৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বুদ্ধিজীবী হত্যা এক কালো অধ্যায়

বুদ্ধিজীবী হত্যা এক কালো অধ্যায় - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক, চাকরিজীবী ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা এই পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতিকে মেধাশূন্য করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা ও যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে পরাজয় অবধারিত। স্বাধীনতার পর দেশ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য এক জঘন্য ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সহযোগিতা করে এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলশামস, আলবদর বাহিনী। বাঙালিদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘৃণ্য নীলনকশা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে পশ্চিম পাকিস্তানের যে কোনো অন্যায়-অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা। এ কারণে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের কাছে ছিলেন বিরাগভাজন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে দেশের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তার এ দেশীয় দোসররা। যদিও মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাজুড়েই তারা সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করেছে। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে তারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা করে নির্মূল করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী আলবদর ও আলশামস বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব জ্ঞানী-গুণী সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসককে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়, তাদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. গোলাম মর্তুজা, ডা. আজহারুল হক এবং আরো অনেকে। সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান, সৈয়দ নাজমুল হক, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী, সেলিনা পারভীন। জাতির বিবেক এসব বুদ্ধিজীবীকে আজ জাতি স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায়।

একাত্তরে লাখো শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যবহ। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে পারে, তাদের চরম বিপর্যয় আসন্ন, পরাজয় একেবারেই সন্নিকটে- তখনই তারা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করে। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁদের প্রায় সবারই চোখ তুলে ফেলা হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এভাবেই অন্ধকার করার পাঁয়তারা করেছিল। তবে অপারেশন সার্চলাইটের নামে একাত্তরের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে নামে, তখনই দেশে এবং দেশের বাইরে একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের এভাবে হত্যা করা হতে পারে। পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর আল-বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দু’টি স্থান এখন বধ্যভ‚মি হিসেবে সংরক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আলবদর বাহিনী আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভ‚মি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে।

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রায় শেষ, চতুর্মুখী আক্রমণে টিকতে পারছিল না পাকিস্তান পাকবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পাকিস্তান যে আত্মসমর্পণের আগে মরণ কামড় বসিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল তা জানত না কেউ। পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসর ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশের বুকে চ‚ড়ান্ত আঘাতটি করেছিল ১৪ ডিসেম্বর। অর্থাৎ আমাদের বিজয় এবং তাদের চ‚ড়ান্ত পরাজয়ের মাত্র দুদিন আগে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পল্লবিত বৃক্ষকে জ্ঞান, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তি আর অবারিত শ্রম দিয়ে যারা সুশোভিত করে তুলেছিল সেইসব লেখক, বুদ্ধিজীবী শিক্ষক, চিকিৎসক, মুক্তচিন্তক, বিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক চিন্তাশীল মানুষকে হত্যা করা হয়। একটি দেশের প্রধান চালিকাশক্তি বুদ্ধিজীবীরা। তারা না থাকলে দেশ কখনো সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। তার ফলে দেশ পিছিয়ে যাবে। এই গোষ্ঠী কখনোই চায় না বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।

বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে পঙ্গু বানিয়ে পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসররা এমন একটা ময়দান তৈরি করে রেখেছিল, যাতে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হলেও আবার তারা মাথা তুলতে পারে। তারা আরো মনে করেছিল, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠবে। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করে।

স্বাধীনতার পর থেকে তাদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দিবস থাকলেও বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোনো তালিকা ছিল না। বর্তমান সরকার শহিদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা চ‚ড়ান্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সঙ্গীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ প্রথমে ১৯৭২ সালে শুরু হলেও সে তালিকা কখনো সরকারি নথি বা গেজেটভুক্ত হয়নি। এখন যে ১২২২ জনের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, সেটি গেজেটভুক্ত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যায়ের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবীদের মতে, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা দেশকে মেধাশূন্য করে দিয়েছিল। শিল্প-সংস্কৃতি-শিক্ষা-দর্শন-রাজনীতি ও সমাজের সর্বস্তরে তার প্রভাব পড়েছে।

আজকের এই দিনে দাঁড়িয়ে, আমরা আবারও অনুধাবন করি আমরা কী হারিয়েছি। এ আলোকিত মানুষরা বেঁচে থাকলে আজ বাংলাদেশকে আরো বহু দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত, নিয়ে যেত এক অনন্য উচ্চতায়। দুর্ভাগ্য আমাদের। কিন্তু আমরা ভুলিনি সেসব সূর্য সন্তানদের। তাই বুদ্ধিজীবী দিবস পালন সবচেয়ে সার্থক হবে তখনই, যদি আমরা সেই চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করি এবং সেই চেতনার যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করে যাই। আজও স্বাধীনতাবিরোধীরা আবারও নানা কৌশলে সেই চেতনার স্তম্ভকে আঘাত করতে চাইছে কিন্তু চেতনা রক্ষায় আমাদের, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সদা সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল জাতির অস্তিত্বের উপরে এক চরম আঘাত। এক হীন উদ্দেশ্যেই বুদ্ধিজীবী হত্যার প্লট তৈরি হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করার চক্রান্ত। বুদ্ধিজীবী হত্যা জাতির ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি


আরো সংবাদ



premium cement