৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অভিন্ন সিভিল কোড : ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা

কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের মহড়া। - ছবি : সংগৃহীত

‘অভিন্ন সিভিল কোড, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা’। মাফ করবেন, এটা কোনো মুসলিম নেতার বক্তব্য নয়। এমনকি কোনো মুসলিম সংগঠনও এমনটা বলেনি। এ বক্তব্য শিখদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন শিরোমণি গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটির। এ কমিটি গত ১০ নভেম্বর নতুন দিল্লিতে রীতিমতো প্রস্তাব পাস করে অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়নের চেষ্টার কঠোর বিরোধিতা করে।

প্রবন্ধক কমিটি অভিন্ন সিভিল কোডের বাস্তবায়নকে আরএসএস এবং বিজেপির মাধ্যমে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা অভিহিত করে তীব্র সমালোচনা করেছে। সাধারণত যখনই অভিন্ন সিভিল কোডের আলোচনা আসে, তখনই এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া আসে মুসলিম নেতারা ও মুসলিম সংগঠনগুলো থেকে। তারা বেশ জোরেশোরেই তার বিরোধিতা করে। কিন্তু এটাই প্রথমবার, সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও এর বিরোধিতা করা হয়েছে। প্রবন্ধক কমিটির ওয়েবসাইটে থাকা বিদ্যমান প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘ভারত এক বহু ভাষী ও বহু ধর্মের দেশ। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বসবাস করে। কিন্তু এখানে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি প্রশাসন আরএসএস-এর অ্যাজেন্ডাকে রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনাও তারই অংশবিশেষ। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অভিন্ন সিভিল কোড দেশের স্বার্থানুকূল নয়। এটা কার্যকর হওয়া উচিত নয়।’

এ কথা সবারই জানা যে, বিগত বেশ কিছু কাল আগে থেকেই বিজেপি অভিন্ন সিভিল কোডকে হিন্দু ভোট সংগ্রহের জন্য এক রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বেছে নেয়। ভারতে যেখানেই কোনো বিধানসভার নির্বাচন হয়, সেখানে তারা সর্বপ্রথম অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন করার কথা বলে। বলা হয়, অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন হওয়ামাত্র দেশে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বেকারত্ব, বেআইনি কর্মকাণ্ড ও লুটতরাজের মতো সমস্যাগুলো মুহূর্তে সমাধান হয়ে যাবে। বিজেপির ব্যাপারে সবাই জানেন, তাদের উদ্দেশ্য হিন্দুদের ভোট হাতানো। তারা মনে করে, অভিন্ন সিভিল কোড এমন এক স্লোগান, যাতে হিন্দুরা খুশি হয়ে যায় এবং মুসলমানরা ভয়ে আঁতকে ওঠে। মুসলমানরা অনুভব করে, অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়নে তাদের শরয়ি আইনগুলো শেষ হয়ে যাবে এবং ভারতে সবার জন্য একই ধরনের পারিবারিক আইন চালু হয়ে যাবে। কিন্তু অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন করা স্বয়ং সরকারের জন্য কতটা কঠিন, এটা জানা খুবই প্রয়োজন।

গত ২৮ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টে অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়নের দাবি সংবলিত আরজির, এ বলে কঠোর বিরোধিতা করেছে যে, সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে পার্লামেন্টকে আইন প্রণয়নের পথনির্দেশনা দিতে পারেন না। এ জন্য অভিন্ন সিভিল কোডের দাবি সংবলিত আরজিকে দ্রুত প্রত্যাখ্যান করা হোক। প্রকাশ থাকে যে, সুপ্রিম কোর্ট এর আগে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ জবাব দাখিলের পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন। অথচ সরকার এমনটা করার পরিবর্তে এই আরজিকেই প্রত্যাখ্যান করার দাবি করে বসেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এগুলোর মধ্যে একটি আরজি স্বয়ং বিজেপি নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের উকিল অশ্বিনী উপাধ্যায়েরও ছিল। বর্তমানে গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনী কার্যক্রম বেশ তুঙ্গে। সেখানে বিশাল বিশাল মিছিল-সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে বিজেপির ছোট-বড় নেতারা এ কথাই বলছেন যে, তারা এবার ক্ষমতায় এসেই সবার আগে অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন করবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি অভিন্ন সিভিল কোড উন্নয়ন ও সফলতার জন্য এতটাই প্রয়োজন, তাহলে বিগত ২৭ বছরে নিজেদের শাসনামলে বিজেপি গুজরাটে এটা কেন বাস্তবায়ন করেনি?

আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, চলতি বছর শুরুতে যখন উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছিল, তখন সেখানেও বিজেপি অভিন্ন সিভিল কোড ইস্যু বেশ জোরালোরূপে উত্থাপন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে দশ মাস হতে চলল, তারা ওই রাজ্যে এর নাম পর্যন্ত নেয়নি। দেখে মনে হচ্ছে, অভিন্ন সিভিল কোড যেন একটা চলন্ত শামিয়ানা, যা সেই রাজ্যগুলোতে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়। এ কারণেই ইউপি ও উত্তরাখণ্ডের পর গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ ও কর্নাটকেও এর গুঞ্জরণ শোনা যাচ্ছে। এ রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের জনসংখ্যা শতকরা পাঁচ থেকে দশ।

বিজেপির ধারণা, জনগণ এমন ইস্যুগুলো সামনে রেখে তাদের ভোট দেয়। সাধারণ ধারণা হচ্ছে, অভিন্ন সিভিল কোড মূলত মুসলিম পার্সোনাল ল’র বিলুপ্তির ঘোষণা। আর মুসলমান যেকোনো মূল্যেই তাদের পার্সোনাল ল’ থেকে হাত গোটানোর জন্য প্রস্তুত নয়। এ কারণেই তারা অভিন্ন সিভিল কোডের নাম আসতেই এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে থাকে। অথচ এটা এক অপ্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া। কেননা অভিন্ন সিভিল কোডের বাস্তবায়নের প্রভাব শুধু মুসলমানদের ওপরই পড়বে না, বরং এ দেশের সব শ্রেণি এর মাধ্যমে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চিন্তার বিষয় হচ্ছে, যেখান থেকে অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন হওয়ার কথা, সেই প্রশাসন এ বিষয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে রয়েছে। কয়েক দিন আগে খবর এলো, সরকার অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। পার্লামেন্টের গত অধিবেশনে যখন সরকারের কাছে এ প্রশ্নই করা হলো, তখন তারা এটা প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘সরকার ল’ কমিশনের কাছে আবেদন করেছে, তারা যেন অভিন্ন সিভিল কোড সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং এর ওপর তাদের সুপারিশমালা পেশ করে। রাজ্যসভায় আইন ও বিচারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু বলেছিলেন, ‘ভারতে অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়নের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এ বিষয়টি এখনো আদালতের শুনানিধীন রয়েছে।’

এখন আসুন, আমরা ল’ কমিশনের প্রতি একটু নজর দিই, যার কাঁধে সরকার অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অনুসন্ধানের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ল’ কমিশনের ধারণা, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিষয়াদির আইনের মামলাগুলোর সমাধানের জন্য অভিন্ন সিভিল কোডের প্রয়োজন নেই। ল’ কমিশন তার পরামর্শমূলক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, অভিন্ন সিভিল কোড প্রার্থিতও নয়, প্রয়োজনীয়ও নয়। অবশ্য কমিশন বিভিন্ন পার্সোনাল ল’র বিভিন্ন আইনের মধ্যে স্বতন্ত্র আচরণ ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বিদ্যমান পারিবারিক আইনে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ল’ কমিশনও অভিন্ন সিভিল কোডের সমর্থক নয়।

বাস্তবতা হলো, অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য লোহার দানা চিবানোর মতো অসম্ভব কর্ম হবে। এ কারণেই সাংবিধানিক নির্দেশনা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও কোনো সরকার এ পথে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। সংবিধানের ৪৪ নং ধারায় এ কথা বলা হয়েছে যে, সরকার পুরো দেশের নাগরিকদের জন্য অভিন্ন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করবে। কিন্তু সাংবিধানিক এই নির্দেশনা সত্ত্বেও কোনো সরকারই এর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। এর বড় কারণ হচ্ছে, ভারত বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি ও গোত্রীয় রীতির দেশ। হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ বিয়েশাদি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিষয়াবলিতে নিজ নিজ ভিন্ন ভিন্ন রীতি অনুসরণ করে। এ সব বিষয়ে যেখানে কোনো একটি শ্রেণীতেই অভিন্নতা নেই, সেখানে সবার জন্য একরকম আইন কিভাবে হতে পারে?

উদাহরণস্বরূপ অন্ধ্রপ্রদেশের হিন্দুদের মাঝে ভাগ্নির সাথে মামার বিয়ে শুদ্ধ। অন্য প্রদেশের হিন্দুদের মাঝে এটা অসম্ভব। তাহলে আইনে অভিন্নতা সৃষ্টি করা কী করে সম্ভব? এ কারণেই প্রতিটি সরকার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত থাকে যে, তারা অভিন্ন সিভিল কোড বাস্তবায়ন করবে কি না? বিজেপির অপারগতা হচ্ছে, তারা যে স্লোগানকে নিজেদের মৌলিক অ্যাজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল, সেগুলোর মধ্যে রামমন্দির ও ধারা ৩৭০-এর লক্ষ্য অর্জন হয়ে গেছে। কিন্তু অভিন্ন সিভিল কোড এখনো বাকি থেকে গেছে, যেটাকে তারা হিন্দু রাষ্ট্রের কাঠামোতে রঙ লাগানোর জন্য স্লোগান হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১৩ নভেম্বর, ২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement