৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানবাধিকার

- ছবি : সংগৃহীত

মানবাধিকার একটি সর্বজনীন শব্দ যার গুরুত্ব অসীম। মানবশিশু জন্ম হতে মানবাধিকারের দাবি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আমরা জানি, মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবীর নতুন পরিবেশে চিৎকার করে তার আগমনী বার্তা প্রকাশ করে বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সে কারণে বলা যায়, বাকস্বাধীনতা স্রষ্টাপ্রদত্ত মানুষের জন্মগত অধিকার। কোনোভাবেই মানুষের বাকস্বাধীনতা প্রতিরোধ করা উচিত নয়। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্লোগান চলছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে অপর দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মানবাধিকারের স্লোগান বা কার্যক্রমকে মানবাধিকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমরা জানি, পশ্চিমা বিশ্ব শীতল যুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনয়ন করেছিল। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ১৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছিল। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অপমৃত্যু ঘটিয়েছিল। অথচ এত কিছুর পরেও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আহামরি কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। আমরা জানি, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে বিধ্বংসী, রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অজুহাত তুলে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাক আক্রমণ করেছিল। আমেরিকার সাথে, এই আগ্রাসী যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলো আমেরিকান সেনাবাহিনীর সাথে একত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘদিনের যুদ্ধের ফলে ইরাকের অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বুলি আউড়িয়ে ইরাকের তেল, গ্যাস ও মূল্যবান খনিজসম্পদ লুণ্ঠন করে যে প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে।

২০১০ সালে আমেরিকা আরব বসন্ত নামক এক নতুন স্লোগান মধ্যপ্রাচ্যে আমদানি করে। আরব বসন্ত নামক এ অভিযানে তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকার পতনের ছক তৈরি করে। আমেরিকা ও তার মিত্ররা আরব বসন্ত প্রতিষ্ঠার নামে ইরাকে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়, যে যুদ্ধ এখনো চলমান। ইরাকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। আরব বসন্তের দেখা পাওয়া যায়নি। গৃহযুদ্ধের এ সুযোগে আমেরিকা ও তার মিত্ররা লিবিয়া থেকে ব্যাপক হারে তেল, গ্যাস ও মূল্যবান খনিজসামগ্রী লুটপাট করে। এখনো সে প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

আমেরিকা সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ তুলে আফগানিস্তান আক্রমণ করে। দীর্ঘকাল এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। আলকায়েদা নামক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রধান ওসামা বিন লাদেন ২ মে ২০১১ সালে আমেরিকার সামরিক অভিযানে পাকিস্তানে নিহত হন। অথচ আফগানিস্তানে আমেরিকা ও মিত্র বাহিনীর আগ্রাসন অব্যাহত থাকে। আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তি ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর থেকে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। প্রায় ২০ বছরব্যাপী এ অভিযান অব্যাহত ছিল। অতঃপর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানদের দীর্ঘ প্রতিরোধের মুখে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে তাদের সামরিক অভিযান গুটিয়ে নেয়। ২০ বছর সময়ের এই অসম যুদ্ধে আফগানদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।

তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ এমনকি আমাদের দেশেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে বিরোধী দলের মানবাধিকারকে হরণ করা হয়। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সরকারি পদ্ধতিতে দেশ শাসন করি। সংসদীয় পদ্ধতিতে আমাদের দেশ পরিচালিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রথম সোপান বাকস্বাধীনতা। মিটিং মিছিল বাকস্বাধীনতার অন্যতম অনুষঙ্গ। বিরোধী দল ব্যতীত গণতন্ত্র অচল। সে কারণে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে তাদের মিটিং মিছিল প্রতিরোধ করে বাকস্বাধীনতার দাবি হাস্যকর। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় বা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দল জনমত পক্ষে নেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে চলেছে।

নিত্যনতুন কলাকৌশল করা হচ্ছে। মানুষ মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কিত। অনেকের ধারণা ও বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের সঠিক প্রয়োগ হয়নি। জনগণ অবাধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। বিভিন্ন কলাকৌশল ও কারচুপির মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বর্তমানে দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য ও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। প্রথমত, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ অথবা সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। সরকারি দল বিরোধী দলের এ দাবি মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক পরিবেশে আন্তর্জাতিকভাবে শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশেও শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকার অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণে আগ্রহী। বিরোধী দলগুলো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের বিরোধী। বিরোধী দলগুলোর বক্তব্য, ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট কারচুপির সমূহ সম্ভাবনা। সে কারণে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সনাতন প্রাচীন পদ্ধতিতে ভোট গ্রহন করতে হবে।’ সম্প্রতি বিরোধী দলের মতামতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে আগ্রহী। বাদবাকি ১৫০টি আসনে বর্তমান সরকার সনাতন পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষপাতী। বিরোধী দলগুলো সরকারের এ প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছে।
সরকারের দাবি, ইভিএম পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার বা ইউপি নির্বাচন সংঘটিত হয়েছে। এ নির্বাচন পদ্ধতি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে বলে সরকার পক্ষ দাবি করছে। অপর দিকে বিরোধী দলগুলো বিগত সময়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতিতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করছে। সে কারণে বিরোধী দলগুলো আগামীতে কোনো অবস্থাতেই ইভিএম পদ্ধতির নির্বাচনে রাজি হচ্ছে না। সে কারণে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে অবিশ্বাস ও দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষ ভোটাধিকার নিয়ে শঙ্কিত। সরকারের পক্ষে অবশ্য বারবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা প্রদান করা হচ্ছে। বিদেশী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অনেক মানবাধিকার সংস্থা, বিশেষত জাতিসঙ্ঘ, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করছেন। বিষয়টি কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। সে কারণে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার ও সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। অথচ আমরা জানি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সরকার গঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। সরকারি ও বিরোধী দল উভয়পক্ষের আলোচনা ও পর্যালোচনায় মানবাধিকার তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রকৃত পক্ষে বর্তমান রাজনীতি ক্ষমতা গ্রহণের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে যে কারণে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, কী প্রক্রিয়ায় বা কোন পদ্ধতিতে সরকার গঠন করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। মূলত মানবাধিকার বা জনকল্যাণ বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হতে অনেক দূরে। সে কারণে আন্তরিকতার সাথে আলোচনার মাধ্যমে মানবাধিকার ও জনকল্যাণের কথা বিবেচনা করে ক্ষমতাসীন সরকার ও বিরোধী দল সঙ্কট নিরসন না করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা যায়।

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
গাজার উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের গভীরে ইসরাইলি ট্যাংক, নিহত ৪২ রাজধানীতে আসছে শীতের প্রচুর সবজি ওপারে রাতভর বোমার বিস্ফোরণ আতঙ্কে নির্ঘুম টেকনাফবাসী সীমান্তের ওপারে ফ্যাসিস্ট বসে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র করছে : মির্জা ফখরুল আওয়ামী শাসনামলের চেয়ে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে আছে সেন্টমার্টিনে বছরে দেড় লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে বিজেপি নির্দিষ্ট একটি ধর্মের প্রতি প্রতিহিংসাপ্রবণ : মমতা চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র চলছে, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে : ডা: শফিক ৫২ সেকেন্ডের ভিডিওতে খুনে জড়িতদের চেহারা ভারতের দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর : আসিফ নজরুল কলকাতায় জাতীয় পতাকা পোড়ানোয় বাংলাদেশের নিন্দা

সকল