বিতর্কের কেন্দ্র
- হামিদ মীর
- ৩০ নভেম্বর ২০২২, ২০:২৭
কেউ মানুক, আর না মানুক, সব বিতর্কের জন্য দায়ী নতুন সেনাপ্রধানের নিয়োগ। এক বছর আগে এ বিতর্ক সে সময় শুরু হয়েছিল, যখন ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে ২০১৯ সালে তিন বছরের জন্য মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে ২০২১ সালের অক্টোবরে আইএসআইয়ের ডিজির ট্রান্সফার নিয়ে জেনারেল বাজওয়ার সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে ইমরান খান জেনারেল বাজওয়াকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অব্যাহতি দিয়ে নিজের কোনো এক বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে সেনাপ্রধান বানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
এখন এটা কোনো গোপন কথা নয় যে, ইমরান খান সেনাবাহিনীকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। সেনা নেতৃত্ব যখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে ব্যবহৃত হতে অস্বীকৃতি জানাল, তখন খান সাহেব মনঃক্ষুণ্ণ হন। এরপর অনাস্থা আন্দোলন শুরু হলে জেনারেল বাজওয়ার সাথে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয়। ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান খান প্রেসিডেন্ট আরিফ আলাভির মাধ্যমে আরো একবার জেনারেল বাজওয়ার সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেন। যখন তিনি ব্যর্থ হন, তখন সরাসরি সেনাপ্রধানসহ অপর কিছু সেনা অফিসারের সমালোচনা শুরু করে দেন।
৩ নভেম্বর উজিরাবাদের কাছে ইমরান খানের ওপর আত্মঘাতী হামলার দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। পরের সন্ধ্যায় খান সাহেব লাহোরের শওকত খানম হাসপাতালে এক প্রেস কনফারেন্সে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, তার চারটা গুলি লেগেছে। তিনি এক সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ আনেন। তিনি এ কথাও বলেন যে, এ ঘটনার এফআইআর লিপিবদ্ধ হয়নি। আইএসপিআর ইমরান খানের অভিযোগ বেশ শক্ত ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর তেহরিকে ইনসাফের সিনেটর আজম সোয়াতি তড়িঘড়ি একটি প্রেস কনফারেন্স করেন। সোয়াতি যে তথ্য প্রকাশ করেন, তা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমাদের বলা হতো, আসিফ জারদারি, শাহবাজ শরিফ, মরিয়ম নওয়াজ ও অপর কিছু রাজনীতিবিদের ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। আজম সোয়াতির সুবিচার পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নির্মম পরিহাস দেখুন, যখন তেহরিকে ইনসাফের কিছু নেতা আজম সোয়াতির বিষয়ে কিছু সেনা অফিসারকে কাছে টানছিলেন, ওই সন্ধ্যায় ইমরান খানের কিছু কাছের মানুষ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে সমঝোতার রাস্তা খোঁজ করছিলেন।
এ সময় পাকিস্তানকে যে বিতর্কে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে, এ ফাঁদ থেকে বের হওয়ার জন্য সমঝোতার চেষ্টা কোনো খারাপ কিছু নয়, কিন্তু সমঝোতার জন্য এ কথা বলা, ‘জেনারেল বাজওয়া যাওয়ামাত্র অমুক বা অমুককে সেনাপ্রধান বানিয়ে দিন, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে’ মারাত্মক অসঙ্গত। সমঝোতার জন্য নতুন নির্বাচনের তারিখ চাওয়া অবশ্যই ঠিক আছে, কিন্তু নিজের ইচ্ছেমতো সেনাপ্রধান চাওয়া এটা প্রমাণ করে যে, আমাদের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতারা জনগণের ওপর সামান্য এবং সেনাপ্রধানের ওপর বেশি নির্ভরশীল। এ দুর্বলতা আমরা শুধু ইমরান খানের মাঝেই দেখছি, তা নয়। অতীতের অধিকাংশ জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জ্যেষ্ঠতা উপেক্ষা করে নিজেদের পছন্দমাফিক ব্যক্তিকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে কেউই নিজেদের মনের বাসনা পূরণ করতে পারেননি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ১৯৫১ সালে দু’জন জ্যেষ্ঠ জেনারেল মুহাম্মদ আকবর খান ও এনএএম রেজাকে উপেক্ষা করে আইউব খানকে সেনাপ্রধান করেন।
পাকিস্তানের রাজনীতির শিক্ষার্থীদের জেনারেল আকবর খানের আত্মজীবনী ‘মেরি আখেরি মনজিল’ (আমার শেষ ঠিকানা) অবশ্যই পড়া উচিত, যাতে তারা জানতে পারে যে, প্রথম সেনাপ্রধান নিয়োগের আগে কী কী ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সেনাবাহিনীর সবচেয়ে যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জেনারেল ইফতেখার খান হঠাৎ এক রহস্যপূর্ণ দুর্ঘটনার শিকার হন। মুহাম্মদ আকবর খান ও এনএএম রেজাকে এ জন্য উপেক্ষা করা হয়েছে যে, তারা কোনো ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেতা বানানোর বিপক্ষে ছিলেন। সুতরাং লিয়াকত আলি খান প্রতিরক্ষা সচিব ইসকান্দার মির্জার পরামর্শে আইয়ুব খানকে সেনাপ্রধান বানিয়ে দেন। সেই আইউব খান ইসকান্দার মির্জার সাথে যোজসাজশ করে পাকিস্তানে প্রথম মার্শাল ল’ জারি করেন।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইউব খান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনজন জেনারেলের জ্যেষ্ঠতাকে উপেক্ষা করে মুসা খানকে সেনাপ্রধান বানিয়ে দেন। ১৯৬৬ সালে আইয়ুব খান আবারো দু’জন জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে উপেক্ষা করে ইয়াহইয়া খানকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। ইয়াহইয়া খান ১৯৬৯ সালে তার মঙ্গলকামী আইয়ুব খানের কাছ থেকে ইস্তফা আদায় করে নেন এবং দ্বিতীয় মার্শাল ল’ জারি করেন। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সেনাপ্রধান নিয়োগে সাতজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে উপেক্ষা করে অনেক নিম্নের সেনা কর্মকর্তা, জেনারেল জিয়াউল হককে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে মার্শাল ল’ জারি করেন এবং ১৯৭৯ সালে ভুট্টোকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভুট্টোর এ কাজটাই জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বারবার করেছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি দু’জন জেনারেল জ্যেষ্ঠতাকে উপেক্ষা করে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন।
মোশাররফ এক বছরের মধ্যেই নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে দিয়ে নিজেই ক্ষমতা দখল করে নেন। নওয়াজ শরিফ ২০১৩ সালে আবারো দু’জন জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে উপেক্ষা করে রাহিল শরিফকে সেনাপ্রধান বানিয়ে দেন। রাহিল শরিফ ফিল্ড মার্শাল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনি এক প্রেক্ষাপটে মার্শাল ল’ জারি করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কিছু সঙ্গী কর্মকর্তা তাকে বাধা দেন। আর নওয়াজ শরিফ বড় ধরনের সঙ্কট থেকে বেঁচে যান। ২০১৬ সালে নওয়াজ শরিফ চারজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে উপেক্ষা করে জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে সেনাপ্রধান বানিয়ে দেন। এক বছর পর নওয়াজ শরিফকে জিটি রোডে বহির্জাগতিক প্রাণীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা গেল।
২০১৯ সালে জেনারেল বাজওয়ার সেনাপ্রধানের মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ হলে দেশ এক নতুন বিতর্কে ফেঁসে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, লন্ডনে বসে থাকা নওয়াজ শরিফ ও ন্যাবের বন্দী আসিফ জারদারি এক ‘মহা ঐকমত্য’-এর সাথে জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ বাড়িয়ে দেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট জানতে চাইলেন, এ মেয়াদ বৃদ্ধি কোন আইনের বলে দেয়া হলো? একে অপরের রক্তপিয়াসী রাজনীতিবিদ পার্লামেন্টে এক হয়ে গেলেন এবং মেয়াদ বৃদ্ধির আইন পাস করিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখ বন্ধ করে দিলেন। ইমরান খান নিজে যে জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধি করেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সাথে নিয়ে তার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আইনও প্রণয়ন করেন, আজ সেই জেনারেল বাজওয়াকে অনেক বড় খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানে সেনাপ্রধানকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশি শক্তিশালী মনে করা হয়। আর এ জন্যই প্রতিটি প্রধানমন্ত্রী নিজেদের পছন্দের সেনাপ্রধান আনতে চেয়েছেন। এ নিয়োগ কি শুধুই মেধার ভিত্তিতে হতে পারে না? যদি ইমরান খানও ২০১৯ সালে মেধার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, তাহলে আজ হাসপাতালে বসে কনফারেন্সের মাধ্যমে এ কথা বলতে হতো না যে, আমার ওপর আত্মঘাতী হামলার এফআইআর লেখা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী ইমরান খানের তার ইচ্ছামাফিক এফআইআর করানোর অধিকার রয়েছে। কিন্তু যে দেশে সব ক্ষমতা সেনাপ্রধানের কাছে থাকে, সেখানে আইন পিছে থেকে যায়, সেনাবাহিনী সামনে বেরিয়ে যায়।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৭ নভেম্বর, ২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা