৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ওয়াজ মাহফিল সংস্কৃতি কোন দিকে

ওয়াজ মাহফিল সংস্কৃতি কোন দিকে - ছবি : সংগৃহীত

বহু প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে ধর্মীয় সভা বা ওয়াজ মাহফিলের সংস্কৃতি চলে আসছে। ধর্ম প্রচারের এটি ছিল অন্যতম সামাজিক হাতিয়ার। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জনমনে ধর্মের বাণী পৌঁছে দেয়া, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর প্রতি আনুগত্য ও ভক্তিভাব সৃষ্টি করা। ধর্মীয় জীবনযাপনে তাদের উদ্বুদ্ধ করা, অনুপ্রাণিত করা।

আমি পেশাদার বা নিয়মিত বক্তা নই। ঘনিষ্ঠতা আছে এমন আয়োজকদের ডাকে কখনো মাহফিলে যাই, বক্তৃতা করি। গত সপ্তাহে দিনের বেলায় এক মাহফিলে গিয়েছিলাম। মন-মানসিকতা ও বয়সজনিত কারণে এলোপাতাড়ি ঘোরাফেরা একেবারেই হয় না। তাই বর্তমান সভাসংশ্লিষ্ট পরিবেশের বাইরে আর কোনো পরিবেশ সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা নেই। সে দিন দৈবাত মাহফিলের বাইরে যেতে হলো। মাহফিলের বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে আমার মনে যে চিত্র আগে থেকে বিদ্যমান এখানে তার বিপরীত বাস্তবতা দেখে আশ্চর্য হলাম।

মনে পড়ে গেল শিশুকালের একটি স্মৃতি। বাড়ি থেকে ঘণ্টাখানেকের পথের দূরত্বে ওয়াজ মাহফিল। নামী-দামি একজন ওয়ায়েজিন সেখানে প্রধান অতিথি। আল্লাহর মহান এ বান্দার শুভাগমন উপলক্ষে সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য এলাকার মানুষের মধ্যে বেশ সাড়া পড়েছে। আমার মুরব্বি পিতামহ, পিতা ও বড় ভাইদের সাথে মিলে এক ঝাঁক লোক এক সাথে মাহফিলে গেলাম এশার সালাতের আগে। সবারই ইচ্ছা রাত শেষে ফজরের সালাত পড়ে মুনাজাতের পর বাড়ি ফিরব। শীত মৌসুম হওয়ায় প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র, পান, পিঠাও সাথে নিয়ে নিলো অনেকে। বয়সে ছোট হওয়ায় সবার গোল-আসনের মধ্যে যুৎসই স্থানে বসানো হলো আমাকে।

পরম গাম্ভীর্য ও স্বকীয়তায় এক সময় সাহেবে-জলসা সুসজ্জিত মঞ্চে কুরসিতে উপবেশন করলেন। আলোকিত পরিপাটি মঞ্চে, যথোপযুক্ত মানানসই লেবাসে যেন তিনি স্বর্গীয় ফেরেশতার রূপ পরিগ্রহ করেছেন। অতঃপর স্পষ্ট কণ্ঠে সাবলীল ভাষায় ধীরগতিতে শ্রোতাদের উদ্দেশে উপদেশমালা উপস্থাপন করতে শুরু করলেন। বিশুদ্ধ মরমি তিলাওয়াত, উদ্ধৃতিসমেত হাদিসের চিরন্তন বাণী, প্রামাণ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ নাতিদীর্ঘ বয়ান পেশ করলেন। উপযুক্ত মওকায় দরুদ ও জিকিরের প্রয়োজনীয় তালিমও করলেন। এরপর বয়ানের শেষে সবাইকে নিয়ে একাগ্রচিত্তে তওবা করলেন আল্লাহর দরবারে। বিস্তীর্ণ প্যান্ডেলে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কয়েক হাজার মুসলমানের ঠাসা জমায়েত। রাতের দ্বিতীয় প্রহর শুরু হয়ে গেছে। সর্বত্র পিনপতন নীরবতা। হৃদয়স্পর্শী বক্তব্যের কষালো টানে সর্বত্র আবেগের রোমাঞ্চ শুরু হয়েছে। উপযুক্ত ঐশী বাণী শ্রবণের ফলে পরিতৃপ্তির অমীয় সুধা উপচে পড়ছে শ্রোতাদের কানে। আহা, কী উচ্ছ্বাস! কী প্রেমময়তা!

ইসলামের ঊষাকালে দ্বীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় নবী সা: ও সাহাবিদের মর্মবিদারী লোমহর্ষক ঘটনাবলির সাথে মৃত্যুর পর একাকিত্বের কবর, বিচারের জন্য হাশরের ময়দান এরপর বেহেশত-দোজখের দৃশ্যপটের প্রাঞ্জল ও অনুপুঙ্খ বর্ণনায় তখন মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি বিমর্ষ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। শ্রোতাদের চোখ অশ্রুজলে টলমলে হয়ে উঠল। হৃদয়জুড়ে ভাবাবেগের প্রলয়-তুফান চলছে। সভার উপস্থিত মুসলিম শ্রোতামণ্ডলী চেতনার খেই হারিয়ে মজ্জ্বমান হলো স্র্রষ্টার গভীর ধ্যানে। পাথুরে পাষাণ হৃদয় ক্রমেই বিগলিত হয়ে মানবাত্মার গহীন কোণে জেগে উঠল স্র্রষ্টাকে পাওয়ার পরম আকাক্সক্ষা। প্রেমাবেগে থর থর কেঁপে উঠল তাদের হৃদয়। মনের ভেতর দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা ও বাস্তব জীবনের অনুসরণের মতো দ্বীনি প্রেরণা ও উৎসাহ লাভ করল তারা, যা মূলত মাহফিল অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য।

হালকালের মাহফিলগুলো তীক্ষ্ণ নজরে বিশ্লেষণ করলে সেগুলোতে অসংখ্য অসংলগ্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলমানদের আমলে উৎসাহী করা ও তাদের ঈমানি শক্তি পূর্ণভাবে শাণিত করাই মাহফিল অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ৮০ শতাংশ মাহফিলে এই উদ্দেশ্য অনুপস্থিত থাকে। কী বক্তা, কী আয়োজক, কী মাহফিলের পরিবেশ- সর্বত্রই চাকচিক্য প্রদর্শনের চূড়ান্ত মহড়া লক্ষ করা যায়।
বক্তা হিসেবে পরিপক্ব বিদ্যা ও তদনুযায়ী আমল হলো উপদেশ দেয়ার প্রধান শর্ত। কিন্তু বেশির ভাগ ওয়াজিনের ক্ষেত্রে এ দু’টি আদর্শগুণের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। মহান আল্লাহর বাণী- ‘কোনো বিষয় জানা না থাকলে তোমরা এলেম ওয়ালাদেরকে জিজ্ঞাসা করো’ (সূরা নাহল-৪৩)। ‘হে ঈমানদারগণ! সে কথা কেন বলো, যা তোমরা আমল করো না’ (সূরা আস সাফ-২)।

বক্তব্য দেয়ার প্রধান উৎস কুরআন-হাদিস। অথচ, আমাদের বক্তাদের ইনিয়ে বিনিয়ে কণ্ঠস্বরের কারিশমায় আজগুবি সব বর্ণনা করতে দেখা যায়। শ্রোতাদের মন-মানসিকতা, পরিবেশ ও যোগ্যতার কোনো লেহাজ বক্তারা করেন না। কখনো বা ঝাঁঝালো বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করেন। থেকে থেকে কণ্ঠস্বরের তীব্রতা বাড়ানোর মাধ্যমে মোহনীয়তা সৃষ্টি করে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করার চেষ্টা করেন যা অনেক সময় হাস্যকর হয়ে ওঠে। এ ভাবে কেড়ে নিতে চেষ্টা করেন শ্রোতাদের সস্তা আবেগ। রুহানিয়াতশূন্য এসব ওয়াজ শ্রোতাদের মধ্যে স্থায়ী কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; বরং এসব ওয়াজের স্বল্পপ্রাণ আবেগ ক্ষণিক পরেই মিলিয়ে যায়। অথচ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার প্রভুর দিকে আহ্বান করো যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশমালার মাধ্যমে’ (সূরা নাহল-১২৫)।

‘যে ব্যক্তি আমার ভীতি প্রদর্শনকে (আজাব) ভয় করে তাকে কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করো’ (সূরা ক্কাফ-৪৫)। খালেস ওয়াজের জন্য কোনোরকম বিনিময় গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। অথচ পেশাজীবী বক্তারা হাদিয়ার নামে যথেচ্ছ বিনিময় গ্রহণ করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অনুসরণ করো ওই সব ব্যক্তির যারা তোমাদের কাছে বিনিময় চায় না’ (সূরা ইয়াসিন-২১)।

ওয়াজ মাহফিল অত্যন্ত পবিত্র ও গাম্ভীর্যপূর্ণ স্থান। কৌতুক, বিদ্রুপ, অভিনয়, কমেডি, পরনিন্দা ও গিবতের মতো গর্হিত আচরণগুলো এ ক্ষেত্রে কঠিনভাবে বর্জিতব্য। তথাকথিত বক্তারা জনমানুষের সস্তা আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভাইরাল হওয়ার নেশায় বাস্তবে যা ইচ্ছে তাই করে যান। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই এটি চূড়ান্ত বাণী, এটি কোনো বিদ্রুপ কৌতুক নয়’ (সূরা ত্বারিক : ১৩-১৪)।

পক্ষান্তরে কিছু কিছু বক্তার অশালীন লেবাসি ফ্যাশন, বক্তব্য মঞ্চে অশোভন অঙ্গভঙ্গি, বক্তব্যের মাঝে মধ্যে সাড়া দানের জন্য স্ব-উদ্ভাবিত ও মুসলিম সংস্কৃতিতে অস্বীকৃত শব্দমালা উচ্চারণের জন্য শ্রোতাদের উৎসাহিত করা ওয়াজের ময়দানের ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদা মারাত্মকভাবে কলুষিত করছেন। ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দ্বীনের প্রচার। বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিলগুলোর হালচাল দেখে দ্বীনবোদ্ধা আলেমরা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাস্তবতা এমন যে, ওয়াজ মাহফিল থেকে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য আয়োজকদেরও দায় আছে। উদ্যোক্তা বিশেষে ওয়াজ মাহফিলের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কোনো কোনো মাহফিল আয়োজকদের কৃতিত্ব জাহির ও অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। দ্বীন প্রচারের পবিত্র উদ্দেশ্য সেখানে গৌণ। পক্ষান্তরে সীমিত উদ্যোক্তা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু মাহফিলে আর্থিক স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের প্রবণতা দেখা যায়। মাহফিল শেষে অর্থ কুক্ষিগত করার অভিযোগ পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে।

ওয়াজ মাহফিলের বাইরে মেলা জাতীয় পরিবেশ ফলপ্রসূ ওয়াজের ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধক। মেলা জাতীয় পরিবেশ ঠিক রেখে ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠানকে আমরা নতুন সংস্কৃতি হিসেবে ধরে নিতে পারি, সত্যিকার ফলপ্রসূ গাম্ভীর্যপূর্ণ ওয়াজ মাহফিল হিসেবে নয়। তাই ওয়াজ মাহফিলের রুহানিয়াত ফিরিয়ে আনতে বক্তা, শ্রোতা, আয়োজক সবাইকে খালেস মনে কাজ করে যেতে হবে। ওয়াজ মাহফিলের সাথে মেলা সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে সর্বতোভাবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক

ইমেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement