৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ফিলিস্তিন কিভাবে বিশ্বকাপে আরবদের ঐক্যবদ্ধ করেছে

- ছবি : সংগৃহীত

আমরা ভাবতে ভুল করেছি যে, ফিলিস্তিন সব আরববাসীর কেন্দ্রীয় সমস্যার প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরনের ভাষা প্রস্তাব করে যে, ফিলিস্তিন একটি বাহ্যিক বিষয়, যেটাকে অন্যান্য সামষ্টিক সংগ্রামের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যা সর্বত্র অধিকাংশ আরবকেই গ্রাস করেছে। যাই হোক, হাজার হাজার আরব ভক্ত দ্বারা কাতার বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে চলমান উদযাপন ফিলিস্তিনের সাথে আরব জনগণের সম্পর্কে আমাদের আগের ধারণাগুলো পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে।

আমার যুক্তির সূচনা পয়েন্ট হলো রোম, ইতালি, দোহা, কাতার নয়। আমি ২০২১ সালের আগস্টে মরক্কোর রাজা কাসাব্লাঙ্কা এবং ইতালির এ এস রোমার মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচে অংশ নিয়েছিলাম। মরক্কোর দলের সাথে ছিল তাদের হাজার হাজার সমর্থক। সংখ্যায় কম হলেও স্ট্যান্ডে তাদের মানানসই পোশাক, নাচ, গান তাদের ইতালীয় সমর্থকদের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান করে তুলেছিল, যদিও খেলার পরিবেশে সামান্য বা কোনো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল না, মরক্কোয়ানরা ফিলিস্তিনের জন্য গান গাইত এবং ফিলিস্তিনের পতাকার রঙে মোড়া কাফিয়া পড়ত।

এটি ছিল একটি হৃদয়গ্রাহী অঙ্গভঙ্গি, ফুটবল ম্যাচে আরব সমর্থকদের আদর্শ। সমর্থকরা স্টেডিয়াম ছাড়তে শুরু করলে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, রাজা কাসাব্লাঙ্কার ভক্ত সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ফিলিস্তিনের চারপাশে তৈরি করা হয়েছিল। তাদের প্রধান স্লোগান হলো : ‘রাজাউই ফিলিস্তিনি।’ (ফিলিস্তিন রাজাভিস), তাদের জার্সির ওপর সূচি কর্ম করা শব্দ।

সেই ম্যাচের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অনুপস্থিতি বিবেচনা করে, মরক্কোয়ানরা স্পষ্টতই ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের সমর্থনকে এমনভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরিণত করেছে যে, এটি তাদের দৈনন্দিন বাস্তবতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আমি যখন তাদের এক দলকে তারা কেন ফিলিস্তিনি প্রতীক ও স্লোগান গ্রহণ করে তা জিজ্ঞেস করলাম প্রশ্নটি তাদের হতবুদ্ধি করে। তবে একজন প্রবীণ ব্যক্তি আবেগাপ্লুত হয়ে জবাব দেন: ‘ফিলিস্তিন আমাদের রক্তে মিশে আছে। ফিলিস্তিনের জন্য ভালোবাসা আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। ফিলিস্তিনের গুরুত্ব সম্পর্কে আরব জনমত নির্ধারণের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক গবেষণা করা হয়েছে, বিশেষ করে ২০২০ সালে আরব সেন্টার ফর রিচার্স অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ দ্বারা পরিচালিত আরব মতামত সমীক্ষার কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা যায়। এই জরিপ বা সমীক্ষায় দেখা যায়, উত্তরদাতাদের ৮৫ শতাংশই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে, আরবের জনগণ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিই তাদের সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছে।

কাতার বিশ্বকাপ অবশ্য নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে, আরব রাজনৈতিক চেতনায় ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয়তা নিয়ে নয়, বরং ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব নিছক রাজনৈতিক এবং ফিলিস্তিন অন্য জরুরি আরব কারণগুলোর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য অন্য একটি সমস্যা কি না তা নিয়ে।

এমনকি ইসরাইলিরাও, তাদের অনেক টাউটেড গোয়েন্দা সংস্থার সাথে এবং তথাকথিত আরববাসীর মেজাজ সম্পর্কে ধারণা করা ভালো, তারা বিভ্রান্ত এবং এমনকি রাগান্বিত বলে মনে হয়েছিল যখন তারা বিশ্বকাপের রিপোর্ট করতে কাতারে ছুটে গিয়েছিল। তারা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং রাজনৈতিক স্বাভাবিকীকরণকে জনপ্রিয় গ্রহণযোগ্যতায় রূপান্তর করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল।

তবে দুইজন ইসরাইলি সাংবাদিক রাজ শেচনিক এবং ওজমুয়ালেম হতাশ হয়ে ইসরাইলে ফিরে গেছেন। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্ণবাদ এবং সামরিক দখলদারিত্বের মধ্যে বিন্দুগুলো সংযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে, সাংবাদিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ এই সুবিধাজনক উপসংহারে পৌঁছেছেন: ‘বিশ্বাস করা সত্ত্বেও, উদার মনের উদারপন্থী হিসেবে আমরা যে আরব বিশ্বের সাথে বিরোধ তা হলো, সরকারের মধ্যে জনগণের সাথে নয়। কাতার আমাদের শিখিয়েছে, রাস্তার মানুষের মনে ঘৃণা প্রথম এবং সর্বাগ্রে বিদ্যমান।

শুধু ‘মুক্তমনা উদারপন্থীদের’ আত্মসচেতনতার কোনো বোধের অভাব ছিল না, তারা অধিকাংশ ইসরাইলির মতো আরব জনগণকে সম্পূর্ণরূপে খারিজ বা বাতিল করে দিয়েছিল রাজনৈতিক অভিনেতা হিসেবে। রাজনৈতিক অভিনেতারা নিজেদের সামষ্টিক অগ্রাধিকার অনুসারে চিন্তাভাবনা করতে এবং আচরণ করতে সক্ষম। এলোমেলো ‘ঘৃণা’ এর জন্য ইসরাইলিদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ অবিচারের কারণে আরবদের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে বিভ্রান্ত করে, যা কেবল আরবদের কথিত ঘৃণ্য প্রকৃতির প্রতিফলন বলে মনে হয়। দুই রিপোর্টার যদি তাদের নিজস্ব প্রতিবেদনে- স্বঘোষিত নয়, সত্যিকারের বিষয় মুক্তমন নিয়ে প্রতিফলন ঘটাতেন তাহলে তারা কিছু সূত্র খুঁজে পেতেন।

তারা লিখেছেন, ‘যখনই আমরা রিপোর্ট করি তখন সর্বদাই ফিলিস্তিনি, ইরানি, কাতারি, মরক্কোয়ান, জর্দানি, সিরিয়ান, মিসরীয় এবং লেবাননী আমাদেরকে অনুসরণ করে... সবাই আমাদের দিকে পূর্ণ ঘৃণার মনোভাব নিয়ে তাকায়। আরব দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে যে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে সেটা বিবেচনা করে একজন বিস্মিত হয় যে, কেন বিশাল বৈচিত্র্যময় আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাধারণ মানুষ ইসরাইলকে ‘ঘৃণা’ এবং ফিলিস্তিনকে ভালোবাসার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ। উত্তরটি ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ তথা ইহুদি-বিরোধী শব্দের মধ্যে নয়, তবে উপস্থাপনার মধ্যে রয়েছে।

আরবদের জন্য ইসরাইল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস, সামরিক দখলদারিত্ব, সামরিক আগ্রাসন, যুদ্ধ এবং আরো যুদ্ধ, ইসরাইলি সৈন্যদের দ্বারা ফিলিস্তিনি বালক-বালিকাদের হত্যা করার প্রতিদিনের চিত্র, সহিংস ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে জোর করে বের করে দেয়ার চিত্র, রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য এবং আরো অনেক কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে।
অন্য দিকে, ফিলিস্তিনিরা সম্পূর্ণরূপে অন্য কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে। তারা সব আরববাসীর ক্ষতকে মূর্ত করে তোলে। সাহস ও ত্যাগ। আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি। প্রতিরোধ ও আশা।

অধিকাংশ ইসরাইলি আরব এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে জৈব সম্পর্কে উপলব্ধি করতে অক্ষম। কারণ তারা মেনে নিতে অস্বীকার করে যে, তাদের দেশ এই ধরনের নেতিবাচক অনুভূতি ডেকে এনেছে। এই বাস্তবতার সাথে লড়াই করার অর্থ হবে গভীর এবং অস্বস্তিকর প্রতিফলন। শেচনিক এবং ওজমুয়ালেমের মতো ব্যক্তিরা বরং ইসরাইলের অবর্ণনীয় এবং অযৌক্তিক আরব ‘ঘৃণা’ সম্পর্কে কিছু সুবিধাজনক রেফারেন্স দানের মাধ্যমে এমন একটি কাজ ব্যাখ্যা করবেন।

আরবদের ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার বিষয়টি শুধু ইসরাইল সম্পর্কে নয়, বরং আরবদের নিজেদের সম্পর্কেও। যদিও ফিলিস্তিনি পতাকাটি ১৯১৬ সালের প্যান আরব পতাকা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, এটি ঐক্যবদ্ধ আরব প্রতীকের ভূমিকা পালন করার জন্য বছরের পর বছর ধরে রূপান্তরিত হয়েছে।

কাতারের আরব ফুটবল সমর্থকরা যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনো সরকারি নির্দেশনা বা সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই ফিলিস্তিনি পতাকাকে তাদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বেছে নিয়েছে, তা সম্মিলিত আরব চেতনার ফিলিস্তিনের অবস্থানের কথা বলে। এটি আমাদের আরো বলে যে, ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা ইসরাইলকে ঘৃণা করার সরাসরি ফলাফল নয় এবং আরবরা ফিলিস্তিনকে পরাজয় অথবা অপমানের প্রতীক হিসেবে দেখে না।

যখন মরক্কোর খেলোয়াড় জাওয়াদ-এল-ইয়ামিন কানাডার বিপক্ষে তার দলের বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করছিলেন, তখন তিনি ফিলিস্তিনি পতাকা তুলে ধরেছিলেন।

নক আউট পর্যায়ে মরক্কোর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ায় ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে এই উদযাপন করা হয়। এই পটভূমিতে মরক্কোর সমর্থকরা ফিলিস্তিন এবং মরক্কোর পক্ষে স্লোগান দেয়। তাদের জন্য ফিলিস্তিন একটি বাহ্যিক কারণ নয়। তাদের স্লোগান ও উল্লাস কেবল সংহতির একটি কাজ নয়। তাদের জন্য ফিলিস্তিন এবং মরক্কো সমার্থক। পরাজয়, সংগ্রাম এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ের ব্যাপারে তাদের সামষ্টিক অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে তারা বর্ণনা করে।

লেখক : আন্তর্জাতিকভাবে সিন্ডিকেটেড কলামিস্ট এবং একজন মিডিয়া কনসালট্যান্ট আরব নিউজের সৌজন্যে

ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement