সঙ্কট জিইয়ে রাখা হয় রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই
- রিন্টু আনোয়ার
- ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:১৬
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়েছে ইডেন ক্যাম্পাস যদিও ইডেন কলেজে ছাত্রী সংগঠনের এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। অথচ দেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম সবার আগে সামনে আসে, রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ তাদের অন্যতম। এই কলেজের ওয়েবসাইটে সার্বক্ষণিকভাবে যে স্ক্রলটি চলে, সেখানে লেখা আছে- ‘সন্ত্রাস নয় শান্তি চাই, শঙ্কামুক্ত জীবন চাই।’ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো- রাজনৈতিক দলাদলি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা অনৈতিক অভিযোগের কারণে এই কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে আবাসিক হলে থেকে যারা পড়াশোনা করেন, তারা কতটা শঙ্কামুক্ত, তা নিয়ে আগেও বহু প্রশ্ন উঠেছে আর এখন তো আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে এটি আরো পরিষ্কার। বিশেষ করে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে হলে থাকা অনেক ছাত্রীকে দিয়ে নানারকম অনৈতিক কাজ করানো; এমনকি দলীয় পদ-পদবি পাওয়াসহ নানারকম স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ হাসিলের জন্য তাদের নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার ‘শয্যাসঙ্গী’ হতে বাধ্য করার মতো গুরুতর অভিযোগ করেছে তাদেরই কমিটির অন্য সদস্যরা।
সেসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবারও কলেজ ছাত্রলীগের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি। দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনার তদন্তে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করেছে কলেজ প্রশাসন। তবে তদন্ত কমিটিতে কারা রয়েছেন বা কত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা পড়বে সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানায়নি কর্তৃপক্ষ।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সব দোষ কি ছাত্ররাজনীতির? বা ইডেনের? তাহলে নারীশিক্ষায় দেশসেরা রাজধানীর নামকরা ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু ছাত্রীর দুষ্কর্মের পুরো দায় ছাত্ররাজনীতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার ধুম চলছে কেন? সেই সাথে ইডেনকে করে ফেলা হচ্ছে একটি নিকৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। আর ইডেনে পড়াশোনা করা ছাত্রী মানেই দুশ্চরিত্রা! দুর্ভাগ্যজনকভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এ সরলীকরণ। ট্রল হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ইডেন মানে, বেহেশতের বাগান। এ বাগানে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোকে চূড়ান্ত বিবেচনা বা অগ্রাহ্য করা কোনোটিই কি সঠিক হবে? কলেজটির সব ছাত্রী বা অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাই এমন- এ ধরনের সাব্যস্ত করে ফেলাও সঠিক হবে? সেখানকার ছাত্রলীগের হোস্টেলের মেয়েদের দিয়ে বড় নেত্রীদের অনৈতিক কাজ তথা ব্যবসায় করানোর মতো অভিযোগ তো আকস্মিক নয়, আগেও হয়েছে। এত দিনেও এগুলোর বিহিত না করার দায় কার? এর নেপথ্যে কারা?
শুধু ছাত্রী নয়, সেদিন শহীদ মিনারে কোটা সংস্কার আন্দোলনে মরিয়মের দিকে ছুটে যাওয়া ছাত্রলীগের এই হাতগুলো মিথ্যা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নূরের দিকে ছুটে যাওয়া ওই পাগুলো ছাত্রলীগেরই ছিল। বুয়েটে আবরার হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও ছাত্রলীগকে এ চরিত্র থেকে সরানো হয়নি।
বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা পূর্বকালের ছাত্রলীগ আর স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ছাত্রলীগ এক নয়। দুই পর্বের ছাত্রলীগের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্য যেমন আদর্শের দিক থেকে রয়েছে, তেমনি রয়েছে নেতাকর্মীদের স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে। অবস্থাদৃষ্টে বলাই যায়, সংগ্রামশীল, আদর্শ ও নৈতিকভাবে বলবান, মানবিক, সহৃদয় ও দায়িত্বনিষ্ঠ একটি ছাত্র সংগঠন তার চরিত্র হারিয়েছে। ছাত্রলীগ এখন একটি ভীতিকর নাম। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ এমন কোনো অপরাধ ও গর্হিত কর্ম নেই, যার সাথে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী জড়িত নয়। এখন ছাত্রলীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মীর অর্থ-বিত্ত-বৈভরের শেষ নেই যেটি অতীতের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কল্পনায়ও আনতে পারেনি। বর্তমানদের লোভ, ঈর্ষা, দখলদারি মনোভাব এতই বেড়েছে যে, অর্থ-মোক্ষ অর্জনের জন্য তারা যাচ্ছেতাই করতে পারে। ক্ষমতা ও প্রভাব রক্ষায় আপন সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হতে, খুন-জখম করতে, তাদের হাত এতটুকু কাঁপে না। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ-সঙ্ঘাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত কর্মী নিহত ও আহত হয়েছে। দেশে গ্যাং কালচার বিস্তার লাভ করছে। কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে। শুধু কিশোর গ্যাং নয়, কিশোরী গ্যাংও দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও।
আগেও কখনো কখনো ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ-সঙ্ঘাত দেখা যেত। ছোটখাটো মারামারিও ক্ষেত্রবিশেষে হতো। কিন্তু ছাত্রীরা মারামারি করেছে, এমনটি কখনোই দেখা যায়নি। এখন ছাত্রীরাও মারামারিতে পিছিয়ে নেই। ইডেন কলেজের উদাহরণ তো সামনেই আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুরূপ মারামারির নজির তো রয়েছেই।
এমতাবস্থায় কেন দু’-চারটি উচিত কথা বলছেন না বুদ্ধিজীবী আর অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা? কেন কিছু বলছেন না আদর্শবান সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা? যতক্ষণ না নিজের সন্তান বা বোন ধর্ষিতা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত উপলব্ধি কি আসতে নেই? তারা কেন বলছেন না, দোষীদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হোক।
আরেকটি বিষয় নিয়ে না বললেই নয়; কেবল সিটবাণিজ্য নয়, ইডেন কলেজের বেশ ক’জন ছাত্রীকে বিভিন্ন জায়গায় ‘সাপ্লাই’ দিয়ে দেহব্যবসায় পর্যন্ত করানোর জঘন্য অভিযোগ রীতিমতো এখন বাজার গরম করে দিয়েছে। ফলে কলেজটির সব ছাত্রীকে এক কাতারে ফেলে দেয়া হলো। এসব ঘটনায় কলেজটিতে পড়াশোনা করা অন্যান্য ছাত্রীদের অভিভাবকদের মানসিক ও সামাজিক অবস্থা কেমন হচ্ছে, ভাবা যায়? তাদের একজনও কি মেয়েদের এ কাজে ইডেনে পাঠিয়েছেন? অথবা এমন অভিযোগে পড়তে পারেন বলে মানসিক প্রস্তুতি ছিল তাদের? কোনো অভিভাবক কি চেয়েছেন তার বা অন্য কারো মেয়ে মারামারিতেও এগিয়ে যাক? দেহব্যবসায় তো আরো পরের ব্যাপার। অভিভাবকরা যাবেন কোথায়?
ভাবা যায়, মা-বাবাকে ছেড়ে পড়াশোনা করতে আসা মেয়েটিকে দেহব্যবসায় বাধ্য করা? শাস্তি হিসেবে সভাপতি-সেক্রেটারি ঠিক রেখে বাকিগুলোকে অদলবদল করা? এ কর্মটিকে ব্যবসায় বা শিল্প হিসেবে দাঁড় করানোতে বাকিগুলোরও কি অবদান কম?
ক্ষমতাধরদের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় অপকর্মের ধরন সম্পর্কে মানুষের কমবেশি জানা। আগেই বলেছি, আজ যারা ছাত্রলীগ করছে, তাদের সুযোগ-সুবিধার অন্ত নেই। গত ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে। সেই হিসাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই সময়কালে চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। যতদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বা থাকবে, ততদিন এই প্রাধান্য অটুট থাকবে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আচার-ব্যবহার ও স্বভাব-চরিত্র তাদের কর্ম বা পেশাজীবনে প্রতিফলিত হবে, এটিই সঙ্গত। পর্যবেক্ষক মহল শঙ্কিত এই ভেবে যে, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যারা নিয়োগ পেয়েছেন বা এখনো পাচ্ছেন, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও মান সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এমতাবস্থায়, আগামীতে দেশ কেমন চলবে, আন্দাজ করা অসম্ভব নয়। এটি অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।
এদিকে ইডেনের হিডেন অবস্থা উপলব্ধির পথে নতুন খোরাক জুগিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের ঘটনায় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ১২ নেত্রী এবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়েছিলেন আমরণ অনশন করতে। প্রথমে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রবেশের সময় বাধাপ্রাপ্ত হন বহিষ্কৃত এই নেত্রীরা। এরপর প্রতিবাদের মুখে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়ে আবার গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানে এক ঘণ্টা অবস্থান করার পর বাইরে বেরিয়ে আসেন তারা। তাদের এ ভ‚মিকা ও অবস্থানও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, সিটবাণিজ্য, সাধারণ ছাত্রীদের হেনস্তাসহ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে দু’পক্ষেরই।
এত কিছুর পরও সভাপতি-সম্পাদককে কমিটিতে রেখে সহ-সভাপতিসহ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা ও কমিটি স্থগিত করার মধ্য দিয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সঙ্কট আর সাধারণ ছাত্রীদের ও ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে না; বরং এতে সমস্যা ও নির্যাতন নতুন মাত্রা পাবে। এ ধরনের সঙ্কট নিরসনে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা বরাবরই অনুপস্থিত। কারণ মূলধারার রাজনীতি এই সঙ্কট জিইয়ে রাখে তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই।
যেকোনো সমস্যা থেকে উত্তরণ বা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো সমস্যাকে স্বীকার করে নেয়া, তার মাত্রা কম বা বেশি যেটিই হোক।
এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীনদের দায় বেশি। অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধেই বেশি। কেবল ছাত্ররাজনীতি নয়, গোটা রাজনীতির জন্যই এটি কলঙ্কের, উদ্বেগ-শঙ্কারও। কে জানে এদের মধ্যেই রয়েছেন কি না আগামী দিনের কোনো মন্ত্রী-এমপি? বা ভবিষ্যৎ পাপিয়া-সাবরিনা? কী দশা হবে তখন?
সরকার যাবে, আসবে; কিন্তু যে সরকার সব ক্ষেত্রে অগ্রসরমান, শান্তিপূর্ণ, সুশাসিত দেশ রেখে যাবে, সেই সরকারই ইতিহাসে নন্দিত হবে। এই জরুরি ও প্রয়োজনীয় বিষয়টি সামনে রেখে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিজ্ঞজনদের মতে, বর্তমান ছাত্রলীগ সরকারের জন্য এখন আর সম্পদ নয়, বোঝাস্বরূপ। তাই এ বোঝা ঝেড়ে ফেলতে হবে। একটি পরিশোধন কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগকে। পরিশোধনকৃত ছাত্রলীগ সরকারের জন্য যেমন উপকারী হবে, তেমনি দেশবাসীর জন্যও। আমরা আশা করব, ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ব্যাপার অনুপুঙ্খ তদন্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মনে রাখতে হবে, দুষ্ট ষাঁড়ের চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা