৩. আর পূর্বপ্রান্তের বাকি ভূখণ্ড ইয়াফেসের অধীনে দেয়া হয়- মধ্য এশিয়ার বেশির ভাগ এবং রাশিয়া ও চীনজুড়ে এর বিস্তৃতি।

এভাবে পুরো পৃথিবীর তৎকালীন আবিষ্কৃত স্থলভাগ তিন অংশে বিভক্ত হয়ে তিন ভাইয়ের অধীন হয়।
তিন ভাই পৃথিবীর তিন ভূখণ্ডে সপরিবারে বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের ঘিরে রচিত হয় পরিশুদ্ধ মানবসভ্যতার নতুন ভিত্তিপ্রস্তর। গড়ে ওঠে গোত্র বংশ সমাজ। আর মানবজাতির নতুন স্থপতি পিতা নূহ আলাইহিস সালাম ইতিহাসে পরিচিত হন ‘দ্বিতীয় আদম’ হিসেবে। তাঁর উপাধি হয় ‘আবুল বাশার ছানী’, যার অর্থ- মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা। বর্তমান পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতি প্রজন্মান্তরে তারই সন্তান। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস ও ক্বাতাদাহ রা: বলেন, পরবর্তী মানবজাতি সবাই নূহের বংশধর।’ (তিরমিজি শরিফ) ফলে ইহুদি-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মমতের লোকেরা নূহ আ:-কে তাদের পিতা হিসাবে মর্যাদা দিয়ে থাকে।

হজরত নূহ আ:-এর পুত্রত্রয় ও তাদের থেকে জন্ম নেয়া বংশধরদের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : হজরত নূহ আ:-এর তিনজন পুত্রসন্তান জন্ম নেয়- সাম, হাম ও ইয়াফেস। সামের ঘরে জন্ম নেয় আরব, রুম ও ফারিস। কল্যাণ তাদের মধ্যেই। ইয়াফেসের ঘরে জন্ম নেয় ইয়াজুজ-মাজুজ, তুর্ক ও সাকালিবা। তাদের মধ্যে কল্যাণ নেই। আর হামের ঘর থেকে কিবত, বারবার ও সুদান। (মুসনাদে বাযযার)১

সাম থেকে বিস্তার লাভ করে আরব, পারস্য (ইরান) ও রোমের বংশধারা। হাম থেকে কিবতি, বার্বার ও সুদানের বংশধারা। আর ইয়াফেস থেকে তুর্ক, ইয়াজুজ-মাজুজ ও সাকালিবার বংশধারা। উল্লিখিত সব নাম ছিল তাদের সন্তানদেরই। কিন্তু তাদেরও সন্তান-সন্ততি থেকে জন্ম নেয়া বংশধররা পরবর্তীতে এসব নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

ব্যক্তি বিশেষের নামই বংশ সম্প্রদায় ও অঞ্চলের নামে রূপ নেয়। যেমন- ‘আরব’ ‘পারস্য’ (আরবি-ফারিস) নাম দু’টি নূহপুত্র সামের বংশে জন্মানো দু’জন ব্যক্তির নাম। কাল পরিক্রমায় এ দুজনের বংশে জন্মগ্রহণকারীরাই যথাক্রমে আরব ও পারসিক জাতি নামে খ্যাতি লাভ করেছে। তাদের আবাসভূমিও অনুরূপ নামে পরিচিত হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য অন্য নামগুলোর ক্ষেত্রেও।
সাম ছিলেন তিন পুত্রের মধ্যে বড়। তাকে আবুল আরব বা আরব জাতির পিতাও বলা হয়। সব নবীরা তারই বংশধর।

তাঁর বংশধরদের মধ্যেই ছিলেন হজরত ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক আলাইহিমুস সালাম। হজরত ইসমাইল আ:-এর বংশ থেকে আগমন করেন মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তান হজরত মুহাম্মদ সা:। হজরত ইসহাক আ:-এর বংশধরগণের মধ্য থেকে হজরত ইয়াকুব আ:, হজরত ইউসুফ আ:, হজরত মুসা আ:, হজরত দাউদ আ:, হজরত সুলায়মান আ:, হজরত ইউনুস আ:, হজরত ইলিয়াস আ: ও হজরত ঈসা আ: প্রমুখ, বনি ইসরাইলের নবী-রাসূল। আরবদের মধ্যকার চারজন নবী ছিলেন হজরত হুদ আ:, হজরত ছালেহ আ:, হজরত শুয়াইব আ: ও হজরত মুহাম্মদ সা:।

হাম ও ইয়াফেছের বংশধরদের কাছে নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন মর্মে তেমন কিছু জানা যায়নি। (তারিখুল আম্বিয়া)

হামের বংশধরদের মধ্যে বর্তমানে আফ্রিকার বারবার ও সুদানি জাতি প্রসিদ্ধ। আর বর্তমানের বিশাল বিস্তৃত অঞ্চলে বাসকারী তুর্কি জাতি, চীনের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত উইঘুর মুসলিম এবং রাশিয়ার সাকালিবা (স্লাভ) জাতি সবাই ইয়াফেসের বংশধর।

নবীপুত্রদের বাসভূমিগুলোই ছিল পৃথিবীর জাতিসমূহের ঝরনা-উৎস, যে উৎস থেকে ঢলের মতো উথলে ওঠে মানবজাতি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন ভূখণ্ডে এবং একেকটি জাতিসত্তার আঁতুড়ঘরে। যেখান থেকে হাজার বছরের ব্যবধানে শত শত গোত্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। ফুলে ফলে ভরে উঠেছে মানববাগান।
১. ইসমাইল ইবনে আয়াশ সূত্রে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব থেকে মুরসাল হাদিসে বর্ণিত, হাফিজ আবু বকর আল বাযযার তার মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা রা: থেকে মারফু সূত্রে।


আরো সংবাদ



premium cement